বৃহস্পতিবার, ১০ Jul ২০২৫, ০৭:২৫ অপরাহ্ন
মুফতি শাকির হুসাইন:
ভারতের ইতিহাসে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযান ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিবর্তনের দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে এই অভিযানের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলমানদের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠিত হয়, যার প্রভাব পরবর্তী এক হাজার বছরের ইতিহাসে দৃঢ়ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। মুহাম্মদ বিন কাসিম কেবল একজন বীর সেনা নায়ক ছিলেন না, বরং ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, ন্যায়পরায়ণ ও মানবিক গুণে গুণান্বিত এক শাসক। তার নেতৃত্বেই মুসলিম বাহিনী ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম সফল সামরিক অভিযান পরিচালনা করে এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে ইসলামের প্রতি আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করে।
তৎকালীন ভারত আরব বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রক্ষা করলেও রাজনৈতিকভাবে দ্বন্দ্বে জড়ায়নি। তবে সিন্ধু অঞ্চলে মুসলিম বণিকদের জাহাজ লুণ্ঠনের ঘটনা এবং রাজা দাহিরের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনোভাব নতুন করে সংঘাতের সূত্রপাত ঘটায়। এই উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে উমাইয়া খিলাফতের পক্ষ থেকে একের পর এক অভিযান চালানো হয়, যার চূড়ান্ত সফলতা আসে মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে।
এর আগে হজরত ওমর (রা.)-এর সময়ে মুসলিম সেনাদল মাকরান উপকূল পর্যন্ত পৌঁছে। কিন্তু হজরত ওমর (রা.) দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে সেনা প্রত্যাহার করে নেন। এরপর হজরত মুয়াবিয়া (রা.) আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ইতিপূর্বে ভারতের সঙ্গে আরবের কোনো বিরোধ ছিল না। প্রথম বিরোধ দেখা দেয় ৭০৮ সালে, যখন মুসলমানদের একটি জাহাজ বহর সিন্ধুর দেবল বন্দরের কাছে জলদস্যু কর্র্তৃক লুণ্ঠিত হয় এবং জাহাজ বহরের যাত্রী ও সম্পদ অপহৃত হয়। এ বহরে ছিল ৮টি জাহাজ। জাহাজগুলোতে ছিল সিংহলের রাজার জন্য প্রেরিত খলিফা ওয়ালিদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উপঢৌকন। ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বিষয়টি অবগত হয়ে সিন্ধুর রাজা দাহিরকে পত্রের মাধ্যমে কৈফিয়ত তলব করেন এবং অপহৃত সবকিছু ফেরত দেওয়ার দাবি জানান। রাজা দাহির হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পত্রের ঔদ্ধত্যপূর্ণ জবাব দেন।
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিকের অনুমতি নিয়ে রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে পরপর তিনটি সামরিক অভিযান চালান। প্রথম দুটি অভিযান চালান পর্যায়ক্রমে উবায়দুল্লাহ ও বুদাইলের নেতৃত্বে। এ দুটি অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে ৭১২ সালে পুনরায় সামরিক অভিযান চালানো হয়। মুহাম্মদ বিন কাসিম জুলাইয়ের ২ তারিখে সিন্ধু বিজয় করেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৬ হাজার। সংখ্যায় কম হলেও সৈন্যরা ছিল দক্ষ, অভিজ্ঞ, সাহসী ও বিচক্ষণ। তা ছাড়া অভিযানে ভারতীয় জাঠ ও মেঠ সম্প্রদায় মুসলমানদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে। তারাও ছিল বলিষ্ঠ ও সাহসী। তারা রাজার দ্বারা অত্যাচারিত ও নিগৃহীত ছিল। মুহাম্মদ বিন কাসিম একে একে দেবল, মেরুন, সেহোরান, ব্রাহ্মণাবাদ, আলোর, মুলতান প্রভৃতি জয় করেন। এই প্রথমবারের মতো ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা মুসলমানদের অধিকারে আসে।
সিন্ধু অভিযানের মুসলিম সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রকৃত নাম ইমদাদ উদ্দিন মুহাম্মদ। তার পিতার নাম আল কাসিম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আল হাকাম। মায়ের নাম হাবিবা আল উজমা। শৈশবেই তিনি পিতাকে হারান। সংসারের হাল ধরেন তার মা। তিনি একজন শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত মহিলা ছিলেন। তিনি পুত্রকে নৈতিক ও চারিত্রিক প্রশিক্ষণ দেন। তার লেখাপড়ার যথাযথ বন্দোবস্ত করেন। ছোট থেকেই মুহাম্মদ বিন কাসিম সমরশাস্ত্রে আগ্রহী ছিলেন। ঘোড়ায় চড়া, তলোয়ার চালানো ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। পুত্রের এ আগ্রহ বুঝে মা তাকে সমরশাস্ত্রে প্রশিক্ষিত করার সিদ্ধান্ত নেন। তাই তিনি তাকে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে পাঠিয়ে দেন। হাজ্জাজ তখন উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের একজন সেনাপতি ছিলেন। সম্পর্কে তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমের আপন চাচা হতেন। তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রকে খুবই আদর ও স্নেহ করতেন। হাজ্জাজ দূরদর্শী ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, যথাযথ প্রশিক্ষণ ও উপযুক্ত সহায়তা পেলে কালক্রমে মুহাম্মদ বিন কাসিম একজন বড় যোদ্ধা হবেন। তাই তিনি প্রতিটি যুদ্ধে তাকে সঙ্গে রাখতেন। ফলে সমরশাস্ত্রের প্রতিটি দিক মুহাম্মদ বিন কাসিম হাতে-কলমে আয়ত্ত করার সুযোগ পান। একপর্যায়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইরাকের গভর্নর নিযুক্ত হন। মুহাম্মদ বিন কাসিম যথারীতি তার সঙ্গেই থাকেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের বয়স যখন মাত্র ষোল কিংবা সতেরো বছর তখনই সম্মুখ সমরে তিনি নিজেকে একজন বীর যোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করেন। তিনি চিন্তার ক্ষেত্রে স্বচ্ছ, ভাষার ক্ষেত্রে নির্ভীক এবং দৈহিক ও শারীরিক দিক দিয়ে পরিশ্রমী ছিলেন। তিনি বিলাসিতাকে পছন্দ করতেন না। সৈনিক জীবনের জন্য যেসব অভ্যাস ও স্বভাবের দরকার হয়, সেগুলোর সবই ছিল তার মধ্যে। ফৌজের শাসন-শৃঙ্খলা, প্রশিক্ষণ বিন্যাস এবং মূলনীতি সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিফহাল ছিলেন তিনি। আপন ভ্রাতুষ্পুত্রের এমন যোগ্যতায় অত্যন্ত খুশি হন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। তাই ভারতে তৃতীয় বার সামরিক অভিযান চালানোর জন্য তাকে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। আর মুহাম্মদ বিন কাসিম এ অভিযানের নেতৃত্ব দিয়ে সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে নিজেকে একজন বীর সেনাপতি হিসেবে প্রমাণ করেন।
ভারতের কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযান প্রসঙ্গে বলেন, বিধর্মীদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তাদের ধর্মান্তরিত করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। মানুষকে ধর্মান্তর করার লক্ষ্যে মুহাম্মদ বিন কাসিম ভারতে অভিযান চলান, এটা সঠিক নয়। বরং এ অঞ্চলের মানুষ মুসলমানদের আচার-ব্যবহার, সততা, নিষ্ঠা ও উদারতায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। আর সিন্ধু অভিযানের প্রত্যক্ষ কারণ হলো, মুসলমানদের জাহাজ বহর লুণ্ঠিত হওয়া এবং যাত্রী ও সম্পদ অপহৃত হওয়া। এ ছাড়া আরও কয়েকটি কারণ হলো, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ যখন পারস্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেন, তখন রাজা দাহির তার শত্রুদের সাহায্য করেন। দ্বিতীয়ত, হাজ্জাজ বিন ইউসুফের শাসনকালে পারস্যের কিছু বিদ্রোহী ভারতে পালিয়ে এলে রাজা দাহির তাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেন। তৃতীয়ত, মুহাম্মদ বিন কাসিমের আগে যে দুটি সামরিক অভিযান রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে চালানো হয়, তাতে মুসলমানরা পরাজিত হলে যুদ্ধবন্দিদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। বর্ণিত কারণগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের জন্য ভারতে সামরিক অভিযান চালানো অপরিহার্য হয়ে যায়। কারণগুলো থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয়, রাজা দাহিরের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের সমুচিত জবাব হিসেবেই মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুতে সামরিক অভিযান চালান এবং বিজয় লাভ করেন। ভারতের বিজিত অঞ্চলে মুসলমানদের সহনশীল আচরণের কারণে ইসলাম সম্পর্কে স্থানীয়দের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায় এবং তারা ইসলাম গ্রহণে আগ্রহী হয়। ফলে সিন্ধু ও মুলতান অঞ্চলে ইসলামি সমাজের সূচনা হয়। এ ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর অতিরিক্ত করারোপ না করায় তারা মুসলিম বাহিনীর সহযোগীতে পরিণত হয়। মুসলমান শাসক সবার ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। ফলে সবাই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারে।
ভয়েস/আআ