সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১০:১৩ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

মৃত্যুর ফাঁদে জেলিফিশ

মীর মোহাম্মদ আলী:
জেলিফিশ, নামে ‘ফিশ’ হলেও এটি মাছ নয়; ৯০ শতাংশ পানি দিয়ে তৈরি সব মহাসাগরে দেখতে পাওয়া এই সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণীর মস্তিষ্ক, রক্ত বা হাড় বলে কিছুই নেই। এরা পেলাজিক সামুদ্রিক প্রাণী, অর্থাৎ, তারা মোটামুটি জলের উপরিভাগের দিকে বাস করে। এর আকার সাধারণত হয় প্রজাতিভেদে দৈর্ঘ্যে ৫ থেকে ৪০ সেন্টিমিটারের মধ্যে, এমন কিছু আছে যা ২০০ সেন্টিমিটার ব্যাস পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম। প্রজাতিভেদে এই প্রাণীটির জীবনকাল কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক মাস ও বছর পর্যন্ত হতে পারে, এবং এদের দেহাবয়বও ভিন্ন হতে পারে। ধারণা করা হয়, জেলিফিশের আগমন এই পৃথিবীতে ডাইনোসরেরও প্রায় ৫০০ কোটি বছর আগে, ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গেলেও এ প্রাণীটি যুগ যুগ ধরে টিকে আছে।

আমরা সাধারণ যেই জেলিফিশ দেখি তার বৈজ্ঞানিক নাম Aurelia aurita; যেটি চাঁদ জেলিফিশ, চাঁদ জেলি বা সসার জেলি নামেও পরিচিত। কক্সবাজার সৈকতে এরা সাদা নুইন্যা নামে পরিচিত। এছাড়াও বেশি পরিচিত আরও কিছু জেলিফিশের মধ্যে রয়েছে পর্তুগিজ ক্যারাভেল, ক্যাননবল জেলিফিশ, নীল বোতাম ইত্যাদি। স্বচ্ছ দেহ এবং মনোমুগ্ধকর নড়াচড়ার মাধ্যমে জেলিফিশ দীর্ঘকাল ধরে বিজ্ঞানী এবং সমুদ্র সৈকত ভ্রমণকারীদের মুগ্ধ করেছে। জেলিফিশের কিছু প্রজাতি তাদের নিজস্ব আলো তৈরি করতে পারে, যা সমুদ্রের অন্ধকার গভীরতায় একটি মুগ্ধকর রঙিন প্রদর্শনী তৈরি করে।

যদিও জেলিফিশ সূক্ষ্ম মনে হতে পারে, তারা আসলে ভয়ংকর শিকারি। তাঁবু ব্যবহার করে জেলিফিশ তাদের শিকারকে বিষাক্ত স্টিংগার দিয়ে ধরে ফেলে। স্টিংগারগুলো শিকারের মধ্যে বিষ প্রবেশ করায়, এটিকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে এবং জেলিফিশের জন্য এটি খাওয়া সহজ করে তোলে। কিছু প্রজাতির তাঁবু কয়েক মিটার দৈর্ঘ্যে পৌঁছাতে পারে, যা ছোট মাছ থেকে প্লাঙ্কটন পর্যন্ত জেলিফিশের শিকারে পরিণত করে। জেলিফিশ নিজেও শিকারে পরিণত হয়। অনেক প্রজাতির মাছ, সামুদ্রিক কাছিম, এমনকি কিছু পাখি জেলিফিশ খায়।

আমাদের দেশে জেলিফিশকে একপ্রকার অখাদ্য বা ব্যবহার অনুপযোগী সামুদ্রিক প্রাণী হিসেবে দেখা হলেও, বিশ্বে জেলিফিশের ৫ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের বাজার রয়েছে। বিশ্বব্যাপী জেলিফিশের বহুবিধ ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে জেলিফিশ থেকে সার, কীটনাশক, ওষুধ, কসমেটিকস, ডায়াপার, আইসক্রিমের গ্লু ইত্যাদি তৈরি করা। এছাড়াও পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শোভাময় অ্যাকুরিয়াম শিল্প থেকে শুরু করে মহাকাশ গবেষণায় জেলিফিশ ব্যবহার করা হচ্ছে। মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা ১৯৯১ সালে মহাকাশে ২০০০ জেলিফিশ পাঠিয়েছিল, যেই সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজারে। জেলিফিশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে খাদ্য হিসেবে। চীন, জাপান ও কোরিয়ায় বহু বছর ধরে জেলিফিশ জনপ্রিয় খাবার হিসেবে প্রচলিত আছে। সেলেনিয়াম ও কলিন নামক অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মিনারেল ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড জেলিফিশ থেকে পাওয়া যায়।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে এবং এর অন্যতম প্রধান প্রভাব হলো সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি। জলবায়ু পরিবর্তনের এই উষ্ণতর পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্রের পানির অম্লীকরণ, স্রোতের ব্যাপক পরিবর্তন এবং অক্সিজেন হ্রাস সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা যা সামুদ্রিক প্রজাতির বিলুপ্তি বা প্রজাতির বণ্টন সম্পূর্ণভাবে বদলে দিতে পারে। গত ৫০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৬০-এর দশক থেকে সামগ্রিকভাবে সমুদ্রের অক্সিজেনের মাত্রা প্রায় ২% কমে গেছে বলে ধারণা করা হয়। অক্সিজেনের মাত্রা খুবই কম হয়ে গেলে সেসব এলাকায় জীববৈচিত্র্য অনেকটাই কমে যায়। নদী থেকে ক্রমবর্ধমান পুষ্টি উপাদান উপকূলে এসে জমা হচ্ছে, যার ফলে জৈব পদার্থ উৎপাদন ও তলিয়ে যাওয়ার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু উপকূলীয় অঞ্চলে এর ফলে অক্সিজেনের চরম ঘাটতির সৃষ্টি হয়, যে অঞ্চলগুলোকে ‘মৃত অঞ্চল’ (dead zone) হিসেবে অভিহিত করা হয়। পুষ্টি উপাদানের সরবরাহ বাড়ার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের বিভিন্ন স্তরে তাপমাত্রার তারতম্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এই ‘মৃত অঞ্চলগুলো’ সম্প্রসারিত হচ্ছে যা জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের ক্রিয়াকলাপ, যেমন দূষণ এবং অতিরিক্ত মাছ ধরা, জেলিফিশের প্রাচুর্য এবং বিতরণকেও প্রভাবিত করতে পারে; সামুদ্রিক এবং স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের ওপর এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

আমাদের উপকূলের চাঁদ জেলিফিশ প্রজাতিটির সমুদ্র জলে সহনশীল তাপমাত্রা ৬-৩১ ডিগ্রি ও অনুকূল তাপমাত্রা ৯-১৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হলেও কিনারার অংশে তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত বেশি ও সমুদ্রের সার্বিক তাপমাত্রা দিনদিন বেড়েই চলেছে। এজন্য বিগত বছরগুলোত, এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই প্রতি বছর সৈকতে মৃত ভেসে আসা জেলিফিশের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। এছাড়াও, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাগরের পানিতে লবণাক্ততা বেড়েছে, যার ফলে গত বছরের তুলনায় এবার জেলিফিশের মৃত্যুহার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

২০২৪ সালের শুরু থেকেই সাগরে প্রচুর জেলিফিশের উপদ্রবের চিত্র নানাভাবে উঠে এসেছে, যার ফলে জেলেদের সমুদ্রে মাছ ধরা ব্যাহত হচ্ছে। বিবেচনা করা হয় যে জেলিফিশ বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো তাদের শিকারির সংখ্যা কমে যাওয়া (প্রধানত কাছিম)। অর্থাৎ কাছিমের সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে জেলিফিশের সংখ্যাটা বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে অতিরিক্ত মাছ ধরা, নানাবিধ দূষণ এবং সমুদ্রের উষ্ণতার কারণে জেলিফিশও বিপদের মধ্যে রয়েছে। জেলিফিশের প্রধান খাবার যেমন জুপ্ল্যাঙ্কটন, ছোট ক্রাস্টেসিয়ান এবং কিছু মিনোস এগুলো কমে যাওয়া, ক্ষতিকারক শৈবাল বা অ্যালগির বৃদ্ধি (Harmful Algal Blooms – HABs), সামুদ্রিক হিটওয়েভ বা তাপপ্রবাহ, অক্সিজেন হ্রাস, পুষ্টি উপাদানের আধিক্য (ইউট্রোফিকেশন), এবং জল দূষণ এসব কারণেও জেলিফিশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

বাংলাদেশের উপকূলে বিশেষ করে, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়া ও সুন্দরবন সংলগ্ন কুয়াকাটার একাংশ কাছিম প্রজননের উত্তম স্থান। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে কক্সবাজার অংশে আশঙ্কাজনকভাবে কাছিম মারা যাচ্ছে। একদিকে যেমন কাছিমের প্রজনন কমছে, অন্যদিকে বাড়ছে কাছিমের মৃত্যুর মিছিল; আবার বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতির ফলে কাছিম জেলিফিশ খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না, তাই অধিক জেলিফিশও একসময় মৃত্যুর ফাঁদে পতিত হচ্ছে। এছাড়াও জেলিফিশ উপকূলের কাছাকাছি ছোট ছোট মাছ ও মাছের ডিম খাওয়ার জন্য এলেও বালিয়াড়িতে আটকে পড়ে প্রাণ হারায়। উপকূলের জেলেদের জালে আটকা পড়ে বা সাগরে মাছ ধরার ট্রলারের জালে আটকা পড়েও অনেক জেলিফিশের মৃত্যু হচ্ছে এবং পরবর্তী সময়ে সমুদ্র সৈকতে ভেসে আসছে।

লেখক: চেয়ারম্যান, একোয়াকালচার বিভাগ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

mir.ali0077@gmail.com

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION