রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০৮:৪৬ পূর্বাহ্ন
নাজমুল আহসান:
হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী নির্বাচনের প্রার্থীদের হলফনামার জমার বিধান বাধ্যতামূলক করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সংস্কৃতি তৈরি করা। তবে এই চর্চা কতটুকু সফল হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই প্রার্থীরা দায়সারা রকমের হলফনামা দাখিল করছেন। কেউ কেউ তথ্য লুকাচ্ছেন, আবার হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী প্রার্থীরা দেখিয়েছেন তার সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতি ও বাজার দরের কোনো সম্পর্ক নেই। এমনটাই জানা যায় প্রার্থীদের হলফনামা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে। এটা যেন শুধু একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে, প্রার্থীরা যে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন তার কোনো যাচাই-বাছাই হয় না। শুধু ছক পূরণ করাটাই যেন সার। বাংলাদেশে যেখানে একটা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও লাখ লাখ টাকার কায়কারবার চলে সেখানে সংসদ নির্বাচনের মতো একটি বৃহত্তর নির্বাচনে প্রার্থীরা কত অল্প সম্পদে নির্বাচন করতে পারেন তা তাদের হলফনামা দেখলে শুধু ধন্দেই পড়তে হয়। বাস্তব অবস্থার সঙ্গে হলফনামায় উল্লিখিত সম্পদের বিবরণী ও আনুমানিক মূল্য বিশ্লেষণ করলে শায়েস্তা খানের আমলের মতো সবকিছু কমমূল্যে পাওয়ার গল্পকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে। এই আনুমানিক মূল্যে যদি তাদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বাজারে পাওয়া যেত অনুমান করা যায় তা কিনতে ই-ভেলির থেকেও বেশি লাইন লেগে যেত। অনেকের আবার নিজের থেকে স্ত্রী সম্পদ বেশি, এতে দোষের কিছু নেই যদি স্বচ্ছতা বজায় থাকে, সম্পদ অর্জনের উৎস পরিষ্কার থাকে। আবার অনেক প্রার্থীর বাৎসরিক আয় কম কিন্তু তারা দামি গাড়িতে চড়েন, বিদেশ ভ্রমণের খরচ চালান এবং এসব খরচ সেই শায়েস্তা খাঁর আমলের খরচের সমতুল্য।
শায়েস্তা খাঁ আমলের গল্প আমাদের প্রায় সবারই জানা। সেই সময় নাকি টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। মুঘল আমলে বাংলা কতটা সমৃদ্ধিশালী ছিল তা বোঝাতে অনেকে শায়েস্তা খানের উদাহরণ দিয়ে থাকেন। টাকায় আট মণ চাল পাওয়ার তথ্য সঠিক হলেও এর সঙ্গে সমৃদ্ধি অর্জনের যুক্তি কতটুকু খাটে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সেই সময় এই ভূখণ্ডের প্রান্তিক মানুষরা মাসে বা বছরে কত টাকা আয় করতে পারত তা নিশ্চয়ই একটি ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের বিষয়। সেই অনুসন্ধান প্রচলিত ঐতিহাসিকরা করেন না, আর অনুসন্ধান না করেই নিজেদের অবস্থানের পক্ষে সুবিধাজনক একটা অনুসিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে থাকেন। তবে সেই অনুসিদ্ধান্তে শাসক গোষ্ঠীর ন্যারেটিভের প্রতিফলন কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। শায়েস্তা খার আমল সম্পর্কে সেই ধোঁয়াশাপূর্ণ বিশ্লেষণ এবং এই সময়ের প্রার্থীদের মধ্যে যারা নিজেদের চারদিকে এক ধরনের কুয়াশাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রাখেন এই দুয়ের উদ্দেশ্য এক না হলেও সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া মোটেও কষ্টকর না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হতে চাচ্ছেন তারা কেন হলফনামার মাধ্যমে জনগণকে ধোঁকা দিতে চাচ্ছেন। সঠিক তথ্য প্রকাশে তাদের কীসের এত ভয়। আসল তথ্য পেলে জনগণ কি তাদের সন্দেহের চোখে দেখবে? তাহলে সম্পদ আহরণের উপায় স্বচ্ছ না? এগুলো সবই প্রশ্ন হয়তো, তবে এর কোনো সহজ ও সরল উত্তর নেই। আবার প্রশ্নগুলো সবার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য নয়, তবে কারও কারও জন্য প্রযোজ্য হতেও পারে। আর যদি তাই হয় তাহলে হলফনামার উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে ভাববার সুযোগ আছে। আমাদের সংস্কৃতিতে কোনো একটা ভালো পদ্ধতি ও চর্চাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টাটা একদমই নতুন না। আস্তে আস্তে একটা ভালো চর্চাকে নষ্ট করে ফেলতে বিভিন্ন ছলচাতুরী ও দুষ্টবুদ্ধির আশ্রয় নেওয়ার দৃষ্টান্তের অভাব নেই। এরই ধারাবাহিকতায় তথাকথিত বুদ্ধিমানদের পাল্লায় ভালো প্রক্রিয়াগুলো এক সময় হারিয়ে যায়, আসল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুতি হয়। হলফনামার ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে বলে এই পর্যায়ে এসে এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়।
