শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ০৬:৪১ অপরাহ্ন
পাভেল পার্থ:
অধিবর্ষ বলে বহু মানুষ ফেব্রুয়ারির শেষ দিনে, ২৯ তারিখ ৪ বছর পর পর পাবে বলে নানা কিছু ভেবেছিল। হতে পারে শহুরে কিংবা ভোগবাদিতা এটা সেটা কত কিছু আয়োজন ছিল বিরল ফেব্রুয়ারির শেষ দিনে। কিন্তু কেউ ধারণাও করেনি, এমন দিনে পুড়ে অঙ্গার হতে হবে। বেইলি রোডের সাম্প্রতিক অগ্নিকান্ডে নিহত ৪৫ জন, আহত বহু। অনেকের অবস্থাই ঝুঁকিপূর্ণ। যে ভবনে আগুন লাগে সেখানে বোঝাই খাবারের দোকান। আর এসব খাবারের দোকান বোঝাই ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার। বলা হচ্ছে ‘কাচ্চি ভাই’ নামে একটি খাবারের দোকান থেকে আগুন লেগেছে। সম্ভবত এই সেই ‘কাচ্চি ভাই’, ভ্রাম্যমাণ আদালত ঝুঁকিপূর্ণ খাবারের জন্য যাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। প্রচুর মানুষ প্রতিদিন যে দালানে যায়, সেখানে একটিমাত্র সিঁড়ি এবং পুরো দালানে ছাদ ছাড়া কোনো উন্মুক্ত এলাকা নেই। অনেকেই বলছেন, ধোঁয়া এবং অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে বহুজনের মৃত্যু ঘটেছে। এমনকি ভয়ে দালান থেকে লাফিয়ে, হুড়োহুড়ির চাপে, পর্যাপ্ত ফাঁকা জায়গার অভাবে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়েছে। এই ঘটনা আগেও বহুবার ঘটেছে, জনতা জীবনবাজি রেখে জীবন বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে। জীবনঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে ফায়ার সার্ভিস। প্রধানমন্ত্রী সবার চিকিৎসার দায়িত্ব ঘোষণা করেছেন। ঢাকা মেডিকেল নির্ঘুম লড়ছে। কিন্তু কেন বারবার এমন নির্দয় অগ্নিকান্ড ঘটছে? কেন আমরা অগ্নিকান্ডগুলোর সুযোগ করে দিচ্ছি। অঙ্গার করছি বহু সংসার ও সম্ভাবনা?
নিমতলীর রাসায়নিক বোঝাই গুদামঘর, তাজরীন গার্মেন্টস, সেজান জুস কারখানা, বিএম ডিপো থেকে সীমা অক্সিজেন কিংবা বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই। একের পর এক প্রশ্নহীন আগুন। নিমিষেই অঙ্গার টাটকা জীবন। চুরমার সংসার, বিশৃঙ্খল পরিবার। তদন্ত হচ্ছে, বিশেষজ্ঞ কমিটি সুপারিশ করে, মামলা হয়, ক্ষতিপূরণ কিছু দেওয়া হয় কিংবা কিছু ধরপাকড় হয় কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক কিছুই হয় না। তাজরীন, রানা প্লাজা, নিমতলী, সেজান কারখানা, সীতাকুন্ড ডিপো কিংবা বেইলি রোডের বিস্ফোরণে প্রশ্নহীন প্রাণহানি ‘কাঠামোগত হত্যাকান্ড’। এই কাঠামোর কাছে মানুষের জীবনের কোনো দাম নেই। কেবল মুনাফা আর ভোগ এখানে সর্বেসর্বা। বৈশ্বিক নয়াউদারবাদী ব্যবস্থা মূলত এই কাঠামোকে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে বৈধ করে। রাষ্ট্র এই কাঠামোরই অংশ। কেন একটি দালানে এতগুলো খাবারের দোকান থাকে? যেসব দোকান সারাদিন ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করছে তা কেন নিয়মিত দেখভাল হয় না? এসব দালান অনুমতি দেয় কে? এসব কাচ্চি ভাই অনুমতি দেয় কে? দালানের নকশা থেকে শুরু করে দালানে নানাবিধ দোকানের বৈধতা নিশ্চয়ই ইউরেনাস বা মঙ্গল গ্রহ থেকে কেউ দেয় না। রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ দেয়। এসব দালান থেকে নিয়মিত কর, বিল আরও নানা কিসিমের চাঁদা নিয়মিত আদায় হয়। তাহলে বাণিজ্যিক কর্মকা-গুলো চলা এসব দালানের ঝুঁকি নিরূপণ এবং নিয়মিত ঝুঁকি হ্রাসের বিষয়গুলো কেন এতদিনেও প্রতিষ্ঠা হয়নি? অথচ বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দুনিয়ায় চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বড়াই করে। আর সেই দেশের রাজধানীতে একের পর এক অগ্নিকান্ডে সব অঙ্গার হয়ে যায়। পরেরবার যাতে আর অগ্নিকান্ড না ঘটে এর জন্য কোনো প্রস্তুতি বা জবাবদিহিতা কেউ প্রতিষ্ঠা করে না। সর্বব্যাপী অবহেলা আর নিদারুণ অন্যায়ের ভেতরে এই শহরে তাই একের পর এক মানুষ অঙ্গার হয়। অগ্নিকান্ডের পর এর তদন্ত প্রতিবেদন পাবলিক পরিসরে প্রকাশিত হয় না। সমসাময়িককালের অগ্নিকান্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত হতেও আমরা দেখিনি। তাহলে কেন থামবে লাশের অঙ্গার? নিমতলী থেকে বেইলি রোড এই অঙ্গার মিছিল থামাতে হলে, রাষ্ট্রকে জবাবদিহি ও ন্যায্যতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এর আগের অগ্নিকা-গুলো বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায়, প্রাণনাশী সেজান জুস, সীতাকু-ের সীমা অক্সিজেন কিংবা বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই এসব কোম্পানি কিংবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নানা সময়ে রাষ্ট্রের আইনবিরোধী কাজের জন্য জরিমানা করা হয়েছিল। জনগণের প্রাণ ও স্বাস্থ্যের প্রতি তারা দায়বদ্ধ ছিল না, তাদের পণ্য ও ব্যবসায় জীবননাশী ছিল। প্রমাণ হওয়ার পরও তারা কিন্তু একেকটি হত্যাকান্ডের (কাঠামোর ভাষায় দুর্ঘটনা) পর নির্বিকার ছাড় পেয়েছে এবং সব মৃত্যুর দাগ মুছে আবারও মুনাফার জন্য মরিয়া হয়েছে। ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে আমরাও এসব বাণিজ্যের ভেতর কোনো লাশের পোড়া গন্ধ পাইনি। কোনো কাতার থেকেই কোনো প্রতিরোধ নেই, প্রশ্ন নেই, প্রত্যয় নেই। তাই নিমতলীর পর বেইলি রোড অঙ্গার হয়ে যায়। কিন্তু আমরা কী এবারও সক্রিয় ও তৎপর হবো না? দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তির আওতায় আনব না? ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার-পরিজনের পাশে ক্ষুব্ধ ভালোবাসা নিয়ে দাঁড়াব না? নাকি অপেক্ষা করব আরেকটি কোনো সড়কে আবারও কোনো অগ্নিকান্ড ও লাশের মিছিলের। ‘বেইলি রোড ট্র্যাজেডিকে’ সামনে রেখে চলতি আলাপখানি গত দশ-চৌদ্দ বছরের নির্দয় কিছু অগ্নিকান্ড আবার স্মরণ করিয়ে দিতে চায়। এটি কেবল একটি দোকান বা দালানের ‘নিছক দুর্ঘটনা’ নয়। কাঠামোগত এই নিদারুণ হত্যাকান্ড প্রতিরোধে আমাদের সর্বস্তরের গণজাগরণ জরুরি, একজন নাগরিক হিসেবে কোনো দোকান বা দালানকে দায়বদ্ধ করার অঙ্গীকার কিন্তু আমাদেরও করা জরুরি।
নিমতলী ট্র্যাজেডি ২০১০ : পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীতে অগ্নিবিস্ফোরণ ঘটে ২০১০ সালের ৩ জুন। আগুনে নিহত হয় ১২৪ জন মানুষ। এলাকার দালান ও দোকান বোঝাই ছিল বিপজ্জনক দাহ্য রাসায়নিক। ৫ জুন রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষিত হয় এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সে সময় ইংল্যান্ড সফরে ছিল। তারা নিহতদের স্মরণে কালো আর্মব্যান্ড পরে খেলায় অংশ নেয়। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, রাসায়নিকের ধোঁয়ার কারণেই বেশির ভাগ মৃত্যু ঘটেছে। নিমতলী অগ্নিকান্ডের পর বিশেষজ্ঞ কমিটি ১৭টি সুপারিশ পেশ করেছিল, যার অন্যতম ছিল আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থের গুদাম সরিয়ে নেওয়া। কিন্তু সেই সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। ঢাকার আবাসিক এলাকায় প্রায় অনেক দালানের নিচেই নানা রাসায়নিক, দাহ্য পদার্থ, যন্ত্রপাতি মজুদ করে গুদামঘর বানিয়েছেন বাড়ির মালিক। হরহামেশা গণমাধ্যমে এসব খবর প্রকাশিত হয়।
তাজরীন ফ্যাশনস, ২০১২ : ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানায় আগুন লেগে ১১৭ জন গার্মেন্টস শ্রমিকের মৃত্যু হয়। দুইশর বেশি আহত হয়। ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশ শোক দিবস পালন করে। পোশাক কারখানায় এত বড় অগ্নিকান্ডের পর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় এসব কারখানার মূল ক্রেতা করপোরেট কোম্পানিরা কারখানার নিরাপত্তার জন্য অগ্নিনির্বাপণে অর্থ লগ্নি করতে চায় না। বিশেষ করে বিশ্বের বৃহৎ করপোরেট ওয়ালমার্ট দেশীয় পোশাক কারখানায় অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টিকে আমল দেয়নি।
টাম্পাকো ফয়েলস, ২০১৬ : ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় বিস্ফোরণ ও ভবন ধসে ৩৫ জন নিহত হয়। ১২ সেপ্টেম্বর টঙ্গী থানায় হত্যা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে দুটি মামলা দায়ের করা হয়।
প্রাইম প্লাস্টিক, ২০১৯ : ঢাকার কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় ‘প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের’ কারখানায় ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর অগ্নিকান্ডে ২১ জন নিহত হয়। এর আগেও ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল এবং ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর এই কারখানায় আগুন লাগে।
চুড়িহাট্টা, ২০১৯ : পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে রাসায়নিক বোঝাই এক ভবন বিস্ফোরিত হয় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে। দাহ্য রাসায়নিকের কারণে আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান ৬৭ জন, দগ্ধ আরও ৪ জন হাসপাতালে মারা যান। ২০১৯ সালেই বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে ২৬ জন মারা যান।
সেজান জুস, ২০২১ : ৭ জুলাই ২০২১ রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপে অবস্থিত ‘হাসেম ফুড বেভারেজ কোম্পানির’ ছয়তলা কারখানাটিতে আগুন লাগে। কর্তৃপক্ষ দরজা তালা দিয়ে দেয়। পুড়ে মারা যায় ৫২ জন শ্রমিক। কারখানাটি কোম্পানির জনপ্রিয় পণ্য ‘সেজান জুস’ কারখানা নামে পরিচিত।
সীমা অক্সিজেন, ২০২৩ : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কদমরসুল (কেশবপুর) এলাকায় ‘সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেডের’ প্ল্যান্টে ৪ মার্চ ২০২৩ তারিখে ঘটে আবার বিপজ্জনক বিস্ফোরণ। ঘটনায় নিহত ছয় এবং আহত শতাধিক। এর আগে একই সালের ৪ জুন বিস্ফোরিত হয়েছিল সীতাকুন্ড। বিএম ডিপোর হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বিস্ফোরণের নিদারুণ ক্ষত ও দাগ বিষাক্ত করেছিল বিশাল এলাকা।
আসুন দায়বদ্ধ হই : কারখানা না হয়েও ছাদের দরজা লাগানো ছিল বলে আবাসিক ভবনেও আগুন লেগে মৃত্যু ঘটে। ঢাকার জাপান গার্ডেন সিটির ৬নং ভবনের ১১ তলায় আগুন লাগে ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে। ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাতে সক্ষম হন। ছাদের দরজা বন্ধ ছিল, সিঁড়িতে দমবন্ধ হয়ে এক পরিবারের সাতজন মারা যান। ২০২০ সালের নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বায়তুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণ ঘটে ৩৪ জন মারা যান এবং ২০২১ সালের আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানশনে রাসায়নিক গুদামে আগুন লেগে ৪ জনের মৃত্যু ঘটে। এর ভেতর দেশব্যাপী আরও বহু অগ্নিকান্ডের ঘটনা আছে, যার সঙ্গে জড়িত আছে স্থাপনা নির্মাণে অব্যবস্থাপনা, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা, তদারকি ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি এবং সর্বোপরি জবাবদিহিতার অভাব।
বেইলি রোড ট্র্যাজেডি আমাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চায়, মানুষের জীবন কোনো পরিসংখ্যান নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরিবার, সমাজ ও দেশের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। বেইলি রোড অগ্নিকান্ড থেকে আসুন আমরা শিক্ষা নেই, দায়িত্বশীল হই, লাশের অঙ্গার মিছিল থামাতে দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি বিকশিত করি। প্রমাণ হওয়ার পরও তারা কিন্তু একেকটি হত্যাকান্ডের (কাঠামোর ভাষায় দুর্ঘটনা) পর নির্বিকার ছাড় পেয়েছে এবং সব মৃত্যুর দাগ মুছে আবারও মুনাফার জন্য মরিয়া হয়েছে। ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে আমরাও এসব বাণিজ্যের ভেতর কোনো লাশের পোড়া গন্ধ পাইনি। কোনো কাতার থেকেই কোনো প্রতিরোধ নেই, প্রশ্ন নেই, প্রত্যয় নেই।
লেখক: গবেষক ও লেখক
animistbangla@gmailcom
ভয়েস/আআ