শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ০৯:৪৮ অপরাহ্ন
রাজেকুজ্জামান রতন:
জিনিসপত্রের দামের সঙ্গে যদি আয় না বাড়ে তখন সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানে মানুষ ভাবে, কেনাকাটায় কিছু কাটছাঁট করতে হবে। কিন্তু কোনটা কাটবে আর কোনটা ছাঁটবে তা নিয়ে ভাবনায় পড়ে যায় সীমিত আয়ের মানুষেরা। দামের ওঠানামার সঙ্গে সাধারণভাবেই বলা হয়, চাহিদা ও জোগানের সম্পর্ক আছে। চাহিদা বেশি, জোগান কম তাহলে দাম বাড়বে আর জোগান বেশি, চাহিদা কম তাহলে দাম কমবে এটা তো পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হয়। কিন্তু চাহিদা আছে, জোগানও আছে অথচ দাম বাড়ছেই ক্রমাগত, তখন কী হবে? যদি পাল্লা দিয়ে আয় বাড়ে তাহলে সমস্যা নেই কিন্তু আয় না বাড়লেই নানা সমস্যা। কপালে পড়তে থাকে দুশ্চিন্তার ভাঁজ, চড়তে থাকে মেজাজের পারদ। সমস্যা হলো মেজাজ দেখাবে কার ওপর? যারা দাম বাড়ায় তাদের ক্ষমতা বেশি আর যারা কিনে খায় তাদের ক্ষমতা না থাকার মতোই। ফলে সেই পুরনো পরামর্শ আয় বুঝে ব্যয় কর, খরচের কাটছাঁট কর। কিন্তু কিছু পণ্য ও সেবা আছে যেসবের দাম বাড়লেও তাদের প্রয়োজন কমানো কঠিন। যেমন চাল, আটাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বাড়ি ভাড়া, গাড়ি ভাড়া ইত্যাদি।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে না। তার কারণ তিনটি। প্রথমত, উৎপাদন ও পরিবহন খরচ কমাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দাম কমানো দরকার। সরকার সেটি করবে না। দ্বিতীয়ত, আমদানি বাড়িয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানো দরকার; কিন্তু মার্কিন ডলারের সংকটের কারণে আমদানির জন্য ব্যবসায়ীরা সহজে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। তৃতীয়ত, কিছু কিছু পণ্যে উচ্চহারে শুল্ক-কর রয়েছে। সেখানেও ছাড় দেওয়া সরকারের পক্ষে সহজ নয়। কারণ, সরকার ইতিমধ্যেই রাজস্ব ঘাটতিতে রয়েছে। ফলে জনগণকেই মূল্যবৃদ্ধির বোঝা বহন করতে হবে।
২০২৪ সালের শুরু থেকেই কিছু কিছু পণ্যের দাম বেড়ে চলেছে। টিসিবির হিসাবে ঢাকা বাজারে ৮ জানুয়ারি থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত মোটা চাল, প্যাকেটজাত আটা, ময়দা, মসুর ও মুগ ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ ৪ ধরনের মসলা ও ব্রয়লার মুরগি এই ১৩টি পণ্যের দাম বেড়েছে। কোনো ক্ষেত্রে ২ টাকা, কোনো ক্ষেত্রে ৫০ টাকা। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব বলছে, ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি ঢাকার বাজারে চিনির কেজিপ্রতি দর ছিল ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা। এখন যা ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা। শুধু চিনি নয়; চাল, ডাল, আটা, ভোজ্যতেল, মসলাজাতীয় পণ্য, দুধ, ডিম, মাংস, সাবান, টুথপেস্ট প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি উঠেছে ১০ শতাংশের কাছাকাছিতে। এই হিসাব করা হয় ৭২২টি পণ্যের ওপর ভিত্তি করে, যদি সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য প্রধান ৩৭ থেকে ৪০টি পণ্যের ওপর ভিত্তি করে হিসাব করা হতো তাহলে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে দাঁড়াবে নিশ্চয়ই। যে কারণেই নিম্নবিত্তের কষ্ট আর মধ্যবিত্তের হাঁসফাঁস বেড়েছে। সাধারণ মানুষ কেমন আছেন জানতে চাইলে বলেন, ভালো আছি কিন্তু এই কথাটার মধ্যে মিশে থাকছে প্রয়োজনীয় মিথ্যা এবং অন্যের কাছে ছোট হয়ে যাওয়ার ভয়।