এই দুর্মূল্যের বাজারে প্রার্থীদের শায়েস্তা খানীয় আমলের চর্চা জনগণের একটা বড় অংশের মধ্যে এত সস্তায় এবং অনেকটা বাঁকা পথে একই রকমের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মালিক হওয়ার আকাক্সক্ষা জাগাতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই ধরনের সংস্কৃতিকে কেনই-বা প্রশ্রয় দিচ্ছেন এবং তা জনগণকেই-বা কী বার্তা দিচ্ছেন এ সম্পর্কে বলা মুশকিল। তবে এই প্রক্রিয়ায় জনগণ যাকে নির্বাচিত করছে তার কাছ থেকে তারা কীই-বা প্রত্যাশা করতে পারে, নির্বাচিত হওয়ার পরে তার কাছে সামষ্টিক বা ব্যক্তি কোন স্বার্থটি প্রাধান্য পাবে? তারপরও এই দুর্মূল্যের বাজারে সাধারণ জনগণ শায়েস্তা খানের জমানায় ফিরে যেতে না পারলেও তারা জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে এতটুকু স্বস্তি চায়। চায় একটু ভালোভাবে জীবনযাপন করতে, আর সেটাই যেন তাদের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে নানা ধরনের চাপে। আর সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষমতার অলিন্দে থাকা মানুষজন নিজেদের সম্পদ গোপন করার চেষ্টা করছেন বা নিজেদের অপেক্ষাকৃত কম সম্পদশালী হিসেবে প্রমাণ করতে চাচ্ছেন। বলাবাহুল্য সেটা মোটেও বিনয়ী হওয়ার জায়গা থেকে না বরঞ্চ তথ্য গোপন করার জন্য। তবে সেখানেই হয়তো শেষ না তথ্য গোপনের পেছনে অন্য হেতুও থাকতে পারে।
বলা হচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচনে রাজনীতিবিদদের প্রাধান্য কমে যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা ধীরে ধীরে রাজনীতির পথঘাট দখলে নিয়ে নিচ্ছেন। তাও না হয় মানা যায়, তবে আশঙ্কার যে প্রবণতা হচ্ছে রাজনীতিবিদের অনেকেই ব্যবসায়ী হয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবসার সুবিধার কাজে লাগাচ্ছেন। অর্থ ও রাজনীতি যেন একে অপরের পরিপূরক, একটি ছাড়া যেন আরেকটিতে সাফল্য অর্জন করা যায় না। আর এসবেরই ফলাফলে সমাজের মধ্যে ক্রমবর্ধমান আর্থিক বিভক্তি ও বিভাজন। গত কয়েক দশকে সাধারণ মানুষের আয় বেড়েছে সত্যি, আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবনযাত্রার মানও বেড়েছে তাও অস্বীকার করার উপায় নেই কিন্তু এর পাশাপাশি ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে আয় বৈষম্য বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতির চাপে পড়ে দরিদ্রদের বাড়তি আয় দিয়েও মৌলিক চাহিদা মেটাতেই হিমশিম। সেখানে আর শায়েস্তা খানের আমল খাটছে না। শায়েস্তা খানের আমলটা প্রযোজ্য শুধু সম্পদশালীদের ক্ষেত্রে দরিদ্রদের জন্য না, খেটে খাওয়া মানুষের জন্য না।
নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রাধান রাজনৈতিক দলগুলো জাতির সামনে বিভিন্ন ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি তবে এসব প্রতিশ্রুতির বেশিরভাগই থাকে উন্নয়ন সম্পর্কিত। তবে এবারের প্রতিশ্রুতিতে বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের ইশতেহারে শাসন প্রক্রিয়ার জবাবদিহি ও ন্যায্যতার প্রতিশ্রুতির কিছুটা প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। যার একটি সরাসরি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্পর্কিত অন্যটি আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা সম্পর্কিত এতসব প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে এই সম্পদশালীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি যাতে এবং যে প্রক্রিয়ায় এই সম্পদ অর্জন করা হয়েছে তার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। আর এর মধ্য দিয়েই সুযোগসন্ধানীদের হাত থেকে অর্থনীতি ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া মুক্ত হতে পারে। তাহলেই তা সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের পথে একটি মাইলফলক তৈরি হতে পরে এবং এর সুফল কিছুটা হলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাবে। শায়েস্তা খানের আমলকে একটি আদর্শ হিসেবে ধরে নিলেও এই সময়ে তা আর ফিরিয়ে আনা হয়তো সম্ভব না। তবে সম্পদের ন্যায্য ও সুষম বণ্টনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের সত্যিকার অর্থে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন নিশ্চিত করা সম্ভব। তবে তার জন্য শুধু উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি বা অবকাঠামো নির্মাণ যথেষ্ট নয়, এর জন্য প্রয়োজন শাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন, স্বচ্ছতার ও সর্বোপরি সব পর্যায়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করা। সেটাই হয়তো সেই কাক্সিক্ষত চর্চা সম্ভবত আমরা যাকে আইনের শাসন বলে থাকি তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আমাদের বহুল প্রত্যাশিত নতুন সরকার এই প্রত্যাশিত আইনের শাসন বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে পারবে কি, যা নিয়ে নতুন প্রজন্ম একটি সমৃদ্ধ জাতির স্বপ্ন দেখতে পারবে, সেই প্রশ্নই এখন উঁকি দিচ্ছে মনের কোণে বারে বারে।
লেখক : উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
psmiraz@yahoo.com
ভয়েস/আআ