শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ১১:০৪ অপরাহ্ন
ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
করোনা মহামারির অবসানের পর সুস্থির হওয়ার পরিবর্তে বিশ্ব যেন আরও টালমাটাল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্বব্যাপী যখন অস্থিরতা, তাতে নতুন রসদ জুগিয়েছে মধ্যপ্রাচ্য সংকট। গত কয়েক মাসে ইরান-ইসরায়েল পরস্পরের ওপর দুই দফা প্রতিশোধমূলক হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলি নৃশংসতায় এক বছরের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের গাজা রীতিমতো বধ্যভূমি। লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়াতেও চলছে ইসরায়েলের হামলা। মিয়ানমারে চলছে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ, রাখাইন থেকে বাংলাদেশে নতুন করে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়ার নতুন ‘ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ নির্মাণের তৎপরতায় পশ্চিমাদের সঙ্গে চলছে টানাপড়েন। এসব দ্বন্দ্ব সংঘাত এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিশ্বজুড়ে দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি বাড়তির দিকে।
এমন প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রে আজ মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, যে দেশটি চাইলে সংঘাত কমিয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত বলে মনে করা হয়। এ নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট দলের কমলা হ্যারিস এবং রিপাবলিকান দলের ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন নির্বাচনের ইতিহাসে দ্বিতীয় নারী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী কমলা উদার গণতান্ত্রিক ও সহনশীল হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছেন। অন্যদিকে ট্রাম্প এবার তার প্রথম মেয়াদের চেয়েও আগ্রাসী হিসেবে ধরা দিয়েছেন। ফলে ব্যক্তির জয়-পরাজয় ছাপিয়ে বিশ্বে শান্তি আসবে নাকি সংঘাত আরও বাড়বে- এমন প্রশ্নই বিশ্লেষকদের কাছে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি ও সর্ববৃহৎ সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্রটির নির্বাচনের সম্ভাব্য ফল নিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা ইতোমধ্যে দুই ভাগে বিভক্ত। একটি অংশ দেখছেন শান্তির সম্ভাবনা, অন্য অংশটি আশঙ্কা করছেন সংঘাত বৃদ্ধির। যদি ট্রাম্প জয়ী হন, তাহলে ন্যাটো, চীন, মধ্যপ্রাচ্য এমনকি তেল-গ্যাস আমদানির বৈশ্বিক প্রভাব কিছুটা হলেও নেতিবাচকতার দিকে যাবে। আবার কমলার জয়ের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতা কমার সম্ভাবনা দেখছেন না অনেকেই। তারপরও কমলা জয়ী হলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে কিছুটা হলেও সমঝোতার সুযোগ দেখছেন। দুই প্রার্থীর জয়-পরাজয়ের বৈশ্বিক প্রভাব সম্পর্কে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের দ্বিধাবিভক্তি মূলত কয়েকটি বিষয়ে। প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গেই অর্থনীতি, চলমান সংঘাত ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির সম্পর্ক নিবিড়। কে ক্ষমতায় আসবে তার ওপর নির্ভর করছে বিশ্বের ভবিষ্যৎও।
একদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনা থেকে গুটিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন, অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটরা বৈশ্বিক সম্পর্কোন্নয়নের বড় এজেন্ডাকে গুরুত্ব দিয়েই প্রচারকাজ চালিয়েছে। হোয়াইট হাউসের রেসে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস ভোটারদের দীর্ঘদিন ধরেই জানিয়ে আসছেন শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যোগ্য প্রতিনিধিকেই বাছাই করুন। দীর্ঘদিনের প্রচার ও নানা শঙ্কা-উদ্বেগের খবরে ভোটাররাও ক্লান্ত। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছে গণতন্ত্রের চেয়ে মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ এবং যাপিত জীবনের মানোন্নয়নের বিষয়টি প্রথম থেকেই পেয়েছে বাড়তি গুরুত্ব।
ন্যাটোর জন্য দুর্ভাবনা, সঙ্গে ইউক্রেন:
বিশ্বের ক্ষমতাধর সামরিক শক্তিগুলোর জোট ন্যাটো এবারের নির্বাচনে গভীর মনোযোগ রেখে চলেছে। কারণ কমলা হ্যারিস যদি জয়ী হন, তাহলে ন্যাটোর সঙ্গে সহযোগিতা আরও বাড়বে বলে আগেই আশ্বাস দিয়েছেন। বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে রাশিয়ার শীতল সম্পর্ক তাই কমলাকেও মুখোমুখি হয়ে সামলাতে হবে। সম্প্রতি রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সংঘাত বাড়তে পারে। তিনি যে বাইডেন প্রশাসনকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ট্রাম্পের ক্ষেত্রে হিসাবটি ব্যতিক্রম। ট্রাম্প ইতোমধ্যে দেশের অর্থনীতির ওপর বাড়তি কর কমানোর জন্য বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক সামরিক সহায়তা কমানোর বিষয়টিও। তা ছাড়া পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের একধরনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ইউক্রেনকে উদ্বেগে রেখেছে। ট্রাম্প যদিও বলেছেন, শপথের আগেই তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করবেন। এক্ষেত্রে তিনি বহু আগে থেকেই ইউক্রেনকে বাড়তি সামরিক সহায়তা বন্ধের আলোচনা করেছিলেন। এমনকি ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে ন্যাটো জোটে অর্থায়ন কমিয়ে দেবেন বলে জানিয়েছেন। তাই ন্যাটো যে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কিছুটা হলেও কম পাবে, তার প্রভাব পড়তে পারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে। কিন্তু পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্কের নিরিখে অনেকে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ট্রাম্পের উদ্যোগ নেওয়ার বাড়তি সুযোগ দেখছেন। কিন্তু ন্যাটো জোটের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্স বা তথ্য আদান-প্রদানবিষয়ক সহযোগিতা কমিয়ে দেওয়ার বিষয়টি ন্যাটোর জন্য অন্তত চিন্তার বিষয়।
মধ্যপ্রাচ্যের দোদুল্যমান ভাগ্য
এবারের নির্বাচনে যে-ই জয়ী হোক না কেন, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত এখনও দোদুল্যমান। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল এই মুহূর্তে গাজা, লেবানন ও ইয়েমেন ফ্রন্টে সংঘাত বাধিয়ে রেখেছে। সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে আঞ্চলিক যুদ্ধ বাধার উত্তেজনাও তৈরি করেছে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে বাইডেনের প্রস্তাব মুখ থুবড়ে যাওয়ার পর আরব-মার্কিন সমর্থকরা ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন বাড়িয়েছে। বাইডেন প্রশাসন সম্প্রতি গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থেকেও সফল হতে পারেনি। এই চাপ কমলার ওপরও পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা করেও সফলতা না পাওয়ায় কমলার ওপর চাপ বেশিই। যদিও কমলা জানিয়েছেন, তিনি গাজায় হত্যার পক্ষে নন। কিন্তু ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি থেকেও সরবেন না। তার এই বক্তব্যের ফলে অনেকেই ধারণা করছেন, কমলার প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সমাধানে বড় কোনো প্রভাব রাখতে পারবে না। তবে ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশন্সের জুলিয়েন বার্নস ড্যাসি জানিয়েছেন, ‘এমন একসময়ে কমলা চলে এসেছেন যে তিনি ক্ষমতায় এলে ইসরায়েলের ওপর চাপ প্রয়োগ করে যুদ্ধবিরতি আদায় করতে পারবেন।’ কিন্তু এই বিশ্লেষকের মতে, কমলা যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে কেমন সিদ্ধান্ত নেবেন, তার ওপরই নির্ভর করবে মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ।
