রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০১:৪৬ পূর্বাহ্ন
বদরুল হাসান:
আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম বেড়ে যাচ্ছিল; দু’সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে পাঁচ ছয় টাকা। অনেকেই এর পেছনে স্বার্থান্বেষী মহলের দুরভিসন্ধির আশঙ্কা করছিলেন। প্রতিক্রিয়া হিসেবে সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষকে নড়েচড়ে বসতে দেখা গেছে; খাদ্য মন্ত্রণালয় মিলার, চালের পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের নিয়ে সভা করেছে। মাঠ পর্যায়ে কিছু নির্দেশনা ও বার্তা প্রেরণ করা হয়েছে; অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা ও চাল আমদানিতে শূন্যশুল্ক প্রবর্তনসহ কিছু চাল আমদানিরও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। বিষয়টা নিয়ে পত্রপত্রিকায় বেশ লেখালেখিও শুরু হয়। অনেকের মন্তব্য, এ-বছর চাল আমদানি না করার সিদ্ধান্তটা ছিল ভুল। এখন সেই ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই অভিযোগ কতটা যৌক্তিক, সেটাই আমার এ লেখার প্রতিপাদ্য বিষয়।
দেশে আউশ, আমন ও বোরো এই তিনটা ধানের আবাদ হয়। এখন মোট উৎপাদনে বোরোর হিস্যা ৫৩ শতাংশ, আমনের ভাগ ৩৯ শতাংশের মতো। আমনের জাত, স্বাদ, সংগ্রহকালের শুষ্কতা ও দীর্ঘ সংরক্ষণযোগ্যতার কারণে এ ফসলের বাজারজাতযোগ্যতা ৩৫ শতাংশের মতো। পক্ষান্তরে বোরো সংগ্রহের সময় ঝড়-বৃষ্টি, দৈব-দুর্বিপাক, বন্যা প্রভৃতি বেশি থাকায় কৃষক ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে তা বিক্রি করে দিতে চেষ্টা করে। ফলে ঐ ফসলের বাজারে আগমন ঘটার হার অনেক বেশি; ৫৫ শতাংশের মতো। তবে বর্তমানে আগের এই অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে; এখন বোরোর অনেক জাত আমন মৌসুমে চাষ হচ্ছে, আমন মৌসুমেও সেচের ব্যবহার করা হচ্ছে, লবণাক্ততা-সহিষ্ণু জাত প্রবর্তিত হওয়ায় উপকূল অঞ্চলে আবাদ ও উৎপাদন বেড়ে গেছে; এবার উৎপাদন প্রাক্কলন করা হচ্ছে রেকর্ড ১ কোটি ৭০ লাখ মে.টন। ফলে এক সময় যেখানে এই মৌসুমে সরকারি পর্যায়ে আদৌ ধান-চাল সংগ্রহ হতো না, হলেও তার পরিমাণ থাকতো এক দু’লাখের মধ্যে সীমাবদ্ধ, সেখানে এবার চালের আকারে আমন সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ৮.৩৩ লাখ মে.টন, এখন পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে ৪.৬১ লাখ মে.টন।
বাংলাদেশে পরিসংখ্যানের ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। খাদ্যশস্য উৎপাদনের তথ্য নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মধ্যে সব সময়ই ফারাক থাকে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগও এটার একটা হিসাব দেয়। কারও হিসাবের সঙ্গে কারও মিল পাওয়া যায় না; অন্তত ১৫ থেকে ২০ লাখ টনের গরমিল থাকেই। আবার এই খাদ্যশস্যের ভোগ ও ব্যবহারের হিসাবটা আরও গোলেমেলে; উৎপাদন ও ভোগ-ব্যবহারের পরিসংখ্যান দেখে যে কারও মনে হবে দেশে বুঝি উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য আছে, তারপরও বিগত সাত আট বছর ধরে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বার্ষিক পঞ্চান্ন থেকে ষাট লাখ মে. টন গম আমদানি হয়ে আসছে। মানে দেশে নিশ্চয়ই গমের চাহিদা রয়েছে এবং ভোগ প্রবণতা বাড়ছে, যেটা হিসাবে সাধারণ্যে দৃশ্যমান হচ্ছে না। এই জাতীয় দুর্বল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমদানি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করা সংশ্লিষ্ট নির্বাহী কর্মকর্তাদের জন্য অত্যন্ত দুরূহ। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে কোনো বছর দৈব-দুর্বিপাকে আবাদের ব্যাপক কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলে যে পরিমাণ চাল উৎপাদিত হয়, তা দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট; জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধিজনিত বাড়তি চাহিদা সম্ভবত চালের অধিকতর উৎপাদনশীলতা ও চালের বিকল্প গমের বর্ধিত ব্যবহারের মাধ্যমে পূরণ হয়ে আসছে। শিল্পায়ন, নগরায়ণ, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারার পরিবর্তনের কারণে গমের ভোগ ও আমদানি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এর বিপরীতে স্বাভাবিক বছরগুলোতে চালের আমদানি নেই বললেই চলে।
কৃষি বিজ্ঞানীদের অভিমত, দেশে গম উৎপাদনে কোনো তুলনামূলক সুবিধা নেই; দেশে উৎপাদনও কম, মাত্র ১০/১১ লাখ মে. টন। তবে চালে এ সুবিধা কিছুটা রয়েছে। চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ক্রমে সংকুচিত হয়ে পড়ায় সেই সুবিধা এখন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে ফলন-ফারাক yield-gap) কমিয়ে আনার মধ্যে। রাইস উইকিপিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্বে চালের গড়পড়তা ফলন হেক্টর-প্রতি ৪.৭ মে. টন। ১৯৯৯ সালে চীনের National Hybrid Rice Research and Development Center এক নবধারার ধানচাষ পদ্ধতির মাধ্যমে হেক্টর-প্রতি ১৭ মে.টন ফলনের রেকর্ড করেছে। অথচ দেশে এখন গড় ফলন হেক্টর প্রতি ৩.২৫ মে টন (Bangladesh Rice Journal, Vol. 26, No. 2, December, 2022)। আর এবার আমনে ফলন হিসাব করা হচ্ছে হেক্টর-প্রতি ২.৯৪ মে.টন (DaillyINDUSTRY, December 17, 2023)। সস্তায় সহজ পদ্ধতিতে ফলন বৃদ্ধির উপায় উদ্ভাবনের ওপর নির্ভর করছে জনমানুষের জন্য সুলভ মূল্যে এই প্রধান খাদ্যশস্যটির সরবরাহ নিশ্চিত করা, অন্যথায় পণ্যটির পর্যায় ক্রমিক আক্রা মূল্যের কোনো বিকল্প থাকবে না। তবে এই মুহূর্তে দেশে যে চালের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তার পেছনে রয়েছে মহল বিশেষের ভুঁইফোড় মুনাফা লাভের এক অতৃপ্ত বাসনা।
আমনের কম বাজারজাত যোগ্যতা, বিশ্বের সর্ববৃহৎ চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারতের চাল রপ্তানি সংকোচনের ঘোষণা, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যের কিছুটা ঊর্ধ্বগতি, সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশে চাহিদা মাফিক খাদ্যশস্য আমদানিতে অনিশ্চয়তা নিয়ে আগাম সতর্কতা প্রভৃতি দেশে মজুদদারদের ফটকা কারবারির মাধ্যমে স্বার্থ হাসিলের এক অপূর্ব ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। ফলে তারা সরকারের সংগ্রহ অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে শুরুতেই মাঠে নেমে পড়েন। এদের মধ্যে আছেন বড় বড় ব্যবসায়ী, মিল মালিক, বিশেষ করে স্বয়ংক্রিয় চালকলের মালিক ও বেশ কিছু করপোরেট বিজনেস হাউজ। এদের যেমন আছে পণ্য সংরক্ষণ ক্ষমতা, তেমনি রয়েছে আর্থিক সচ্ছলতা ও ব্যাংকিং সহায়তা। বিপুল সক্ষমতা নিয়ে সীমিত সংখ্যক কুশীলব এখন চালের বাজারে অলিগার্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন; আগের মতো অসংখ্য ক্রেতা ও বিক্রেতা সমৃদ্ধ পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার এখন অনেকটাই অপসৃত। কাজেই এই বাজারকে সঠিক ট্র্যাকে রাখতে হলে প্রয়োজন গতিশীল আধুনিক পরিবীক্ষণ ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং বাজারকে পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক কাঠামোর মধ্যে আনয়ন।
উৎপাদনের হিসাবে যত গরমিলই থাকুক না কেন, চলতি মৌসুমে যে আমনের ভালো ফলন হয়েছে, অন্তত বিগত মৌসুমের চেয়ে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্ব খাদ্য সংস্থাও স্বীকার করেছে যে, এবার আমনের উৎপাদন হয়েছে গড় মানের ওপরে। আমনের অল্প দিন পরেই আসবে গম। তার এক দেড় মাসের মধ্যে কাটা শুরু হবে বোরো ধান। ফলে কোনো কারসাজি ছাড়া এ সময় বাজারে খাদ্যশস্যের সরবরাহ বিঘিœত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এ অবস্থায় চাল আমদানির যে কোনো পরিকল্পনা শুধু ক্ষতিকরই না, আত্মঘাতীও বটে।
প্রথমত, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের মূল্য গমের চেয়ে দ্বিগুণ; এই মুহূর্তে সেদ্ধ চালের সর্বনিম্ন এফওবি মূল্য প্রতি মে.টন ৬০২ থেকে ৬৪১ মার্কিন ডলার,পক্ষান্তরে গমের দাম ২৬২ থেকে ২৯৩ মার্কিন ডলার (International Grains Council, Export Prices)। ফলে চাল আমদানিতে দ্বিগুণেরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় হবে।
দ্বিতীয়ত, এখন চাল আমদানি করা হলে সামনে দেশের অভ্যন্তরে দামে মন্দাভাব দেখা দিতে পারে, যেটা চাষিদের বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করবে। তা না করা হলে দাম চাঙ্গা থাকবে। সামনে বোরো মৌসুম। এসময় চালের দামে তেজি ভাব থাকলে বোরোতে বিনিয়োগ বাড়বে, ফলে উৎপাদন বাড়বে। উপকরণ-নির্ভর বোরো উৎপাদন বাড়াতে ধানচাষকে অবশই লাভজনক করতে হবে এবং চালের দাম উৎপাদন খরচের ওপরে রাখতে হবে।
তৃতীয়ত, চালের আন্তর্জাতিক বাজার খুবই ছোট ও অত্যন্ত সংবেদনশীল; সেখানে মাত্র ৫ থেকে ৫.৫ কোটি টন চাল কেনাবেচা হয়। আবার আমাদের পছন্দের সেদ্ধ চাল সেখানে খুব একটা পাওয়াও যায় না; সেটা অর্ডার দিয়ে আনতে হয়। এই বাজারে নতুন কোনো ক্রেতা প্রবেশ করলেই দাম বেড়ে যায়। কাজেই এই ভঙ্গুর বাজারের ওপর নির্ভর না করে চাষিদের প্রণোদনামূলক মূল্য প্রদান করে অন্তত চালে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করা কি লাভজনক নয়?
চতুর্থত, চাল পরিবহন করতে হয় বস্তাবন্দি অবস্থায়। ফলে চালের হ্যান্ডলিং খরচ ও সময় বেশি প্রয়োজন হয়।
এ অবস্থায় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাল আমদানির চিন্তাটাকে পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাস ও মূল্য বিবেচনায় ব্যাকসিটে রাখতে হবে; আর গম আমদানিতে দিতে হবে অগ্রাধিকার। বর্তমান ডলার সংকটের সময় এই নীতি চর্চার প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি। সমস্যা হলো নানা কারণে বিগত দু’বছর, অর্থাৎ ২০২২ ও ২০২৩ অর্থবছরে দেশে গম আমদানি হয়েছে আগের তুলনায় প্রায় অর্ধেক; যথাক্রমে ২০.৪৫ ও ৩৮.৭৫ লাখ মে.টন মাত্র। অথচ এর আগের পাঁচ বছর দেশে গম আমদানির গড় পরিমাণ ছিল ৫৮ লাখ মে.টনেরও বেশি। শেষ দু’বছর গম আমদানিতে যে ঘাটতি হয়েছে, তার একটা চাপ গিয়ে পড়ার কথা অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর, যেটা দেশের খাদ্যশস্যের বাজারে স্থিতিশীলতার জন্য আদৌ স্বাস্থ্যকর নয়। তবে ভালো খবর হলো এই যে, এ বছর গমের আমদানি বাড়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে; জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি পর্যায় মিলে ২৯ লাখ মে.টন গম আমদানি হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, সরকার এ বছর চাল আমদানি না করে কোনো ভুল করেনি, বরং ভালো করেছে। তবে শেষ দু’বছর নিজস্ব কর্মসূচির জন্য প্রয়োজনীয় গম আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যে তার তৎপরতা সীমাবদ্ধ রেখে ভালো করেনি। দেশে চাল ও গম মিলে যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে, স্থানীয় উৎপাদনের বাইরে সে পরিমাণটা তো সরকারি-বেসরকারি আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতেই হবে। সেখানে বড় প্রশ্নটা হলো পণ্যভিত্তিক অগ্রাধিকার নির্ধারণ। আর গম আমদানিতে বেসরকারি সেক্টর যেহেতু মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে, সেহেতু নাজুক পরিস্থিতিতে এ কাজে তারা সম্যক ভূমিকা পালন করছে কি না, বা করতে পারছে কি না, বাজার মনিটর করার সঙ্গে সঙ্গে সেটাও পরিবীক্ষণ করা এবং প্রয়োজনে ফ্যাসিলিটেটরের ভূমিকা পালন করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব ছিল। বিগত দু’বছরের আমদানি উপাত্ত দেখে মনে হচ্ছে না যে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো এই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে। আশা করব সরকার এ ক্ষেত্রে সময় থাকতে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
লেখক: খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও কলামিস্ট
rulhanpasha@gmail.com
ভয়েস/আআ