রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০৫:২২ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

সিগন্যাল সার্কাসে জাপা

মোস্তফা কামাল:
নির্বাচনের পরও সার্কাস শোর মতো রাজনৈতিক বিনোদন অব্যাহত রেখেছে জাতীয় পার্টি। তা দলটি গোপন রাখছে না। কখনো মুখ ফসকে, কখনো পরিস্থিতির অনিবার্যতায় জাপা নেতারা নিজেরাই তা ফাঁস করে দেন। দীর্ঘদিনের চর্চাও একটি ব্যাপার। এখন একদিকে বলছেন, সরকারের দিক থেকে বিরোধী দল হওয়ার সিগন্যাল এখনো মেলেনি। আরেকদিকে বিরোধীদলীয় নেতা, উপনেতা, চিফ হুইপের নাম ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়েছে উপরোক্ত ৩ পদে পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদের, কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর নাম। আবার মহাসচিব বলছেন, নৈতিকভাবে জাপাই সংসদে বিরোধী দল। স্বতন্ত্ররা আওয়ামী লীগেরই লোক। আরেক বাক্যে বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে জাতীয় পার্টি আরও ১৫-২০টা সিট বেশি পেত। আওয়ামী লীগের বিপক্ষে প্রতিবাদ করার মতো ক্ষমতা আমাদের (জাপার) নেই, সমানে সমান না হলে প্রতিবাদ করা যায় না। এর বিপরীতে চেয়ারম্যান বলছেন, তারা এবার সত্যিকার বিরোধী দল হবেন। কঠোর প্রতিবাদী হবেন।

আগামী ৩০ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসবে। এই অধিবেশনে জানা যাবে কারা হচ্ছে সংসদে বিরোধী দল। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংসদে অপজিশন কে হবে বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পাওয়া রাজনৈতিক দলই হবে প্রধান বিরোধী দল। স্বতন্ত্ররা স্বতন্ত্রই আছেন। দল যদি বলেন, তাহলে জাতীয় পার্টি। তবে বিরোধী দল হিসেবে জাপাকে স্বীকৃতির বিষয়টি স্পিকারের ওপর নির্ভর করছে।

বিনোদিত হওয়ার মতো আচানক কথা-কাজ সাপ্লাই জাতীয় পার্টির একটি বৈশিষ্ট্য। এক ধরনের পুঁজি বা বিনিয়োগও। জাপায় যার যখন মন যা চায় বলা যায়, করাও যায়। অব্যাহতি দিয়ে দেওয়া যায়। আবার তা তুলে নেওয়াও যায়। এ সৌন্দর্য চর্চার অংশ হিসেবে নির্বাচনের টাকা ভাগাভাগি, টাকা মেরে দেওয়ার মতো কাণ্ডকীর্তি জানান দিতেও তাদের মুখে বাধেনি। বনানীতে জাপা চেয়ারম্যানের কার্যালয় ঘেরাও করে নিম্নমানের আচরণ, মহাসচিবের জাতগুষ্টি, স্বভাব-চরিত্র ফাঁস করাও হয়েছে। সঙ্গে চেয়ারম্যান কাদের, মহাসচিব চুন্নু, কো-চেয়ারম্যান আনিসকে সরকারি বিশেষ কোটায় জিতিয়ে আনাসহ আরও অনেক কিছু। এর জেরে বহিষ্কার বা অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে কয়েকজনকে। জাপায় এটাই বাস্তবতা। পুরোটা সরকার বা বাইরের বাটন বা রিমোর্টে হয় এমন নয়। দলের নেতারা স্বপ্রণোদিত হয়েও তা করেন। করে আসছেন। এতে মাঝেমধ্যে চরম বিভক্তি আসে। পার্টি ভাঙে। এ পর্যন্ত ৬/৭ বার ভেঙেছে। বর্তমানে বিভিন্ন নামে জাতীয় পার্টি আছে এক হালির বেশি, অন্তত ৫টি। আর সংসদে এবার প্রতিনিধিত্ব আছে মাত্র একটির। নেতাদের পাশাপাশি দলটির কর্মীরাও এতে অভ্যস্ত । তাদের কাছে এটি তেমন ঘটনা নয়। ক্ষমতাসীনদের জন্য এটি এক ধরনের সুযোগ। জাপাকে এখন আর নিয়ন্ত্রণ করতে হয় না। এরা নিজেই নিয়ন্ত্রিত ও ব্যবহৃত হতে উদগ্রীব-উতলা হয়ে থাকে। পাস দূরে থাক, ফেল নিয়েই টানাটানির এ পর্যায়ে এসে জাতীয় পার্টির এবার বিরোধী দল হওয়া নিয়েই টানাটানি। আর ঘটনার পরম্পরায় এখন সরকারকেই বিরোধী দল ঠিক করে দিতে হচ্ছে। সরকারে কে আসছে বা থাকছে এবার এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল না। এবার জটিলতা বিরোধী দল নির্ণয় নিয়ে।