নতুনরূপে আসা পুরনো সরকার বিশেষ কোনো উদ্যোগ না নিলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। কেউ কেউ আবার সরকারের অতীত কাজের মূল্যায়ন করে বলেন, এই সরকারের পক্ষে দাম কমানো কখনোই সম্ভব হবে না। সরকার চাইলে মূল্যবৃদ্ধি, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব ছিল। আমদানি পণ্যের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ডলারের বিনিময় হার একটা বিষয়, কিন্তু ডলারের মূল্যবৃদ্ধির চেয়েও দেশের বাজারে দাম কেন বেশি বেড়েছে এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। এর ফলে অতিরিক্ত দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা করার সুযোগ পাচ্ছেন বড় ব্যবসায়ীরা। গম, ভোজ্য তেল, চিনি, ছোলা, খেজুরসহ বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে এটা হচ্ছে। দেশে মূল্যস্ফীতি বেশি, রিজার্ভ সংকট, ডলার সংকট চলছে। এর অজুহাতে কিছু পণ্যের বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের মানুষ তার সুফল তেমন একটা পাচ্ছে না।
অজুহাতসর্বস্ব সরকার আর জবাবদিহিহীন সংসদ যে কত সংকট বাড়িয়ে তোলে তার অন্যতম উদাহরণ এখন বাংলাদেশ। নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে ২০২০ সালের প্রথম দিকে। তখন অজুহাত ছিল করোনার এবং বিশ্ববাজারের। কিন্তু তুলনামূলক আলোচনা গুরুত্ব পায়নি। করোনাকালের অবসান হলো কিন্তু কমল না দাম। এরপর যখন ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার শক্তিশালী অজুহাত এলো তখনো তুলনা করা হলো না অন্যান্য দেশ বা বাস্তব পরিস্থিতির। এ সময়ে একদিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমতে থাকল, অন্যদিকে দ্রুতগতিতে আরও বাড়তে থাকে ডলারের দাম। এর প্রভাব পড়ল প্রায় সব আমদানি পণ্যের দামে কিন্তু দেশীয় পণ্যের দাম কেন আকাশচুম্বী হলো তার যুক্তিসংগত উত্তর নেই। এই সময়কালে আবার সরকারও সার, বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেল ও পানির দাম দফায় দফায় বাড়ানোর ফলে দাম বাড়ানোর পক্ষে অজুহাত শক্তিশালী হয়েছে।
নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি অংশীজনদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করবেন। সরবরাহ ব্যবস্থায় যাতে কোনো ধরনের ঘাটতি না থাকে, সেটি নিশ্চিত করাই হবে তার প্রধান কাজ। উৎপাদন ও ভোক্তাপর্যায়ের মধ্যে দামের পার্থক্য যৌক্তিক রাখা, মজুদদারি রোধ, প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবেন তিনি। তিনি আরও বলেছিলেন, তার প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো পবিত্র রমজান মাসে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা। মানুষ শুনেছে কিন্তু আস্থা পায়নি এবং দেখছে রমজানের আগেই কীভাবে দাম বাড়ছে। রোজার সময় সাধারণত ভোজ্য তেল, চিনি, ছোলা, মটর ডাল, মসুর ডাল, পেঁয়াজ ও খেজুরের চাহিদা বেশি থাকে। এসব পণ্যের বেশির ভাগের চাহিদা মেটে আমদানি করে। ব্যবসায়ীদের মতে, রোজায় ভোজ্য তেলের চাহিদা অন্তত সাড়ে তিন লাখ টন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক করছাড় পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সয়াবিন ও পাম তেলে কেজিতে সাত থেকে আট টাকা শুল্ক-কর কমবে। চাল আমদানিতে প্রতি কেজিতে শুল্ক কমবে সাড়ে ২৩ টাকা। এ ছাড়া কার্টনে আনা সাধারণ মানের খেজুরের কেজিতে শুল্ক কমবে ৩৩ টাকা। সবচেয়ে কম, মানে কেজিতে ৭৫ পয়সা শুল্ক কমবে চিনিতে। অতীত অভিজ্ঞতা বলে শুল্ক কমালে ব্যবসায়ীদের মুনাফা বাড়ানোর সুযোগ বাড়ে, কিন্তু বাজারে দাম কমে না।
চালে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবি করা সত্ত্বেও বগুড়া ও কুষ্টিয়ার পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, সেখানকার আড়তে চালের দাম বাড়তি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে চালকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো, মেজর ও হাসকিং মিল মালিক সমিতির কুষ্টিয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জানান, কয়েকদিনে চালের দাম কেজিপ্রতি দুই থেকে আড়াই টাকা বেড়েছে। এর প্রভাব স্বাভাবিকভাবে রাজধানীর বাজারেও পড়েছে। চালের মধ্যে মাঝারি বিআর-২৮ জাতের দাম কেজিতে তিন টাকার মতো বেড়েছে। অন্য চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। সপ্তাহখানেক আগে যে মোটা চালের (স্বর্ণা ও চায়না ইরি) কেজি ৫০-৫২ টাকা ছিল, তা এখন কিনতে হচ্ছে ৫৪-৫৫ টাকায়। মাঝারি মানের চালের (পাইজাম ও বিআর-২৮) কেজি ৫৫-৫৮ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০-৬২ টাকা। আর মিনিকেট ও নাজিরশাইলের মতো সরু চাল ৬২-৭৫ টাকা থেকে বেড়ে ৬৮ থেকে ৮০ টাকা হয়েছে। ইতিমধ্যে তেলের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত পেয়ে গেছেন বিক্রেতারা। প্যাকেটজাত মসলার দামও বাড়তি।
মাঝেমধ্যে একটু খাওয়ার আকাক্সক্ষা থাকলেও গরুর মাংস এখন বিলাসী খাদ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। অনেক বাগ্বিতণ্ডার পর ডিসেম্বর মাসের শুরুতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠকে গরুর মাংসের দাম কেজিপ্রতি ৬৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। বাজারে সেই দামে বিক্রি শুরু হয়েছিল। নির্বাচন শেষ, এখন বাজারে গরুর মাংস ৭০০ টাকা কেজির বেশি দরে বিক্রি শুরু হয়েছে।
প্রতিবছর শীত শুরু হলে মৌসুমি সবজি, পেঁয়াজ, আলুসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম কমে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার দর গত বছরের মতো কমেনি। সে ক্ষেত্রে আলুর পাশাপাশি পেঁয়াজের উদাহরণও সামনে আসছে। গত বছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০ থেকে ৪৫ টাকা। এখন ৮০ থেকে ১০০ টাকা। শীতকাল শেষ হয়ে গেল, কিন্তু শীতের সবজির দাম কমেনি। কারওয়ান বাজারের সবজির আড়তদাররাও বলছেন, সবজির দাম গত বছরের শীতের চেয়ে অনেক বেশি। সব খরচই বেড়ে গেছে। এ কারণে কম দামে বিক্রি করা যাচ্ছে না। এই যে বলা হয় সব খরচ, এই বিষয়টা দেখার কি কারও দায়িত্ব আছে?
নির্বাচনের আগেই সরকার বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল ও পানির দাম সমন্বয়ের (পড়তে হবে দাম বাড়ানোর) ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে তখনকার পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সরকার ভর্তুকির ধারণা থেকে সরে আসতে চায়। শুরুতে বিদ্যুৎ ও পানিতে ভর্তুকি তুলে দেওয়া হবে। এর সহজ অর্থ, দাম বাড়ানো হবে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে নেওয়া ঋণের শর্ত মানতে জ্বালানি তেলের দাম গত সেপ্টেম্বরে বাজারভিত্তিক করার কথা ছিল। সে জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে দাম নির্ধারণের সূত্রও ঠিক করে রেখেছে মন্ত্রণালয়। ভোটের আগে তা কার্যকর হয়নি, এখন তো আর বাঁধা নেই। ফলে দাম বাড়ানোর আর বাকি থাকবে কী? তাহলে সাধারণ মানুষ কী করবে? আয় যেহেতু বাড়ছে না তাহলে একটাই পথ, জীবনের প্রয়োজনের তালিকা ছোট করতে থাক। ক্ষমতাসীনরা বলবেন, বাজারে জিনিস আছে, কেউ না খেয়ে মরছে না আর মানুষ ভাবতে থাকবে প্রয়োজনের তালিকা থেকে কোনটা কাটবে আর কোন প্রয়োজনকে ছেঁটে ফেলবে। বাজার অর্থনীতি যত শক্তিশালী হচ্ছে ততই যেন সাধারণ মানুষের বাজার করার ক্ষমতাই দিচ্ছে কমিয়ে।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক
rratan.spb@gmail.com
ভয়েস/আআ