সোমবার, ৩০ Jun ২০২৫, ০২:৪৫ পূর্বাহ্ন
আন্তোনিও গুতেরেস:
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ এক অধিবেশনে সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ফিলিস্তিন-ইসরায়েল চলমান সংঘাত নিয়ে এক ভাষণ দিয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রদত্ত ভাষণটি সময়ের প্রেক্ষাপটে ব্যতিক্রমী এবং ঐতিহাসিক। দেশ রূপান্তরের পাঠকদের জন্য ভাষণটির অনুবাদ প্রকাশ করা হলো-
মি. প্রেসিডেন্ট, আপনার অনুমতিক্রমে নিরাপত্তা পরিষদকে মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফ করার আগে আমি একটি ছোট ভূমিকার অবতারণা করতে চাই।
মহামান্য, মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি প্রতি ঘণ্টায় আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে। গাজায় যুদ্ধ চলছে এবং পুরো অঞ্চল জুড়ে তা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিভাজন সমাজকে বিভক্ত করে ফেলেছে। উত্তেজনা টগবগ করে ফুটছে। এ ধরনের সংকটময় মুহূর্তে, নীতিমালাগুলোকে পরিষ্কার করা অপরিহার্য, যার শুরুতেই রয়েছে বেসামরিক নাগরিকদের মর্যাদা ও সুরক্ষার মৌলিক নীতিগুলোর বিষয়ে স্পষ্ট হওয়ার বিষয়।
আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ইসরায়েলে হামাসের ৭ অক্টোবরের ভয়াবহ এবং নজিরবিহীন সন্ত্রাসের নিন্দা জানিয়েছি।
বেসামরিক লোকদের ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা, আহত এবং অপহরণ বা বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রকেট ছোড়ার মতো ঘটনা কোনোভাবেই ন্যায্যতার দাবি রাখতে পারে না।
জিম্মিদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করতে হবে এবং অবিলম্বে এবং শর্তহীনভাবে তাদের মুক্তি দিতে হবে। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে আমাদের মধ্যে তাদের পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতি লক্ষ করি।
মহামান্য, এটা স্বীকার করে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ যে হামাস হাওয়া থেকে বা এমনি এমনি এই হামলা করেনি।
ফিলিস্তিনি জনগণ ৫৬ বছর ধরে শ্বাসরুদ্ধকর দখলদারিত্বের শিকার হয়ে আসছেন। তারা দেখে আসছেন তাদের ভূমি অবিচ্ছিন্নভাবে বসতি স্থাপনের মাধ্যমে বেদখল হচ্ছে এবং তারা সহিংসতায় জর্জরিত। তাদের অর্থনীতি শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। তাদের মানুষগুলো বাস্তুচ্যুত হচ্ছে এবং তাদের ঘরবাড়িগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে। তাদের দুর্দশার রাজনৈতিক সমাধানের আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।
কিন্তু ফিলিস্তিনি জনগণের এই ক্ষোভ হামাসের ভয়ংকর হামলাকে ন্যায্যতা দিতে পারে না। একই সঙ্গে, এই ভয়ংকর হামলা ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর চালানো কালেক্টিভ পানিশমেন্টেরও ন্যায্যতা দিতে পারে না।
মহামান্য, এমনকি যুদ্ধেরও কিছু নিয়মনীতি আছে।
আমাদের সব পক্ষের প্রতি দাবি থাকবে, তারা যেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মেনে তাকে সমুন্নত রাখে এবং সম্মান করে। সামরিক অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা যেন বেসামরিক লোকদের রেহাই দিতে সচেতন থাকে। হাসপাতালগুলোকে সম্মান জানান, রেহাই দিন। এবং জাতিসংঘের স্থাপনা ও সুবিধাগুলোর নিরাপত্তাকে সম্মান করুন, যা ৬০০০০০ এরও বেশি ফিলিস্তিনিকে আশ্রয় দিচ্ছে।
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর কর্তৃক ধারাবাহিক বোমাবর্ষণে বেসামরিক মানুষের হতাহতের মাত্রা এবং আশপাশের পাইকারি ধ্বংস অব্যাহত রয়েছে এবং যা গভীরভাবে উদ্বেগজনক। গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর লাগামহীন বোমাবর্ষণ, বেসামরিক জনগণের হতাহতের মাত্রা এবং আশপাশের পাইকারি ধ্বংসযজ্ঞ বেড়েই চলেছে, যা গভীরভাবে উদ্বেগজনক।
আমি গত দুই সপ্তাহে গাজায় বোমাবর্ষণে নিহত জাতিসংঘের ৩৫ জন সহকর্মীর প্রতি শোক ও সম্মান জানাই। তারা সেখানে টঘজডঅ-এর জন্য কাজ করছিলেন। আমি তাদের পরিবারের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী ও ঋণী। আমি এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানাই।
যেকোনো সশস্ত্র সংঘাতে, সর্বাগ্রে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা। বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করার নামে তাদের কখনই মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করার অর্থ এই নয় যে দশ লাখেরও বেশি লোককে দক্ষিণে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া, যেখানে কোনো আশ্রয় নেই, খাবার নেই, পানি নেই, ওষুধ নেই, জ্বালানি নেই এবং তারপরে দক্ষিণেও বোমা হামলা চালিয়ে যাওয়া।
গাজায় আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘনের ঘটনায় আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আরও পরিষ্কার করে বলা যায়- সশস্ত্র সংঘাতে জড়িত কোনো পক্ষই আন্তর্জাতিক আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
মহামান্য, সৌভাগ্যক্রমে, কিছু মানবিক ত্রাণ অবশেষে গাজায় প্রবেশ করছে। কিন্তু এটি প্রয়োজনের সাগরে সাহায্যের এক ফোঁটামাত্র। উপরন্তু, গাজায় আমাদের জাতিসংঘের জ্বালানি সরবরাহ কয়েক দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। সেটা হবে আরেকটি বিপর্যয়।
জ্বালানি ছাড়া, সাহায্য কার্যক্রম চালানো যাবে না, হাসপাতালের পাওয়ার বন্ধ হয়ে যাবে এবং খাবার পানি বিশুদ্ধ করা যাবে না এমনকি পাম্প করা যাবে না। গাজার অধিবাসীদের বিপুল চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে সেখানে অবিচ্ছিন্নভাবে ব্যাপক মাত্রায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। এই ত্রাণ বিতরণে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না।
আমি গাজায় আমাদের জাতিসংঘের সহকর্মী এবং মানবিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারীদের অভিনন্দন জানাই যারা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে কাজ করছেন। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপদগ্রস্তদের সহায়তা করছেন। তারা আমাদের অনুপ্রেরণা। এই মহাকাব্যিক দুর্ভোগ লাঘব করতে, ত্রাণ বিতরণ সহজ ও নিরাপদ করতে এবং জিম্মিদের মুক্তির সুবিধার্থে, আমি অবিলম্বে মানবিক যুদ্ধবিরতির জন্য আমার আবেদন পুনর্ব্যক্ত করছি।
মহামান্য, গুরুতর এবং তাৎক্ষণিক বিপদের এই মুহূর্তে, আমরা সত্যিকারের শান্তি ও স্থিতিশীলতার একমাত্র বাস্তববাদী ভিত্তির লক্ষ্য হারিয়ে যেতে দিতে পারি না: সেটা হচ্ছে একটি দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান।
ইসরায়েলিদের বৈধ চাহিদার জন্য অবশ্যই নিরাপত্তা বাস্তবায়িত করতে হবে। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য তাদের বৈধ আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের দিকটি দেখতে হবে। যা হবে জাতিসংঘের রেজুলেশন, আন্তর্জাতিক আইন এবং পূর্ববর্তী চুক্তির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
পরিশেষে, মানুষের মর্যাদা সমুন্নত রাখার নীতিতে আমাদের অবশ্যই স্পষ্ট হতে হবে। মেরুকরণ এবং অমানবিকীকরণকে ইন্ধন জোগাচ্ছে বিভ্রান্তির সুনামি। আমাদের অবশ্যই ইহুদি বিদ্বেষ, মুসলিম-বিরোধী ধর্মান্ধতা এবং সব ধরনের ঘৃণার শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।
মি. প্রেসিডেন্ট, মহামান্য, আজ জাতিসংঘ দিবস। জাতিসংঘ সনদ কার্যকর হওয়ার ৭৮ বছরের পূর্তি হলো। এই সনদ শান্তি, টেকসই উন্নয়ন এবং মানবাধিকারের অগ্রগতির জন্য আমাদের যৌথ অঙ্গীকারকে প্রতিফলিত করে। এই জাতিসংঘ দিবসে, এই সংকটময় সময়ে, সহিংসতায় আরও বেশি ছড়িয়ে পড়া ও প্রাণ সংহারের আগেই আমি সবাইকে আবেদন জানাচ্ছি যে, তারা যেন সেখান থেকে সরে আসে।
জাতিসংঘের ওয়েবসাইট থেকে ভাষান্তর: সাঈদ জুবেরী
ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশরূপান্তর