সংসদে এবার জাতীয় পার্টির আসন ১১টি। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের পর সবচেয়ে বেশি ৬২টি আসনে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। মিলমিশে মোর্চামোর্চিতে এক হয়ে গেলে তারাই প্রধান বিরোধী দল। আর তাদের একজন হবেন বিরোধীদলীয় নেতা। জাতীয় পার্টির জন্য এটি বড় কষ্টের। হয় স্বতন্ত্রদের দিয়ে, নইলে বিগত কয়েক সংসদের মতো দয়ার হাত বাড়িয়ে জাপাকেই আবার প্রধান বিরোধী দল করে দেওয়ার কাজটা সরকারকেই করে দিতে হবে। সার্কাস বা তামাশা এ পর্যায়ে এসেই ঠেকেছে। সংসদে সরকারের বিরোধিতাকারী দলকে বলা হয় বিরোধী দল। সংখ্যা মুখ্য নয়। কারণ, বিরোধী দল হতে হলে ন্যূনতম কতজন সংসদ সদস্য থাকতে হবে, সেটি আইন বা সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে উল্লেখ নেই। ৩০০ আসনের মধ্যে ন্যূনতম কতগুলো আসন পেলে কোনো দল বিরোধী দলের চেয়ারে বসতে পারবে কিংবা বিরোধীদলীয় নেতা কে হবেন, তার যোগ্যতা কী হবে সে বিষয়েও স্পষ্ট কিছু বলা নেই। তবে অঘোষিতভাবে জাতীয় সংসদে একটি বিধান রয়েছে, সেটি হচ্ছে একটি রাজনৈতিক দলকে ১০ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ অন্তত ৩০টি আসন পেলে বিরোধী দলের মর্যাদা দেওয়া হয়। কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, ‘বিরোধী দলের নেতা অর্থ স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চসংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত ক্ষেত্রমতো দল বা অধিসংঘের নেতা।’

নিকট অতীতে এই ধরনের কোনো উদাহরণ না থাকলেও এরশাদের আমলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তখন জাসদ (রব)-এর উদ্যোগে ‘কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টিস (কপ)’ নামে সম্মিলিত বিরোধী দল গঠন হয়। তারা পেয়েছিল ১৯ আসন। মোর্চা হওয়ার কারণে তারা তখন সংসদ সদস্য হলেও বিরোধী দলের মর্যাদা পাননি। পরে অন্যান্য দলের আরও ১৪ জন সংসদ সদস্য আ স ম আবদুর রবকে নেতা মেনে স্পিকারের কাছে আবেদন করলে স্পিকার তাকে বিরোধী দলের নেতার স্বীকৃতি দেন। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদে বিরোধী দল ছিল না। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের প্রথম সংসদ নির্বাচন ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগই পায় ২৯২টি। সাতটি আসন পায় বিরোধীপক্ষ। একজন প্রার্থী দুর্ঘটনায় নিহত হলে ওই আসনে পরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীই জেতেন।

সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, উপনেতা, চিফ হুইপ বেশ লাভজনক পদ। বেশ সুযোগ-সুবিধা, প্রভাব তাদের অধিকার। প্রিভিলাইসের ধারায় এবার ছন্দপতনের শঙ্কায় এত বছর বোঝাপড়ায় সেই অধিকার ভোগ করা দলটির নেতারা শঙ্কার মধ্যেও আশা ছাড়ছে না। সরকারের বদান্যতায় বিরোধী দল ঠিক হওয়ার পর কী করতে হবে কী বলতে হবে; তা তাদের মতো স্বতন্ত্ররা চাইলেও করতে পারবেন না। কারণ সেই অভিজ্ঞতা আছে কেবল জাতীয় পার্টিরই। সেই কবে থেকে আজ্ঞাবহতা এবং বোঝাপড়ায় এই পারফর্ম করে আসছে জাতীয় পার্টি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি মোটাদাগের ইতিহাস। আর এই ইতিহাসের ইমাম বা কাণ্ডারি জাতীয় পার্টি। অভিজ্ঞতায় ভরপুর থাকার পরও এরইমধ্যে জাতীয় পার্টির মধ্যে নতুন উদ্যমে সেই রিহার্সাল চলছে। কথা-কাজে এদিকে-ওদিকে ঘোর তৈরি করায় বাকিরা তাদের কাছে শিশু। জাপা নেতাদের কাছে এটি কৌশল-চমক। চাতুরী নয়। নেতাদের এই চাতুরী দলটির কর্মীদের কাছেও গর্বের বিষয়।

রংপুর গিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী পরাজিত প্রার্থী তৃতীয় লিঙ্গের আনোয়ারা ইসলাম রানীর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে চমক দেখিয়ে এসেছেন জিএম কাদের। তৃতীয় লিঙ্গের পাশে থেকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়ে এসেছেন। আবার বলেছেন, বিরোধী দল হওয়ার সিগন্যাল এখনো পাননি। পেলে এবার সত্যিকার বিরোধী দল হবেন। আগে সত্যিকার বিরোধী দল ছিলেন না, ফেক বা ডামি বিরোধী দল ছিলেন তাও বলেননি। ভাঁওতাবাজির জন্য দুঃখ প্রকাশের মতো কিছুও করেননি। চমক বা চাতুরীতে জিএম কাদেরও কম যান না। দলে বাঘা বাঘা নেতাদের ঘোল-গোল দুটোই খাইয়ে দিচ্ছেন। ক্ষেত্রবিশেষে বড় ভাই সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদকেও হারিয়ে ছাড়েন বলে কথা আছে জাতীয় পার্টিতে। রাজনীতির মানুষ না হয়েও জিএম কাদের নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন মন্ত্রী। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভাইয়ের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য দেখান জিএম কাদের। এর আগ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির ইনার সার্কেলে তাকে মনে করা হতো আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ। কিন্তু ওই নির্বাচন পাশার দান উল্টে দেয়। আনুগত্য, আদর্শ, রাজনীতি, স্বার্থ কিংবা অন্য কিছু বদলে দেয় রওশন এরশাদ এবং জিএম কাদেরকে। রওশন হঠাৎই ভিড়ে যান ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে। হাল ছাড়েননি জিএম কাদের। দলীয় রাজনীতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে সরকারের সঙ্গে হট লাইন থাকার পরও কাবু হতে থাকেন রওশন এরশাদ। এর মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টির পুরো বাটন এখন জিএম কাদেরের হাতেই।

জাতীয় পার্টিকে এবারও বিরোধী দল করা না করা এখনো সময়ের ব্যাপার। তা করা হোক না হোক; সংসদটিতে এবং রাজনীতিতে সার্কাস যে আরও সম্প্রসারণ হবে তা বলার অপেক্ষা থাকছে না। সব দোষ বা গুণ নন্দঘোষের মতো জাপাকে দিয়ে দেওয়াও অন্যায্য। এবার নির্বাচনের মাঠে ক্ষমতাসীন দল এবং কথিত কিংস পার্টির কয়েক নেতা যেসব কাণ্ডকীর্তি করেছেন, লোক হাসিয়েছেন তারা জিএম কাদের-চুন্নুদের চেয়ে কম যাননি। তাদের কেউ কেউ জিতেছেন, বাকিরা রাজনীতিতে আছেন। সামনে দিনগুলোতে সংসদে-সংসদের বাইরে তাদের ক্রিয়াকর্ম না থেকে পারে না। তাই একটি বিনোদিত সময়ের অপেক্ষা করা যেতেই পারে। জাতীয় রাজনীতির বাইরে স্থানীয় রাজনীতিও আছে। সামনে উপজেলা নির্বাচন। ভিটামিন সি দিয়ে সেখানে কমলালেবুর স্বাদ মেটানো হয়। সংসদ নির্বাচনে না পাওয়ার কিছু উসুল সেখানে আদায়ের চেষ্টা থাকে। এবার উপজেলা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, দলীয় স্বতন্ত্র বা ডামি, জাতীয় পার্টিসহ কিছু দলের একটি হর্স রেসের আভাস এখনই মিলছে। উপজেলা নির্বাচনে পুষিয়ে দেওয়া হবে, সরকার কথা দিয়েছে এমন একটি বার্তা দিয়ে জাতীয় পার্টির নেতাদের বুঝ দিচ্ছেন দলের কিছু নেতা। সরকারি তরফে সত্যিকারে এ ধরনের কোনো আশ্বাস বা ভরসা দেওয়ার তথ্য এখন পর্যন্ত নেই গণমাধ্যমের কাছে।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট

mostofa71@gmail.com

ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশ রূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION