সোমবার, ৩০ Jun ২০২৫, ০২:৫৩ পূর্বাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
ইসলাম বলে, সময় হলো জীবনকাল মানে হায়াত। দুনিয়ার জীবন মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত সময়ের সমষ্টিমাত্র। সময় ও জীবন একাকার। নির্ধারিত সময়ে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় অনিবার্য বিধায় সময় সচেতনতা অপরিহার্য। সময় সচেতনতা ও সাফল্য অনেকটাই সমানুপাতিক। দুনিয়ার জন্য নির্ধারিত সময়কে পরকালের সঙ্গে তুলনা করে কোরআন মাজিদে কোথাও কয়েকটি ঘণ্টা, একটি সকাল বা একটি বিকেল ইত্যাদি শব্দ দ্বারা দুনিয়ার জীবনের সময় গুরুত্ব অনুধাবন করে মনোযোগী হওয়ার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
সমাজে যারা উঁচু পর্যায়ে অবস্থান করেন, তারা সময় সংকটে ভোগেন। নেতাদের গণসংযোগ, নির্বাহীদের ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিতে সময়ের ভারসাম্য রক্ষায় সমস্যা সৃষ্টি হয়। ইসলাম এ ব্যাপারে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দিয়ে সময়কে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে বলেছে, ‘একটি কাজ শেষ করেই আরেকটি কাজ শুরু করে দিন।’ -সুরা আল ইনশিরাহ : ৭
আর এটা পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া কখনই সম্ভব নয়। এখানে অবসর সময় বুঝাতে আরবি ‘ফারাগ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু যাদের পূর্বপরিকল্পনা থাকে না তারা সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে না। ফলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাদের ব্যাপারে নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর দেওয়া দুটি নেয়ামত ব্যবহারে অধিকাংশ মানুষ ধোঁকা খেয়েছে। একটি হলো তার সুস্থতা, অপরটি তার অবসর সময়।’ জীবনের সময় নির্ধারিত বলেই দরকার সময়ের যথার্থ ব্যবহার ও পরিকল্পনা। কোন কাজের জন্য কতটুকু সময় প্রয়োজন, কখন শুরু করে কখন শেষ করতে হবে, কোন কাজটি অগ্রাধিকারের যোগ্য ইত্যাদি বিবেচনায় নিতে হবে। এ ছাড়া প্রয়োজন কাজের মূল্যায়ন এবং পরবর্তী পদক্ষেপ, নষ্ট সময়ের জন্য আফসোস করে সময় আরও ব্যয় করার চেয়ে সামনে যেন আর সময় নষ্ট না হয় তার সিদ্ধান্ত জরুরি।
সময়কে ঘিরে রয়েছে শয়তানের নানাবিধ অশুভ চক্রান্ত। শয়তান চায় মানুষ অযথা সময় নষ্ট করুক, অলস সময় কাটাক। নিজের জরুরি কাজ সম্পর্কে ভুলে থাকুক। আড্ডাবাজি ইত্যাদিতে ব্যস্ত রেখে শয়তান মানুষের সময়কে নষ্ট করতে তৎপর থাকে। কর্মপরিকল্পনার কথা শয়তান ভুলিয়ে দেয়। ফলে জীবনে আসে শেষ সময়ের তাড়াহুড়া, আর এটা হলো শয়তানের আরেক কারসাজি।
সচেতন মানুষ তাই সময় হিসাব করে, পরিকল্পনা অনুসারে ব্যয় করেন, দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ভিত্তিতে পরিকল্পনা করে কাজের সময় বণ্টন করেন। এমনকি দৈনিক কাজের জন্য আগাম সময় বণ্টন করে ক্রমান্বয়ে কাজ সম্পাদন করে থাকেন। ফলে তারা অনেক সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন।
সময় নষ্ট করা থেকে বাঁচতে হলে কথাবার্তা সংক্ষেপ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘যে চুপ থাকল সে বেঁচে গেল।’ এই হাদিসটি আমল করে শুধু অপ্রয়োজনীয় কথা পরিহার করে অনেক সময় বাঁচিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ সমাধা করা যায়। দৈনিক এক ঘণ্টা করে সময় বাঁচিয়ে বছরে ৩৬৫ ঘণ্টা বাড়তি সময়ে অনেক বড় বড় কাজ সম্পাদন করা যেতে পারে। এ সময়ে কোরআন মাজিদ তেলাওয়াত করা যেতে পারে। কোরআন মাজিদের কয়েকটি সুরা মুখস্থ করা যেতে পারে, কয়েকটি আয়াতের তাফসির পড়া যেতে পারে, যেকোনো একটি আন্তর্জাতিক ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা যেতে পারে। নিজের পেশাগত কাজের উন্নতিকল্পে নতুন কিছু শেখা যেতে পারে। এভাবেই সময়ের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে ইসলাম জোর তাগিদ দিয়েছে। তার পরও মানুষ বেখবর, অসচেতন সময় সম্পর্কে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
নবী কারিম (সা.) হলেন জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মানুষ, যিনি সময়ের মূল্য দেওয়ার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ উদাহরণ পেশ করেছেন। তার ৬৩ বছরের জীবনকালের কর্মপরিধির বিস্তার এবং সবক্ষেত্রে সাফল্যের উদাহরণ এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘এমন কোনো একটি সকাল আসে না যখন একজন ফেরেশতা ঘোষণা করে না যে, হে বনি আদম! আমি একটি নতুন দিন এবং আমি তোমার কাজের সাক্ষী। সুতরাং আমার সর্বোত্তম ব্যবহার করো। শেষ বিদায়ের দিনের আগে আমি আর কখনো ফিরে আসব না।’ বলা হয়, সময় স্রোতের মতোই বয়ে যায়। সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না। কোরআন মাজিদে আল্লাহতায়ালা সময়ের কসম খেয়ে বলেছেন, ‘সময়ের বিচারে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত।’ -সুরা আল আসর : ১-২
কেউ কেউ তো সময় নষ্টকারীকে তুলনা করেছেন সেই বরফ বিক্রেতার সঙ্গে, যার বরফ বিক্রির আগে গলে পানি হয়ে যায়। ফলে সে আর ব্যবসায় কোনো মুনাফা তো পায়ই না, উল্টো মূলধন হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। নবী কারিম (সা.) সেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পরিচয় বলেছেন এভাবে, ‘যার দুটি দিন একই রকম যায়, নিঃসন্দেহে সেই ক্ষতিগ্রস্ত।’ তাই গতকালের অবস্থার চেয়ে আজকের অবস্থা ভালো করার জন্য প্রয়োজন হলো সিদ্ধান্তের আর সময়ের সদ্ব্যবহারের।
দুনিয়ার জীবনের সময় নির্ধারিত। কখন তা শেষ হবে তা কারোরই জানা নেই। নির্ধারিত সময় এলেই সব শেষ। সে জন্য প্রয়োজন অনেক অর্জন ও বর্জন যা পরকালের পাথেয় হতে পারে। যেন সেখানে পৌঁছে কেউ না বলে যে আমি অল্পকালই ছিলাম। আর আফসোস করে বলবে, হায় আমি যদি হায়াত (সময়কে) কাজে লাগানোর ব্যাপারে যথার্থ পদক্ষেপ করতাম! মহান আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষকে যত নেয়ামত দিয়েছেন সময় তার অন্যতম। সময়ই উন্নতি অবনতির সোপান। এখানে যাদের হার হয়েছে তারা আর শির উঁচিয়ে দাঁড়াতে পারেনি। জ্ঞানীরা বলেন, আগে মানুষ সময় নষ্ট করে অনুতপ্ত হতো। কিন্তু এখানে তাকে একটি বিষয় অনুতপ্ত হতে দেয় না। তা হলো ‘আগামীকাল’। এ শব্দটি উচ্চারণ করার চেয়ে বড় অপরাধ, নির্ভীকতা, অসতর্কতা ও বোকামি আর কিছুই নেই। একটি লোকের জীবন অকার্যকর ও নষ্ট হওয়ার জন্য এই একটি শব্দই যথেষ্ট। তাই মানুষকে ‘আগামীকাল’ ছেড়ে ‘আজ’ শব্দের দিকে ফিরে আসতে হবে। আজই করছি বলে দৃঢ় সংকল্প করতে হবে। তবেই জীবনে মিলবে কাক্সিক্ষত সফলতা। যে সফলতা লাভে উদগ্রীব তামাম বনি আদম।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
muftianaet@gmail.com