অন্যদিকে ট্রাম্প বরাবরই ইসরায়েলের বড় সমর্থক। তার নির্বাচনী প্রচারে তিনি জানিয়েছিলেনওÑ যে ইহুদিরা কমলাকে ভোট দেবেন তারা ইসরায়েল রাষ্ট্রকে গুডবাই জানিয়ে দিতে পারেন। ট্রাম্প অফিসে থাকার সময় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে পশ্চিম জেরুজালেমে নিয়ে আসেন ২০১৮ সালে। তার এহেন সিদ্ধান্ত ওই সময়ের জন্য অনেক সাহসী অবশ্যই। কারণ অনেক ইউরোপীয় রাষ্ট্রও এমনটি ভাবতে পারেনি। দখলকৃত এলাকায় দূতাবাস নিয়ে যাওয়ার মধ্যেই বোঝা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের ক্ষেত্রে ট্রাম্প ইসরায়েলকেই সহযোগিতা করবেন। তবে নির্বাচনী প্রচারের মাঝেই ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে সতর্ক করেছেন। জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ পিটার লিন্টল জানান, ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে কয়েক দিন আগে প্রোপাগান্ডা যুদ্ধে হারার জন্য কঠোর সমালোচনা করেছেন। এই যুদ্ধ ট্রাম্পের জন্য থিতু হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। তিনি ইসরায়েলকে সমর্থন দিলেও আগ্রাসী নেতানিয়াহুর ওপর চাপ প্রয়োগ করে যুদ্ধ থামাতেও পারেন। তবে ইরানের প্রসঙ্গে ট্রাম্পের যে বক্তব্য তাতে সংঘাতে উৎসাহ দেওয়ার বিষয়টিও এড়ানোর নয়।
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জন্য দুশ্চিন্তা
বিশ্বের নানা প্রান্তে গৃহযুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে অভিবাসীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই প্রাথমিক লক্ষ্য। সুদান ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ট্রাম্পের অভিবাসনবিরোধী ভাবনা অনেক ক্ষেত্রেই অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইডেন প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে অনেক দেশের শিক্ষার্থীরা আসেন। বাইডেন তাদের ওপর বাড়তি কর না চাপিয়ে বরং তাদের অর্থায়ন ও ঋণদানের আলাদা সুবিধা দিয়েছিলেন। কমলা হ্যারিস ক্ষমতায় এলে এ বিষয়কে আরেকটু সমন্বয়ের চেষ্টা করবেন। সীমান্তে আইনের কড়াকড়ির পাশাপাশি অভিবাসন আশ্রয়কেন্দ্র গড়ার বিষয়টিকেও আধুনিকায়ন করবেন কমলা। গোটা বিশ্বের অভিবাসন সমস্যার ক্ষেত্রে এমনটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ট্রাম্প এ সুবিধা সম্ভবত সরিয়ে দেবেন। এ ছাড়া কেউ একজন নাগরিকত্ব পাওয়ার পর তার গোটা পরিবারকে স্থায়ী করার সুযোগও হয়তো হারাবে। ট্রাম্প দেশটির ভেতরে থাকা অনেক অভিবাসীকে গণহারে দেশছাড়া করার ঘোষণা দেওয়ার পর অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ওপরও সৃষ্টি হয়েছে সমস্যা। তাদের চাপ পশ্চিমা অন্য কোনো দেশে পড়তে পারে ভেবে ইউরোপও চিন্তিত। বিশেষত তার প্রজেক্ট ২০২৫ এমনিতেই দেশের ভেতরে থাকা অভিবাসীদের গণহারে বের করে দেওয়ার রোডম্যাপ। সেখানে বাইরে থেকে যাওয়া তো আরও অসম্ভব। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সরবরাহ ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের একধরনের প্রভাব রয়েছে। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য আমদানিপণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা বলেছেন। এ ছাড়া চীনা পণ্যে সয়লাব যুক্তরাষ্ট্রের বাজার নিয়েও তিনি চিন্তিত। এক্ষেত্রে চীনা পণ্যের ওপর ৬০-২০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা অনেক আগেই তিনি দিয়েছেন। যদি এমনটি হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে নামতে পারে চীন। আর এই বাণিজ্যযুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব গোটা বিশ্বের মূল্যস্ফীতিতে ব্যাপক আকার ধারণ করবে। বিশেষত ডলারের বিনিময়মূল্য বেড়ে যাওয়ার ফলে অনেক দেশের জন্যই মূল্যস্ফীতি বড় আকার ধারণ করতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতি গবেষক ডেভিড ফ্রেজার। ট্রাম্পের শুল্কারোপ ইউরোপের অটোমোবাইল খাতেও বড় প্রভাব ফেলবে। কমলার ক্ষেত্রে অবশ্য সে শঙ্কা কম। যদিও বাইডেন প্রশাসন শুল্ক আরোপের একটি ড্রাফট সম্প্রতি করেছে, তারপরও ট্রাম্পের সময়ে বাণিজ্যিক যুদ্ধ বাধার শঙ্কা কমলার শাসনে নেই বলা যায়।
সূত্র : ইউএসএ টুডে, সিএনএন, ইউরো নিউজ