মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:১৭ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ধুমপায়ীর একটি ফুকারে ফুটো হয় আমাদের ফুসফুস

মোঃ নাসির উদ্দিন,ফাইল ছবি

মোঃ নাসির উদ্দিন

ধুমপানে বিষপান- কথাটি সবার জানা। একজন ধুমপায়ী বিষপানে আশেপাশের মানুষের কত ক্ষতি করে তা জানার বিষয়টি অনেকের কাছে অনেক বাকী আছে বৈ-কি। সে কথায় যাবার আগে তামাক দ্রব্যের ব্যবহার বা ধুমপানের পরিনতি-পরিস্থিতির উপর একটি গবেষণার ফলাফল জানা যেতে পারে-

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাত এর গবেষণায় দেখা গেছে যে, ২০০৪ সালে বাংলাদেশে ১০ হাজার কোটি সিগারেটের ষ্টিক ব্যবহৃত হয়েছে আর সিগারেট ব্যবহার জনিত ৮টি রোগে বিশেষতঃ ফুসফুস ক্যান্সারে ব্যয় হয়েছে পাবলিকের ১১ শত কোটি টাকা। টোবাকো কোম্পানীগুলো থেকে সরকার সে বছরে রাজস্ব পেয়েছে ২ শত ৩০ কোটি টাকা। সে হিসাবে স্বাস্থ্য ও জীবন হানীর ক্ষতি বাদ দিলেও আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৯ শত কোটি টাকা। আরও একটি তথ্য থেকে জানা যায় যে, বিড়ি-সিগারেটের ফ্যাক্টরি থেকে মজুরী বাবৎ আয় ৪৫০ কোটি টাকা। অন্যদিকে তামাক চাষে জমি ব্যবহার করার কারণে যে পরিমাণ খাদ্য কম উৎপাদন হয় তার মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা। উপকারের চেয়ে অপকার অঢেল বলে তামাক ও ধুমপান বিরোধী এতো উচ্চারণ ও অনেক আন্দোলন। কিন্তু অপকার এড়াতে আন্দোলন কতটুকু ফলপ্রসূ হয়েছে তা নিয়ে গবেষণা হয়নি বলে জানা যায়। অত্র নিবন্ধকার এ মর্মে আনুষ্ঠানিক গবেষণা পরিচালনা না করলেও তার অনুসন্ধানে যা দৃষ্ট হয়েছে তা এখানে উলে­খ করা যায়।

তিনি স্ত্রীর হার্টের বাইপাস সার্জারী করার জন্য ঢাকার মিরপুরস্থ ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে যান। হাসপাতালের দুয়ারেই একটি ছোট দোকান। দোকানটিতে এক কাপ চা খাওয়ার জন্য বসতে গিয়ে অসহ্য দুর্গন্ধে বসা যায়নি। ৭ জন গ্রাহকের মধ্যে ৫ জনের মুখেই সিগারেট। ট্রাম গাড়ির কয়লার ইঞ্জিনের মতো ধোঁয়া ছাড়ছে। লোকগুলো উঠে যাবার পর গবেষণার উপাত্ত সংগ্রহের সাক্ষাৎকার পদ্ধতির অনুসরণে দোকানীর নিকট থেকে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা গেল। তাতে জানা গেল সিগারেটের গ্রাহক বিশেষতঃ উঠতি বয়সের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আগে যেখানে দৈনিক ২ কার্টুন সিগারেট বিক্রি হতো এখন সে জায়গায় ৩ কার্টুন। বর্ণিত তথ্যাদির আলোকে পাঠক স্বীকার করবেন যে ধুমপান বিরোধী বিদ্যমান আন্দোলন সফল হয়নি। সে সুযোগে টোবাকো কোম্পানিগুলোর সম্পদের পাহাড় আকাশের মেঘ ছুঁয়েছে।

স্বচ্ছ পর্যবেক্ষণে দেখা যাবে যে সিগারেট ও বিড়ির প্যাকেটে সতর্কীকরণ, অতিরিক্ত কর-ভ্যাট আরোপ করা, প্রবন্ধ-নিবন্ধের সাবধানী বক্তব্য, জরিমানাÑ এ সবের মধ্যে অন্তর্নিহিত বোধ করি ক্রটি রয়ে গেছে। গৃহীত ব্যবস্থাগুলোতে ধুমপায়ীদের কেবল সতর্ক করা হয়। সে সতর্কতা নিছক সাদাসিদে বলে তাদের স্বভাব বদলায় না। হযরত ওমর ফারুূক (রাঃ) বলেছিলেনÑ একটি পাহাড় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরানো যতনা কঠিন তার চেয়ে বেশি কঠিন মানুষের স্বভাব আর অভ্যাস বদলানো। এ সুকঠিন কাজটি সহজতর করতে অধুমপায়ীদের অবশ্যই কিছু করণীয় আছে। অধুমপায়ীদের গোড়াতেই বুঝতে হবে যারা সিগারেট টানে তারা সিগারেট খায় না। তারা অন্যদের খাওয়ায়। সিগারেটের টান যেন এ কে ৪৭ রাইফেলের নট টানার মতো। যে টানে তার বুকে গুলি লাগে না, লাগে অন্যের হার্ট আর ফুসফুসে। নাক মুখ থেকে নির্গত বলে তা হয় বমি। তাও আবার বিষের বমি। এ বিষ-বমি শ্বাসের মাধ্যমে অধুমপায়ীদের ফুসফুসে প্রবেশ করে। ধুমপায়ীগনের এক একটি সুখটানে এক একটি বিষাক্ত তীরে অধুমপায়ীদের বুক হয় বিদ্ধ। সে তীর বিঁধে ধুমপায়ীদের বুকে। এভাবে ধুমপায়ীদের চেয়ে অধুমপায়ীগন হন বেশি ক্ষতিগ্রস্থ। নিবন্ধকার যে হাসপাতালের কেবিনে বসে লিখছেন সে হাসপাতালে প্রতি ০৫ জন হৃদরোগীর মধ্যে ০৩জন-ই অধুমপায়ী। ধুমপায়ীর কারণে অধুমপায়ীরা হৃদরোগে হচ্ছে আক্রান্ত।

একজন ধুমপায়ী একজন হিরোইনসেবীর চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকারক। কারণ, হিরোইনসেবী নিজেকে পোড়ায় আর ধুমপায়ী পুড়িয়ে মারে তার চারপাশের সব মানুষকে। এ উপলব্ধিবোধ অধুমপায়ীদের মাঝে সৃষ্ট হলে বাসে, ট্রেনে, লোক সমাগমে যেখানেই হোক তারা সেতারের তারের মত একসঙ্গে সোচ্চার হলে ধুমপায়ী যতই শক্তিশালী হোক সিগারেটে আগুন ধরানোর সাহস বিছুতেই পাবে না। আমি একাই উক্ত প্রতিরোধ কাজে সফল হতে পেরেছি। চট্রগ্রাম থেকে সুবর্ণ ট্রেনে ঢাকা আসছিলাম। ট্রেন ছাড়তেই সামনে-পেছনে ২ জন শিক্ষিত যুবক সিগারেটে আগুন দেয়। সিগারেট না টানতে বিনয় অনুরোধ রাখলাম। তারা আমার অনুরোধ রাখলেন না। আমিও ক্ষান্ত হবার নয়। শেক্সপিয়ার- অঙ্কিত শাইলক চরিত্রের ঘটনা চিত্রের বুদ্ধিতে বলেই ফেললাম- “সিগারেট টানেন ঠিক আছে কিন্তু আপনাদের ধোঁয়া আমার কাছে যেন না আসে”। এখানে সক্রিটিসের ডায়ালগ সিষ্টেমে প্রশ্ন করলাম, “আপনাদের নাক-মুখ দিয়ে যা বের করে দিচ্ছেন, আমাকে খাওয়াচ্ছেন তা কি বমি নয় ? আমার নাক-মুখ থেকে বের হওয়া কিছু আপনারা কি খেতে রাজি আছেন?” তারা বললেন- আপনার বমি খাব? আমার বমি আপনারা খাবেন না তো আপনাদের বমি আমাকে খাওয়াচ্ছেন কেন? এতে তারা নিরুত্তর হয়ে গেলেন। বরং তারা সিগারেটের অবশিষ্টাংশ জানালা দিয়ে ফেলে দিলেন। খানিক্ষণ ভেবে শান্ত হয়ে একজন বললেন- “অনেক সময় স্ত্রীকে পাশে বসিয়ে, শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে অনেকে সিগারেট টানে। বললাম- তাতে কী যে ক্ষতি তার চিত্র হাসপাতালে দেখে আসলাম। হার্টের সার্জারী ওয়ার্ডে প্রতি ৫ জন রোগীর মধ্যে ০১ জন শিশু দেখা গেছে। তাদের বয়স দেড় থেকে তের বছরের মধ্যে। তারা তারপরও অধিকাংশের মত বললেন- বিড়ি সিগারেটের জন্য দোষী সরকার। সিগারেটের ফ্যাক্টরি না রাখলে সব চুকে যেত। আমি বললাম, সরকার দোষী হলে এ ক্ষেত্রে স্বয়ং আল্লাহ দোষী হয়ে পড়েন (যা সঠিক নয়)। বেহেশতে একটি বিশেষ ফল না রাখলে হযরত আদম (আঃ) কে তা খেয়ে বেহেশত ছাড়তে হতো না। আল­াহপাক ফলটি রেখেছেন, আবার খেতে বারন করেছেন। একইভবে সরকার বিড়ি-সিগারেট ফ্যাক্টরি রেখেছে। প্যাকেটের মোড়কে বারণও করেছে। পেলেই যদি খাওয়াটা সঙ্গত হয় আমরা পুটি মাছ খাই, পটকা মাছ খাই না কেন? পানিতে উভয় প্রকারের মাছ মিলে। প্রাপ্তির ফতোয়ায় বিড়ি-সিগারেট যদি খাই পটকা মাছও খেতে হবে। পটকা মাছ খেয়ে মরতে কি কেউ রাজি আছেন? এবারে তাদের সুমতির মতটি এরকমÑ পটকা মাছ খাবনা, বিড়ি সিগারেটও খাব না। নিজে তো নয়, অন্যদেরকেও খেতে বারন করব। ধুমপায়ী ২ জনের সাথে সংলাপের এখানে অবতারনা করার উদ্দেশ্য, যুক্তির বাণে ধুমপায়ীদের যে বদ করা যায় তার জানান দেওয়া।

আমার মনে হয় প্রতিটি জেলার তথ্য অফিস সাধারণের বোধগম্য আঞ্চলিক ভাষায় হাটে বাজারে বিভিন্ন কথায় ও চিত্রে কাছে চেতনা সৃষ্টি করলে, মসজিদের ঈমামগনের মাধ্যমে জুমার দিনে বয়ানের ব্যবস্থা করলে, বয়স্কদের বই ও প্রাথমিক স্তরের পাঠ্য-বইতে ধুমপান বিষয়ক নাটিকার পাঠ রাখলে, “ইত্যাদি” অনুষ্ঠানে নানা-নাতীর ভাষ্যে, টিভিতে ফোক গানের শিল্পীর কথায় এরূপ সর্বোতমুখী স¤প্রচার চালালে কাজের কাজ হতো। আমারা জানাতে পারি একজন গৃহকর্তা ধুমপানে যা খরচ করে তা দিয়ে প্রতিদিন পরিবারে প্রতিটি সদস্যের হাতে ১টি করে আপেল দিতে পারে। দৈনিক ৮০ ক্যালরি পরিমান খাবার বেশি যোগাড় করতে পারে। অধুমপায়ী ও ধুমপায়ী ২টি পরিবারের সুস্থতা ও স্বচ্ছলতার বিপরীত চিত্র দেখানো যেতে পারে। সাথে সাথে তামাক পোড়ানোর চুলি­র ধোঁয়ায় তামাক চাষীর কাঁশি আর সবজী চাষীর মুখে হাসির পাশাপাশি ছবি দেখানো যায়।

বিড়ি-সিগারেট কোম্পানীগুলো ইদানিং দেশের মানুষকে বোকা বানিয়ে ধোকা দেবার কৌশল অবলম্বন করছে। তামাক পোড়ানোর জন্য বনের কাঠ উজাড় করাতে জনরোষ ফুসে উঠলে শুরু করলে তারা এক ফন্দি আঁটে। তারা স্থানীয় কিছু বিশিষ্ট জনকে সাথে নিয়ে লোক দেখানো কয়েকটি বৃক্ষ রোপন করে গণ অসন্তোষকে দমিয়ে রাখতে ছল-চাতুরির আশ্রয় নিয়েছে। ব্রিটিশরা যেমন কৃষকদের দিয়ে নীলের চাষ করতে বাধ্য করেছিল টোবাকো কোম্পানীগুলো অগ্রিম অর্থের দাদন দিয়ে আমাদের কৃষকদেরকে তামাক চাষের ফাঁদে ফেলেছে। এতে কেবল স্বাস্থ্য ও জীবন হানি নয়; বনজ ও খাদ্য সম্পদেও বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। তাই সঙ্গত কারনে প্রতিটি উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে স্বাস্থ্য, বন ও খাদ্য কর্মকর্তা স্থানীয় শিক্ষক, সাংবাদিক ও জনপ্রতিনিধি সমন্বয়ে টাষ্কফোর্স গঠন করে বিশেষ করে অদুমপায়ীদের সমর্থনে তামাক চাষ বন্ধ করে বিড়ি সিগারেটের কাঁচামালের যোগান রোধ করা দরকার। ধুমপায়ীর একটি ফুকারে অধুমপায়ীদের ফুসফুস যে ফুটো হয়ে যায়- সে ধারণা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে পারলে সাফল্য যে সুনিশ্চিত তা সম্পর্কে নির্বোধেরও বোধ থাকার কথা।

১০০ জন মাদকসেবীর ওপর সমীক্ষা চালিয়ে তথ্য পাওয়া গেছে যে তাদের মধ্যে ৯৫ জন প্রথমে ধুমপানে অভ্যস্থ হয়। পরে আসক্ত হয় মাদক সেবনে। ধুমপান যে মানুষকে মাদকে মত্ত করে তা কে না বুঝবে! ধুমপান কেউ না করলে তামাকের চাষ ও সিগারেট ফ্যাক্টরি আপনিতেই বন্ধ হবে। তাই নিজেরা ধুমপান বন্ধ করি, বেশী দেরী হয়ে যাওয়ার আগে।

লেখক : সাবেক পি টি আই সুপার, কলামিষ্ট ও শিক্ষা উন্নয়ন প্রোগ্রামের কনসালটেন্ট।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION