সোমবার, ৩০ Jun ২০২৫, ০২:৫৩ পূর্বাহ্ন
রাজেকুজ্জামান রতন:
৩৬৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা, যার বেশিরভাগ অংশ রুক্ষ, শুষ্ক; যেখানে বাস করতে বাধ্য হয়েছে ২২ লাখ মানুষ অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে ৫ গুণ বেশি ঘনবসতি। এর কোথাও কংক্রিটের দেয়াল আর কোথাও কাঁটাতার বেড়া দিয়ে চারদিক ঘেরা, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার যা মানুষের ওপর মানুষের নির্মমতার এক নির্লজ্জ চিত্র, এই অঞ্চলের নাম ‘গাজা’। গত ছয় দিনে নরক নেমে এসেছে এই অঞ্চলের মানুষের ওপরে। ইসরায়েলের বিমান বাহিনী তাদের হিসাবেই ছয় হাজারের বেশি বোমা ফেলেছে। বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, নেই খাবার। জ¦লছে গাজা আর মরছে মানুষ। কবরস্থানে নোটিশ ঝুলছে, এখানে আর কবরের জায়গা নেই। যারা বেঁচে আছে তারা ভয় পেতেও যেন ভুলে গেছে। এত বড় মানবিক বিপর্যয় পৃথিবীর কোথায় ঘটেছে আর?
শত্রুর শক্তি বিপুল, তাদের বিপরীতে নিজেদের সামর্থ্য নগণ্য, ফলে বিজয়ের কোনো সম্ভাবনাই নেই। তার পরও কখন মানুষ লড়াই করে? নিশ্চিত মৃত্যুকে কখন মানুষ আলিঙ্গন করে? নিজের মৃত্যুর পর অবর্ণনীয় নির্যাতন ভোগ করতে হবে প্রিয় সন্তান, স্ত্রী, বাবা- মাকে তা জেনেও বা তাদের চরম বিপদের মুখে রেখে কখন মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে এক অসম যুদ্ধে? কোথায় মানুষ এতটা মরিয়া হয়ে মরে এবং মারতে চায়? এসব প্রশ্নের উত্তর হলো, গাজাসহ ফিলিস্তিন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? এর উত্তর লুকিয়ে আছে ইতিহাসে, আছে বর্তমানে।
হাজার বছর ধরে ভূমির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল যে ফিলিস্তিনিদের জীবন, সেই ভূমি থেকে নির্বাসিত অথবা কোনো এক কোনায় কোণঠাসা হয়ে থাকা মানুষের আর্তি ফুটে উঠেছে ফিলিস্তিনের চির নির্বাসিত কবি মাহমুদ দারবিশের পঙ্্ক্তিতে। দ্য আর্থ ইজ ক্লোজিং অন আস এ তিনি লিখেছেন, ‘দুনিয়া ঘনিয়ে আসছে আমাদের দিকে/ ধরিত্রী ঠেসে ধরছে একেবারে শেষ কোনাটায়…/ শেষ প্রান্তে ঠেকে গেলে যাবটা কোথায়?/ শেষ আসমানে ঠেকে গেলে পাখিগুলো উড়বে কোথায়?/ হয়ার শুড দ্য বার্ডস ফ্লাই আফটার দ্য লাস্ট স্কাই?’ তার মর্মভেদী হাহাকার, কোথায় উড়বে পাখি শেষ আসমানের পর? উত্তর জানা নেই, উত্তর দেয় না কেউ। তার কবিতাটির ‘আফটার দ্য লাস্ট স্কাই’ বা ‘শেষ আসমানের পর’ কথাটি নিয়ে এডওয়ার্ড সাঈদ লিখেছিলেন ফিলিস্তিনি জীবনবিষয়ক বই আফটার দ্য লাস্ট স্কাই। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘শেষ আসমানের পর আর কোনো আসমান নাই। শেষ ভূখণ্ডের পর আর কোনো ভূখণ্ড নাই। তাই ফিলিস্তিনিদের আমৃত্যু লড়াই ছাড়া আর কোনো পথও খোলা নাই।’
১৯৪৮ সালের আগে ছিল গুপ্তহত্যা আর ’৪৮-এর ১৪ মে তাদের ওপর নেমে এলো নাকবা বা মহাবিপর্যয়। তারপর থেকে প্রতিদিন ফিলিস্তিনের জনগণের জীবন, সম্পদ, জমি কেড়ে নেওয়া, অধিকৃত অঞ্চলে নতুন নতুন ইসরায়েলি বসতি স্থাপন করার ফলশ্রুতিতে ফিলিস্তিনের জনগণ আজ নিজ দেশে পরবাসী হয়ে পড়েছে। মাত্র কদিন আগেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দম্ভভরে বলে এসেছেন, ইসরায়েলকে কেন্দ্র করে তারা আরব অংশীদারদের নিয়ে নতুন একটি মধ্যপ্রাচ্য গড়বেন। বেনিয়ামিন তার কল্পিত নতুন মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র থেকে ফিলিস্তিনকে পুরোপুরি মুছে ফেলেছিলেন। ফলে হামাসের এই হামলার উদ্দেশ্য মোটেও বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তাই হামাস চেয়েছে বিশ্ব বিবেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। দ্বিতীয়ত, এই হামলার মধ্য দিয়ে হামাস ইসরায়েলের দখলদারি, উৎপীড়ন এবং ফিলিস্তিনিদের ধর্মীয় প্রতীক, বিশেষ করে আল-আকসা মসজিদকে অপবিত্র করার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে। তৃতীয়ত, এই অঞ্চলে বর্ণবাদী শাসন জারি রাখা ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক তৈরির বিরোধিতাকে জোরালো যুক্তি দিতে চেয়েছে। আর হামলার সর্বশেষ লক্ষ্য হলো, ইসরায়েলি কারাগার থেকে যতটা সম্ভব ফিলিস্তিনি রাজবন্দিদের মুক্ত করা। এসব বিবেচনায় গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় হামলা চালিয়েছিল হামাসের যোদ্ধারা। মাত্র ২০ মিনিটে দেশটিতে ৫ হাজারের বেশি রকেট ছোড়ার কথা জানিয়েছে তারা। ৫০ বছর আগে ‘ইয়ম কিপ্পুর’ যুদ্ধের (১৯৭৩ সালে ৬ দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ) পর এমন রক্তক্ষয়ী হামলার মুখে আর পড়েনি ইসরায়েল। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠেই অবরুদ্ধ গাজায় নির্বিচার বিমান হামলা ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া শুরু করে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যাপক বিমান হামলা। গুঁড়িয়ে দিতে থাকে বাড়িঘরসহ সব স্থাপনা। ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ঢুকে পড়া হামাস যোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করা আর ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করতে সব শক্তি নিয়োজিত করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, ‘যুদ্ধাবস্থা’ ঘোষণা করে সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সামরিক বাহিনীর রিজার্ভ সদস্যদের তলব করা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব গাজার ২২ লাখ বাসিন্দাকে বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বলেছেন নেতানিয়াহু। টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই কালো দিনটির কঠিন বদলা আমরা নেব। প্রাণ হারানো সব তরুণের প্রতিশোধ আমরা নেব। হামাসের সব অবস্থানে আমরা হামলা চালাব। গাজাকে জনমানবশূন্য এক দ্বীপে পরিণত করব। তিনি আরও বলেন, ‘গাজার নাগরিকদের আমি বলছি, তোমাদের এখনই গাজা ছেড়ে যেতে হবে। আমরা এই উপত্যকার প্রতিটি স্থানকে লক্ষ্যবস্তু করব।’ আর হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ বলেছেন, পরিণতি ভোগ না করে পার পাওয়া যাবে না, শত্রুদের সেটা উপলব্ধি করার সময় এসেছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে ইসরায়েলের দখল করা শেবা ফার্ম এলাকায় রকেট ও কামান হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহ। আর হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া বলেছেন, গাজায় যে হামলা শুরু হয়েছে, তা পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমেও ছড়িয়ে পড়বে।
যত হঠকারীই বলা হোক না কেন, হামাসের হামলার সঙ্গে গাজাসহ ফিলিস্তিনিদের যে কি আবেগ যুক্ত হয়ে আছে তা মধ্যপ্রাচ্যের নিউজ পোর্টাল মিডল ইস্ট আই-কে দেওয়া গাজার একজন ফিলিস্তিনি সাংবাদিকের মন্তব্য থেকে কিছুটা অনুমান করা যায়। তিনি বলেছেন, ভেঙে ফেলা বেড়া ডিঙিয়ে তিনি যখন ইসরায়েলের দখল করা জমিতে পা রাখলেন, তখন তার চোখ ভিজে গিয়েছিল। এই মাটিতে পূর্বপুরুষদের বসতি ছিল। আগ্রাসী ইসরায়েল দেয়াল তুলে সেই মাটি দখল করেছে। এখন সেখানে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনভাবে পা রাখার সুযোগ নেই।
’৪৮, ৬৭ ও ৭৩-এর আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ ও তার পরিণতির কথা ফিলিস্তিনিদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় বড় শক্তি ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছে, তাদের সমর্থনে যুদ্ধ সরঞ্জাম পাঠিয়েছে। এবারও ইসরায়েলে অভিযান চালানোর পরিণতি ভয়াবহ হবে এটি হামাসের না জানার কারণ নেই। হামাস তাহলে কেন এই হামলা চালাল? সাধারণভাবে বুঝতে পারা যায়, এ ধরনের হামলা চালানো ছাড়া ফিলিস্তিনিদের সামনে পথও খোলা ছিল না। পশ্চিম তীরের প্রায় পুরোটাই ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের দখলে চলে গেছে। এখন ইসরায়েল বলছে, গাজাকে গিলে ফেলবে। গিলছে তো তারা শুরু থেকেই, প্রতিদিন আর বরাবরের মতো চুপ করে আছে বিশ্ববিবেক। সব হারানো, ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনিরা তাহলে প্রতিরোধ করা ছাড়া আর কী করবে? ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ভূমধ্যসাগর থেকে জর্দান নদী পর্যন্ত সবটুকু এলাকা দখল করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রচণ্ড প্রতিহিংসা আর ভয়ংকর মারণাস্ত্র নিয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এখন যা করছে তা হলো, গাজাকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া। এতে হতাহতের সংখ্যা হবে অগণন। আর গাজায় হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি, শরণার্থী সংকটের আশঙ্কা বড় পরিসরে যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে পারে। এই যুদ্ধে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের একাধিক গোষ্ঠী, পশ্চিম উপত্যকা ও জেরুজালেমের বেসামরিক জনগোষ্ঠী, সিরিয়া ও জর্দানের যুক্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইসরায়েল এই সুযোগে ইরানকে এক হাত দেখে নেওয়ার সুযোগ যেমন খুঁজছে, আমেরিকাও চাইছে একটা মোক্ষম সুযোগ। ফলে ফিলিস্তিনের আরও জায়গা দখল করে ইসরায়েলের সীমানা বাড়ানো আর বিশ^ব্যাপী যুদ্ধাতঙ্ক সৃষ্টি, মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র বিক্রির সম্ভাবনা বাড়াবে এই যুদ্ধ।
কিন্তু কী হবে ফিলিস্তিনিদের? গাজায় খাবার প্রবেশ ও মানুষ চলাচলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুটি ক্রসিং ওরেজ ও কারেম শালোম। যুদ্ধ শুরুর পর দুটি ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। অন্যদিকে মিসর থেকে রাফাহ ক্রসিং দিয়ে গাজায় পণ্য, খাবার ও জ্বালানি নেওয়া হয়। ফিলিস্তিনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন, রাফাহ ক্রসিংয়েও হামলা হয়েছে। তাহলে খাদ্য-ওষুধ পাবে কীভাবে মানুষ?
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, তাদের কাছে গাজাবাসীর জন্য এক মাসের খাবার মজুদ আছে। পরিস্থিতি ক্রমাগত ভয়াবহ হচ্ছে, দ্রুত খাবারের জোগান দিতে না পারলে চরমতম সংকটে পড়বে গাজার মানুষ। বিদ্যুৎকেন্দ্র ধ্বংস করে দেওয়ায় গাজা এখন বিদ্যুৎহীন। এ অবস্থায় হাসপাতালের চিকিৎসা বন্ধ আর মজুদ খাবার নষ্ট হয়ে সৃষ্টি হবে মহাবিপর্যয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা যা কিছু দরকার, তার সবই করব। এবং তারা তা করছেন। সামান্য হামাস যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য চার বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র আর সর্বাধুনিক রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোরডকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে পাঠানো হয়েছে। এই বহরে আছে এফ- ৩৫, এফ-১৫, এফ-১৬ এবং এফ-১০ যুদ্ধবিমান। রণসাজ দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, যুদ্ধযাত্রার উপলক্ষ ফিলিস্তিন হলেও লক্ষ্য মধ্যপ্রাচ্য।
মধ্যপ্রাচ্য সংকটে বারবার প্রশ্ন উঠেছে, তেল কি রক্তের চেয়ে ঘন? এখন প্রশ্ন উঠছে ব্যবসার ক্ষেত্রে সেটা খাদ্য, অস্ত্র আর তেল যা নিয়েই ব্যবসা হোক না কেন মুনাফা কি মানবতার চেয়ে বড়? মুনাফার কাছে ইহুদি, মুসলমান, খ্রিস্টান নেই। রক্ত আর চোখের জলের কোনো মূল্য নেই। ফিলিস্তিনিদের জীবন বলতে কিছু নেই। মানুষের মৃত্যুতে কান্না, কষ্ট নয় গাজার মানুষেরা শুধু সংখ্যামাত্র।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক
rratan.spb@gmail.com