রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০৯:৫৭ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

নেয়ামতের পরীক্ষা আরও বেশি কঠিন

ইসলামী জীবন, ফাইল ছবি।

মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিনা চাওয়ায় দুনিয়ায় বুকে যেসব সুযোগ-সুবিধা মানুষ অবলীলায় ভোগ করছে স্বাভাবিক অর্থে সেসবকে নেয়ামত বলা হয়। যেমন শ্বাসগ্রহণ, দৃষ্টিশক্তি, সূর্যের তাপ, চাঁদের আলো, গায়ের রঙ সাদা-কালো হওয়া ইত্যাদি। এভাবে আল্লাহতায়ালা মানুষের জন্য অসংখ্য নেয়ামত দিয়ে রেখেছেন। আল্লাহর নেয়ামত ও অনুগ্রহ ছাড়া মানুষের বা কোনো প্রাণীর এক মুহূর্তও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। কোরআন মাজিদের উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে রয়েছে আল্লাহর নেয়ামতের বর্ণনা। বিভিন্ন সুরায় বিভিন্নভাবে আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের সচেতন করেছেন তার দান ও নেয়ামত সম্পর্কে। মানবের উত্তম আকৃতি, রূপ-যৌবন, জ্ঞান-বুদ্ধি, সহায়-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি সবকিছুই আল্লাহর দান। এই পৃথিবী ও পৃথিবীর সব বস্তুই মানবের জন্য সৃজিত। কিন্তু এই নেয়ামত মানুষের জন্য পরীক্ষা। এ বিষয়ে মানুষ উদাসীন, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

আমরা জানি, মানুষের আসল আবাস জান্নাত। কিছুদিনের জন্য তাদের দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে। আবার আমাদের জান্নাতে যেতে হবে। তবে এমনিতেই নয়, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে। দুনিয়া মানুষের জন্য পরীক্ষা ক্ষেত্র। এ জীবনে ভালো-মন্দ, আনন্দ-বেদনা, আলো ও অন্ধকার পাশাপাশি অবস্থান করে। মানুষের জীবনে কখনো সুখ আর সুখ, প্রাচুর্য আর প্রাচুর্য এবং কখনো বা দুঃখ-দুর্দশায় জর্জরিত হয়ে পড়ে জীবন। এ উভয় অবস্থা মিলেই মানুষের জীবন।

স্বাভাবিকভাবে মানুষ দুঃখ-দুর্দশা, রোগ-শোক, অভাব-অনটন ইত্যাদিকে কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা মনে করি। বাস্তবতা হলো, দুঃখ-দুর্দশা, রোগ-শোক ইত্যাদি অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রীতিকর অবস্থা যেমন পরীক্ষা তেমনি সুখ-শান্তি, সম্পদ-প্রাচুর্য, আরাম-আয়েশ, স্বস্তি-সুস্থতা ইত্যাদি কাক্সিক্ষত ও প্রীতিকর অবস্থাও পরীক্ষার বিষয়। মহান আল্লাহ কোরআন মাজিদে এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি মন্দ ও ভালো দিয়ে তোমাদের পরীক্ষা করি।’ -সুরা আম্বিয়া : ৩৫

বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় হজরত আবদুর রহমান ইবনে যায়েদ ইবনে আসলাম (রহ.) বলেন, ‘তোমরা যেসব বিষয় পছন্দ করো (যেমন, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, স্বস্তি-সুস্থতা, ধন-ঐশ্বর্য ইত্যাদি) এবং যা কিছু অপছন্দ করো (যেমন দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন, রোগ-শোক ইত্যাদি) সবই পরীক্ষা। উদ্দেশ্য যাচাই করা যে, তোমরা পছন্দ ও কাক্সিক্ষত বিষয়ের শোকর (কৃতজ্ঞতা) করো কি না এবং অপছন্দ ও অনাকাক্সিক্ষত অবস্থায় সবর (ধৈর্য) করো কি না।’ -তাফসিরে তাবারি

বস্তুত কারও জীবন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রাচুর্যে ঘেরা, কেউবা দুঃখ-দুর্দশায় ন্যুব্জ; কিন্তু পরীক্ষার ভেতর আছে সবাই এবং সব অবস্থাই পরীক্ষার অবস্থা। রোগ-শোক, দৈন্য-দুর্দশা যে পরীক্ষা, মানুষ সাধারণত তা বোঝে। তাই এসব অবস্থায় মানুষ সবর করার চেষ্টা করে। একে-অপরকে সবরের নসিহত করে। মানুষের দিল-মন তখন কিছুটা হলেও আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়। এমনকি কাফের-মুশরিকরাও বড় বড় মুসিবতের সময় আল্লাহকে ডাকতে শুরু করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তরঙ্গমালা যখন তাদের আচ্ছন্ন করে মেঘচ্ছায়ার মতো তখন তারা আল্লাহকে ডাকে তার আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে। এরপর তিনি যখন তাদের উদ্ধার করে স্থলে নিয়ে আসেন তখন তাদের কিছুসংখ্যক সরল পথে থাকে। (অবশিষ্ট সবাই আবার শিরকে লিপ্ত হয়) আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করে কেবল এমন লোক, যে ঘোর বিশ্বাসঘাতক, চরম অকৃতজ্ঞ।’ -সুরা লুকমান : ৩২

এর বিপরীত সুখ-শান্তি, ধন-সম্পদ, স্বস্তি-সুস্থতা ইত্যাদি নেয়ামত যে পরীক্ষার বস্তু, সাধারণত আমরা তা বুঝি না। বুঝলেও এসব নেয়ামতের কদর করি না। এর শোকর আদায়ের চেষ্টা করি না। অথচ কোরআন মাজিদ কত চমৎকার শৈলী এবং কত বৈচিত্র্যপূর্ণ পদ্ধতিতে আমাদের নেয়ামত ও প্রাপ্তির পরীক্ষার কথা স্মরণ করিয়েছে! ইরশাদ হয়েছে, ‘ভূপৃষ্ঠে যা কিছু আছে আমি সেগুলোকে তার জন্য শোভাকর বানিয়েছি, মানুষকে এ বিষয়ে পরীক্ষা করার জন্য যে, কে তাদের মধ্যে ভালো কাজ করে।’ -সুরা কাহাফ : ৭

অর্থাৎ পৃথিবীতে যত শোভা ও সৌন্দর্য, আরাম-আয়েশের যত উপকরণ, সবই পরীক্ষার বস্তু। এর মাধ্যমে যাচাই করা হবে কে দুনিয়ার সৌন্দর্যে মাতোয়ারা হয়ে আল্লাহকে ভুলে যায়, আর কে এসব নেয়ামতকে আল্লাহর হুকুম মতো ব্যবহার করে নিজের জন্য আখেরাতের পুঁজি সঞ্চয় করে।

মানুষের প্রতি আল্লাহর যত দান সবই পরীক্ষা। মানুষের বিদ্যা-বুদ্ধি, স্বাস্থ্য পরীক্ষার বস্তু। হাত পা নাক কান চোখ জবান ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরীক্ষার জিনিস। সুখ-শান্তি, পদ-পদবি, অর্থ-সম্পদ, মান-মর্যাদা পরীক্ষার ক্ষেত্র। এমনকি স্বামী ও স্ত্রীও একে অপরের জন্য পরীক্ষার বিষয়।

মোটকথা, মানুষের পুরো জীবন পরীক্ষার। সবসময় এবং সব অবস্থায় মানুষ পরীক্ষারত। ভালো ও বাঞ্ছিত বিষয় যেমন পরীক্ষা, মন্দ ও অবাঞ্ছিত বিষয়ও পরীক্ষা। আর আল্লাহতায়ালা যত নেয়ামত দিয়েছেন সবকিছুর জন্যই মানুষকে জবাবদিহি করতে হবে। হিসাব দিতে হবে, এসব বিষয় কী কাজে, কোন পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয়েছে! কোরআন মাজিদের ঘোষণা, ‘অতঃপর অবশ্যই সেদিন তোমাদের নেয়ামতরাজি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।’ -সুরা তাকাসুর : ৮

যে যত বেশি নেয়ামতের অধিকারী তার দায়িত্ব তত বেশি, তার জবাবদিহি তত কঠিন। তাই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও অর্থ-বিত্তের প্রাচুর্যে উল্লসিত হওয়ার সুযোগ নেই। হজরত আলি (রা.) বলেন, ‘হে আদমের বেটা! তুমি ধনাঢ্যতায় খুশি হয়ো না। দরিদ্রতায় হতাশ হয়ো না। বিপদ-মুসিবতে পেরেশান হয়ো না। এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে উৎফুল্ল (উন্মত্ত) হয়ো না। কেননা স্বর্ণ আগুন দিয়ে পরখ করা হয়।’ -রিসালাতুল মুস্তারশিদীন, পৃ. ৮৫

বরং দুঃখ-কষ্ট ও অপ্রাপ্তির পরীক্ষার চেয়ে সুখ-শান্তি ও প্রাপ্তির পরীক্ষা আরও বেশি কঠিন। বালা-মুসিবতের সময় দিল যতটা আল্লাহমুখী হয়, আরাম-আয়েশের সময় ততটা হয় না। তাই সুখ ও সৌন্দর্য, জ্ঞান ও বুদ্ধি, পদ ও মর্যাদা, স্বাস্থ্য ও স্বস্তি ইত্যাদি নেয়ামতের ব্যাপারে খুব সচেতন থাকতে হবে। নেয়ামত পেয়ে নেয়ামতদাতাকে ভোলা যাবে না। আখেরাত সম্পর্কে উদাসীন হওয়া যাবে না। অন্যথায় নেয়ামতের পরীক্ষায় ব্যর্থ হতে হবে। যে ব্যর্থতার ফলাফল বিনাশ ও ধ্বংস।

লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক

muftianaet@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION