রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০৫:২১ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতার দায়িত্ব অনেক

জাকির হোসেন:
জনগণের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়েছে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের কথা ইতিহাসে ‘স্বর্ণাক্ষরে’ লেখা থাকবে। এত দলের মধ্যে দু-চারটা দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে কিছু আসে যায় না। জনগণ অংশগ্রহণ করেছে, সেটাই সব থেকে বড়। এ নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণ অংশগ্রহণ করেছে। ১২০ বছরের বয়স্ক বুড়ো মানুষও ভোট দিতে গেছে। এর থেকে বড় কথা আর কী হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বিগত দিনে কিছু ইতিহাস তুলে ধরেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর দেশের পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ’৭৫-এর পর নির্বাচন মানে কী আমি দেখেছি? নির্বাচন মানে ছিল নামেই নির্বাচন। ভোট চুরি, ভোট ডাকাতি, ভোটার লিস্টের মিথ্যা নাম দেওয়া আর সংবিধান লঙ্ঘন করে, সেনা আইন লঙ্ঘন করে যারা ক্ষমতায় ছিল, তাদের পকেট থেকে রাজনৈতিক দল বের হতো।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া ভোটারবিহীন নির্বাচন করেছিল, শত চেষ্টা করেও ভোটার আনতে পারে নাই। তারপর সিল মেরে, বাক্স ভরে সবকিছু করেছিল, সারা জায়গায় আর্মি নামিয়েছিল, পুলিশ নামিয়েছিল, সব নামিয়েছিল। তারপরও সে নির্বাচন হয়নি এবং জনগণ মেনে নেয়নি। ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হয়েছিল, ৩০ মার্চ খালেদা জিয়া ভোটচুরির অপরাধ নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০৬ সালের নির্বাচনেও এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার দিয়ে এ নির্বাচন করতে চেয়েছিল। সেই নির্বাচনও টিকাতে পারে নাই। ইমারজেন্সি ডিক্লেয়ার হয়, খালেদা জিয়াও যায়, তার নির্বাচনও যায়। এদের তাও শিক্ষা হয় না, লজ্জা হয় না।’ প্রধানমন্ত্রী যে কথাগুলো বলেছেন তা সবই ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস এগুলো। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও আগামীতে ইতিহাসের পাতায় থাকবে। হয়তো বহু বছর পর কেউ এই ইতিহাসের উদাহরণ টানবেন। বলবেন, একসময় বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন, যিনি সর্বোচ্চবার প্রধানমন্ত্রী থেকেছেন। দেশের অনেক উন্নয়ন করেছেন। তিনি পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল করেছেন। অনেক বড় বড় মেগা প্রকল্পের রূপকার ছিলেন শেখ হাসিনা। যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে। তার হাত ধরেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে রূপ নিয়েছিল। বিশ্বের সফল রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে তিনি একজন।

৫ বার সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে একটানা ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। তাকে বলা হয় মালয়েশিয়ার উন্নতির কারিগর। আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের একটি আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় মালয়েশিয়াকে। এটি সম্ভব হয়েছে মাহাথিরের দক্ষ শাসক দ্বারা একটানা রাষ্ট্র পরিচালনার ফলে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অন্যতম উন্নত, সফল ও সমৃদ্ধিশালী দেশ সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরের উন্নতির মহানায়ক বলা হয় লি কুয়ান ইউকে। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করা লি কুয়ান, টানা ৩০ বছর দেশ পরিচালনা করেন। এই তিন দশকে ভগ্ন অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে তুলে লি কুয়ান ইউ সিঙ্গাপুরকে এশিয়ার অন্যতম ধনী দেশে পরিণত করেন। এ ছাড়া কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন ৩৮ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় ছিলেন। এ সময় কম্বোডিয়ার অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নতি সাধন করে। শিল্প, ব্যবসা আর কর্মসংস্থানের অমিত সম্ভাবনার দেশে পরিণত হয়েছে কম্বোডিয়া। ব্যবসা, বাণিজ্য, আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে দিনে দিনে এশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে দেশটি। আর এসব সম্ভব হয়েছে একটি সরকারের পক্ষে একাধারে কাজ করে যাওয়ার ফলে।

আধুনিক গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলা হয় যুক্তরাজ্যকে। যুক্তরাজ্যের একজন জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার। তিনি ১১ বছরের জন্য যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া যুক্তরাজ্যের ৯ জন প্রধানমন্ত্রী ১০ বছরের বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন। রবার্ট ওয়ালপোলই দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে, উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোন চারটি পৃথক মেয়াদে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশেও দীর্ঘসময়ের জন্য একজন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেছেন। এশিয়া ও পৃথিবীর প্রথম নারী সরকারপ্রধান ছিলেন শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েক। তিন মেয়াদে তিনি মোট ১৮ বছর শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গেল ৩ মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে বিগত ১৫ বছর ধরে দেশ পরিচালনা করছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা চতুর্থ দফায় রাষ্ট্র পরিচালনার ম্যান্ডেট পেয়েছেন। এর আগের এক মেয়াদে অর্থাৎ ৫ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে দুই দফায় ২০ বছর তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে পৃথিবীর দীর্ঘমেয়াদি নারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটাও একটি ইতিহাস। অথচ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ সময় তিনি দেশে ফিরতে পারেননি। আর দেশে ফিরে রাজনীতির মাঠে এসে তিনি হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি।

একটি সরকার টানা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকলে দেশের অর্থনীতিতে অনেক ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা তার জন্য সহজ হয়। কিন্তু সরকার পরিবর্তন হলে নতুন সরকারের নীতির কারণে বিগত সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। অতীতে আমরা এমন উদাহরণ অনেক দেখেছি। এতে অপচয় হয় অর্থ ও সময়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় অর্থনীতি। এ ছাড়া প্রতিটি দলের রাষ্ট্র পরিচালনা, উন্নয়ন কৌশল, অর্থনৈতিক পলিসি, পররাষ্ট্রনীতি, কূটনৈতিক সক্ষমতা ভিন্ন। একেকটি দল তার নিজ নিয়মে দেশ পরিচালনা করে। সরকার পরিবর্তনের ফলে দেশ পরিচালনার নীতিতেও পরিবর্তন আসে। যা দেশের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে। আর অদক্ষ সরকারের কবলে পড়লে দেশে দেখা দেয় নানা বিশৃঙ্খলা। ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ক্ষমতা পালাবদলের করণে পদ্মা সেতুর কাজ বিলম্বিত হয়। তবে ২০০৮ সালে আবার ক্ষতায় এসে নানা ঝড় ঝাপটা ডিঙিয়ে শেখ হাসিনা সরকার পদ্মাসেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মাসেতু উদ্বোধন হয়। এটা সম্ভব হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারণে।

বাংলাদেশে গত তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন তা সত্যি অভাবনীয়। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আবার ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ওই সময় ভারতের সঙ্গে ৩০ বছরমেয়াদি গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, ভূমিহীন, দুস্থ মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি চালু হয় ওই সময়ে। এর মধ্যে দুস্থ মহিলা ও বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্কদের জন্য শান্তিনিবাস, আশ্রয়হীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প উল্লেখযোগ্য। ২০১৪ সালের মেয়াদে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ, ভারতের সঙ্গে ৬৮ বছরের সীমানা বিরোধের অবসান, পদ্মাসেতুর বাস্তবায়ন শুরু। সদ্যবিদায়ী মেয়াদে আওয়ামী লীগের সরকার দেশের টাকায় পদ্মাসেতু নির্মাণ ও চালু করে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ ছাড়া সরকারের সাফল্যের তালিকায় যোগ হয়েছে মেট্রোরেল, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল। এ ছাড়া বিগত মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলেছেন। এবার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়েছেন শেখ হাসিনা। আর এটা বাস্তবায়িত হলে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ইতিহাসে নক্ষত্র হয়ে থাকবেন তার পিতার মতোই।

একটি সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে দেশে দুর্নীতি বাড়ে। বিরোধী দলগুলোর ওপর অত্যাচ্যার-নির্যাতনের মাত্রা বাড়ে। বিরোধী দলগুলো দুর্বল হয়ে যায়। সরকার একপাক্ষিকভাবে দেশ পরিচালনা করে। দেশের জন্য মন্দ সিদ্ধান্ত নিলেও তাতে বাধা দেওয়ার কেউ থাকে না। দেশে দুর্নীতির মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে তাই বিরোধী দলের উপস্থিতি কাম্য। বাধাহীনভাবে দেশ পরিচালনা দেশ গণতান্ত্রিকভাবে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এক দল অনেকদিন ক্ষমতায় থাকলে সে দলটিই রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। এতে একটি দলেরই নেতাকর্মী তৈরি হয়। একসময় ঘরে ঘরে নেতা তৈরি হয়ে জনগণের ওপর কর্তৃত্বের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। এ কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পঞ্চম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একটা গুরুদায়িত্ব থেকে যায় গণতান্ত্রিক ধারা অক্ষুণœ রাখার ক্ষেত্রে। দুর্নীতি, অর্থ পাচার রোধ করার ব্যবস্থা নেওয়া, দলের নেতাকর্মীদের পেশিশক্তি থেকে দেশের সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা, সরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনস্বার্থে কাজ করতে বাধ্য করা, সরকারি দপ্তরসহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম দূর করা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সাধারণ মানুষ এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের হেনস্তা যাতে না হতে হয় তার ব্যবস্থা করা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সবার সামনে রেখে এগিয়ে চলা। বিগত ৫ বছরে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। এসব পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য এবারের ৫ বছরে সরকারের উদ্যোগ একান্ত কাম্য। দেশের শিক্ষিত বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ করতে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। মেগা প্রকল্পগুলো থেকে জনগণ যথাযথ সুফল পাচ্ছে কিনা তার মূল্যায়ন নতুন সরকারের থাকা উচিত। সিঙ্গাপুরের উন্নতির মহানায়ক যদি লি কুয়ান ইউকে বলা হয়, মাহাথির মোহাম্মদকে যদি মালয়েশিয়ার উন্নতির কারিগর বলা হয়, তবে আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার কেন শেখ হাসিনাকে বলা যাবে না, এত বছর ক্ষমতায় থাকার পরও?

লেখক: সাংবাদিক

zakpol74@gmail.com

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION