রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০১:৪৩ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ঘরে-বাইরে

সন্ধানী:
১৯৬৩ সালে দৈনিক সংবাদের মাধ্যমে শুরু করেন সাংবাদিকতা জীবন। ১৯৬৪ সালে দৈনিক পয়গাম ও আজাদে কাজ করার পর ১৯৬৫ সালে যোগ দেন ইত্তেফাকে। ঘরে-বাইরে শিরোনামে কলাম লিখতেন ‘সন্ধানী’ ছদ্মনামে। ২০১২ সালে ভূষিত হন একুশে পদকে। ছিলেন ইত্তেফাকের উপদেষ্টা সম্পাদক ও বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান। বরেণ্য এই সাংবাদিক ২০১৫ সালের ১৪ জুন মৃত্যুবরণ করেন। অতীতের সঙ্গে অধুনার সংযোগ ঘটানোর উদ্দেশ্যে ছাপা হচ্ছে সন্ধানীর সেই উপসম্পাদকীয়

নাজিমউদ্দিন জোনাকী প্রেক্ষাগৃহের কর্মচারী, অত্যন্ত সদালাপী, বিশ্বস্ত, অমায়িক এবং বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। সকাল ১১টায় চারতলার অফিস কক্ষে বসে সে কাজ করছিল। সামনে ছিল দু-তিনজন সহকারী। এমন সময় তিন-চারটি যুবক সেখানে প্রবেশ করে। কিছু কথা কাটাকাটির পর চপেটাঘাত করে এবং একপর্যায়ে শানিত ছুরি আমূল বক্ষে বিধিয়ে দেয়। নাজিমউদ্দিন ঘটনাস্থলে নিহত হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় সহকর্মীরা হতভম্ব হয়ে পড়েন। একজনের পেপারওয়েট নিক্ষেপে এক দুর্বৃত্ত আহত হয়। এই সূত্র ধরেই পুলিশ চারজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা নিজ অপরাধ স্বীকার করেছে। হত্যা সাধারণত আড়ালে-আবডালে হয়। দস্যু রত্নাকররা বিজন বন-পথে পথচারীদের আক্রমণ করতো। সর্বস্ব কেড়ে নিত। কখনো কখনো হত্যা করতো। প্রাক-স্বাধীনতা যুগ পর্যন্ত মোটামুটি এ ধারাই বহাল ছিল। খুনি নির্জন স্থানে ওত পেতে বসে থাকতো। অথবা রাতের আঁধারে সুযোগ বুঝে খুন করতো। এই খুন-খারাবির মূলে থাকতো প্রধানত বিষয়-সম্পদ ঘটিত বিরোধ ও নারী। সম্পত্তি এবং নারী নিয়েই যুগে যুগে খুন-জখম হয়েছে বেশি। পিতার আমলে সৃষ্ট এ জাতীয় বিরোধ নিয়ে পুত্রের আমলে হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়াও বিরল নয়। কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সেই সঙ্গে খুনির চেহারারও । আগে খুনিরা ছিল পাকা দুর্বৃত্ত। কখনো কখনো পয়সার বিনিময়ে এ কাজ করতো। এখন এসবেরও প্রয়োজন হয় না। তুচ্ছতম কারণেই খুন হয়ে যায়।

নাজিমউদ্দিনের হত্যাকারী বলে কথিত চারজনই বয়সে তরুণ-নবীন। কারো বয়স ত্রিশের বেশি নয়। এই বয়সে পেশিতে যে বল থাকে এরপর জীবিকা নির্বাহ করার জন্য দুষ্কর্মের প্রয়োজন হয় না। ধৃত চারজনের কেউই সেই অর্থে পেশাদার খুনি নয়। অথচ কাজটা করেছে পাকা খুনির মতো। বলা বাহুল্য, এ অবস্থা ব্যতিক্রম নয়। প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা শোনা যাচ্ছে। আরও মর্মান্তিক ব্যাপার যে, যাদের হাতে বই-পত্র শোভা পাওয়ার কথা, তাদেরও একটা ক্ষুদ্র-খন্ড অংশ নানারকম অস্ত্র চালনায় পারদর্শী। বইয়ের পরিবর্তে তাদের হাতে কাটা বন্ধুক, স্টেনগান, পিস্তল। সময় সময় এসব অস্ত্রের যে খেলা পরিলক্ষিত হয়, এতে সমাজ-মানস বিচলিত বোধ না করে পারে না। প্রশ্ন জাগে, সমাজ কোন্ পথে? প্রকাশ্য দিবালোকে চারতলায় অবস্থিত অফিস কক্ষেও যদি জীবন নিরাপদ না হয়, তাহলে জীবনের নিরাপত্তা কোথায় এ প্রশ্নটা আজ প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। আর দিয়েছে বলেই কারণগুলো খোঁজে দেখা দরকার।

বলা নিষ্প্রয়োজন যে, এই দরকারী প্রশ্নে প্রথমেই মনে পড়ে আশা ও নিরাশার বিষয়। রক্তাক্ত পথে অর্জিত স্বাধীনতার পর মানুষ আশা করেছিল অতঃপর জীবনে সুখ না হোক স্বাচ্ছন্দ্য আসবে, শান্তি না হোক স্বস্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু স্বাধীনতার তেরো বছরের কাজ-কর্ম বৃহৎ গণমানুষের আশা এতটুকুও পূর্ণ করতে পারেনি। উত্তর-স্বাধীনতাকাল হতেই শুরু হয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা। জনগণের ভাগ্য উন্নতির নাম করে বিদেশ হতে রাশি রাশি অর্থ ধারদেনা করা হয়। কিন্তু আজব-আজব অর্থনৈতিক দর্শনের ফলে সবকিছু পন্ড হয়ে যায়। শুধু ‘আমরা আর মামারার’ ভাগ্যই প্রসন্ন হয়। বড় অংশটার জীবনে যে তিমির ছিল তা আরও ঘন হয়। মা-বাবার অতি কষ্টের টাকায় পড়াশোনা শেষ করে ছেলেমেয়েরা দেখে তাদের কর্মের সুযোগ নেই। অর্থ-কড়ির অভাবে মেয়ের বিয়ে দিতে পারে না। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। বিনা চিকিৎসায় মানুষ মরে। কর্মক্ষম ছেলে অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘুরে নিষ্ফল হওয়ার পর হতাশায় আক্রান্ত হয়। এই হতাশা কারো জীবন নিষ্পৃহ করে তোলে। সব কিছুর প্রতি সে নিরাসক্ত হয়ে যায়। আবার কারো কারো মধ্যে জন্ম নেয় বেপরোয়া মনোবৃত্তি। সে তখন সমস্ত রীতি-নীতি, ন্যায়-অন্যায় ও মূল্যবোধকে পদদলিত করতে শুরু করে দেয়। ভিড়ে পড়ে বিপথগামীদের মধ্যে। অনুশীলিত হয় পশুপ্রবৃত্তি এবং এভাবেই সে একদিন পরিচিত হয় খুনি হিসেবে।

নাজিমউদ্দিনের খুনের জন্য যারা প্রকৃত দায়ী তাদের শাস্তি হোক, ইহা সকলেরই দাবি। কিন্তু সবকিছু উপর থেকে দেখার এবং প্রলেপ দিয়ে ঘা সারানোর অভ্যাস আমাদের। প্রলেপে ঘা নিশ্চয় সারতে পারে। তবে আবার ঘা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দূর হয় না। সে আশঙ্কা দূর করতে হলে গোড়া ধরে টান দেওয়া উচিত। যে কারণে একটা হাত বই ছেড়ে ছুরি ধরছে সে কারণটা যদি দূর করা না যায়, তাহলে সমস্যা থেকেই যাবে। তাই আমরা মনে করি, সমস্যার গভীরে যাওয়া প্রয়োজন। দেখা উচিত রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা হতে সৃষ্ট হতাশা এর কোনো কারণ কিনা। যদি হয় তাহলে হতাশার কারণসমূহ দূর করতে হবে।

খুন-জখম-রাহাজানির ঘটনা পশ্চিমের উন্নত দেশেও ঘটে। সেখানেও মানুষ খুন হয়, দুর্বৃত্তরা সর্বস্ব কেড়ে নেয়, তবে তা প্রকাশ্য দিবালোকে লোকের ভিড়ের মধ্যে নয়। এত তুচ্ছতম কারণেও নয়। নাজিমউদ্দিনের হত্যাকান্ডের ঘটনাটিকে তাই উপলক্ষ হিসেবে ধরে মূলে যাওয়া প্রয়োজন। নাজিমউদ্দিনের হত্যাকারীরা সপ্তাহখানেক আগে সিনেমার টিকিট চেয়েছিল। প্রচন্ড ভিড় থাকায় নাজিম তা দিতে পারেনি। এ ঘটনা হত্যা করে শোধ নেওয়ার মতো অপরাধ হতে পারে না। পরের দিনও ছবিটি দেখা যেত। কিন্তু সেটুকুও দুর্বৃত্তদের সহ্য হয়নি। কেন হয়নি? কোথা হতে সৃষ্টি হচ্ছে এই ভয়ঙ্কর অসহিষ্ণুতা? এ যদি আমরা খুঁজে বের করতে অসমর্থ হই, তাহলে সমাজে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। দিন দিন আরণ্যিক পরিবেশই অনিবার্য হয়ে উঠবে। এ যদি আমাদের কাম্য না হয় তাহলে এখনই মূলে যাওয়ার চেষ্টা করা উচিত। কারণ, সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। আমরা নিয়ত এগিয়ে যাচ্ছি এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার পথে।

লেখক: হাবিবুর রহমান মিলন দৈনিক ইত্তেফাক ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION