বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৪৭ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

চিররঞ্জন সরকার

চিররঞ্জন সরকার:

ধনী বা কোটিপতি হওয়ার ইচ্ছা সব মানুষেরই থাকে। সবাই চায় টাকা-পয়সা আয় করে নিজেকে সবার ওপরে তুলে নিতে। তাদের জন্য সুখের কথা হলো, এখন দেশে আইন প্রয়োগের দুর্বলতার মধ্য দিয়ে কিছু ব্যক্তিকে ‘বড়লোক’ হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে! একসময় রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল, ‘এসো গান শিখি’। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট শিল্পী ফেরদৌসী রহমান গল্প-কথা-কৌতুকে বাচ্চাদের গান শেখাতেন। এই অনুষ্ঠান দেখে কতজন শিশু গান শিখেছে, সে তথ্য জানা নেই। তবে কালের বিবর্তনে গানের গুরুত্ব কিছুটা হলেও কমেছে। সেখানে বড়লোকের গুরুত্ব বেড়েছে অনেকগুণ বেশি। টাকার গুরুত্ব অবশ্য সব সময়ই ছিল। তবে টাকা বানানোর কৌশলটা বেশিরভাগ মানুষের জানা ছিল না। এখনকার মানুষ সবাই কোটিপতি হতে চায়। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক হতে চায়। আর টাকা বানানোর জন্য নানা প্রক্রিয়া-পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। তবে দ্রুত টাকা বানানোর সবচেয়ে লাগসই উপায় হচ্ছে লুটপাট করা। যুগের এই চাহিদা বিবেচনা করে এখন প্রতিনিয়ত যেন শেখানো হচ্ছে‘এসো লুটপাট করি’।

বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশেই কিন্তু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক হওয়া সহজ কাজ নয়। অন্য সব দেশে এর জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়। একটু একটু করে, অনেক সাধ্য-সাধনার পর টাকার মালিক হওয়া যায়। ধনী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়। পুঁজিবাদী দেশগুলোতেও পুঁজি গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে। আমেরিকার বিল গেটস, ফোর্ড, কার্নেগি, রকফেলার, জার্মানির ক্রুপস, জাপানের মিৎসুবিশি, মিৎসুই থেকে শুরু করে ভারতের টাটা-বিড়লা পর্যন্ত কেউই ব্যাংক কিংবা শেয়ারবাজারের টাকা মেরে, পারমিটবাজি বা নিছক সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দুই-দশ বছরের মধ্যে নিঃসম্বল অবস্থা থেকে কোটিপতিতে পরিণত হননি। কিন্তু বাংলাদেশে কোটিপতি হওয়ার জন্য তেমন কোনো সাধনা বা পরিশ্রম করতে হয় না; এখানে ‘অলৌকিক’ উপায়ে রাতারাতি কোটিপতি হওয়া যায়। রাষ্ট্র ও সরকার এ ব্যাপারে যথাযথ সহায়তা ও প্রণোদনা প্রদান করে। কিছুসংখ্যক মতলববাজ, কপর্দকহীন, অর্বাচীনকে রাতারাতি কোটিপতিতে রূপান্তরিত করতে আমাদের কোনো জুড়ি নেই। পাকিস্তান আমলে মাত্র ২২টি পরিবারের কোটিপতি হিসেবে খ্যাতি ছিল। ঐ ২২ পরিবারের কোটিপতি হওয়ার পেছনেও অবশ্য রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য ও ভোজবাজি কাজ করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোটিপতি হওয়ার এই ধারা আরও অনেক বেশি বিকশিত হয়েছে। এখন আমাদের দেশে কোটিপতির মোট সংখ্যা কেউ জানে না; তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বাংলাদেশে এখন কোটিপতির সংখ্যা কয়েক লাখে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে অযুত-নিযুত কোটিপতি সৃষ্টির এই যে জাদুকরী ব্যবস্থা, একে কি কোনোভাবে খাটো করে দেখা চলে? ২২ পরিবার থেকে অযুত-নিযুত কোটিপতি পরিবারএটাই হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সবচেয়ে বড় সুফল! পাকিস্তান আমলে এই ২২ পরিবারের ইচ্ছায় দেশ চলত। এরপর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি ছিলেন মাত্র পাঁচজন।

করোনা মহামারীকালে যেখানে সাধারণ মানুষের আয় কমে গেছে, সেখানে দেশে নতুন করে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে গেছে। গত মার্চ থেকে জুন এই তিন মাসে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৪১২ জন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এই বছরের জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৬ হাজার ৩৭ জন। গত মার্চ শেষে এই সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫ জন।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি ছিলেন মাত্র পাঁচজন। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে এই সংখ্যা বেড়ে ৪৭ জনে দাঁড়ায়। ১৯৮০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৮ জনে। এরশাদ সরকারের পতনের সময় ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা ছিল ৯৪৩ জন। ১৯৯৬ সালের জুনে কোটিপতি ছিলেন ২ হাজার ৫৯৪ জন। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ১৬২ জনে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৮৮৭ জনে। ২০০৮ সালে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারী ছিলেন ১৯ হাজার ১৬৩ জন। দেশের কোটি কোটি লোক নিঃস্ব হয়েছে বলেই করোনাকালেও সাড়ে তিন হাজার মানুষ নতুন করে কোটিপতি হয়েছেন। ব্যাংক থেকে লুট করা একটি শ্রেণি কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন। আবার তারাই হয়তো ব্যাংকে টাকা রাখছেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী একবার ‘দরবার-ই-জহুর’ কলামে লিখেছিলেন, সন্তান উৎপাদনের যেমন একটিমাত্র প্রক্রিয়াই রয়েছে, তেমনি কোটিপতি হওয়া যায় একটিমাত্র পন্থাতেইচৌর্যবৃত্তি ও দুর্নীতির মাধ্যমে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সাধারণত আইনের আওতার মধ্যে এদিক-সেদিক অনেক রকমারি করে বড়লোক বা কোটিপতি হতে হয়। আর এখানে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার নিয়ম। রাতে ফাটা স্যান্ডেল, ছেঁড়া জুতা তো সকালেই নতুন বাড়ি, নতুন গাড়ি। এখানে এমনকি ভাঙা সুটকেসওয়ালাও কোটিপতি বনে যায়।

আমাদের দেশের কোটিপতিদের সঙ্গে অন্য দেশের কোটিপতিদের পার্থক্য রয়েছে। অন্য দেশের কোটিপতিরা দেশকে শিল্পায়িত করার ব্যাপারে অবদান রাখেন। দেশের টাকা দেশের ব্যাংকে জমা রাখেন। কিন্তু আমাদের দেশের ফাটকা কোটিপতিরা শিল্পায়নে পুঁজি বিনিয়োগে বড় বেশি আগ্রহ দেখান না। নামকাওয়াস্তে শিল্প-কারখানা দেখিয়ে দেশীয় ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দেন না। ওদিকে তথাকথিত এই শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ‘দুস্থ’ দেখিয়ে আরও টাকা নেওয়ার অথবা ঋণ মওকুফের চেষ্টা চালান। অথবা ঋণখেলাপির ‘অভিজাত ক্লাবে’ নাম লেখান। এখন বাংলাদেশে বড়লোক হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়া। কোনো ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা পরিচালক বা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে খাতির করুন। সরাসরি যদি তা না পারেন, তবে কোনো মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টা কিংবা প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তিকে ধরুন। তার মাধ্যমে কোনো একটা ব্যাংকে যান। একটা বায়বীয় প্রজেক্ট বানান। তারপর একটা বড়োসড়ো লোন নিন। এটা অবশ্যই ১০০ কোটি টাকার ওপরে হতে হবে। সেখান থেকে টেন পার্সেন্ট যারা সহযোগিতা করেছেন, তাদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দিন। কেননা, আপনার এই লোনে তাদের অবদানটাই প্রধান। এরপর নো চিন্তা ডু ফুর্তি। লোনের টাকায় বাড়ি-গাড়ি কিনে আয়েশ করে চলুন। সমাজে আপনি সম্মান পাবেন, নইলে সম্মান কিনে নিতে পারবেন। আর বেশি ঝামেলা হলে কানাডা কিংবা অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমান। কেউ আপনার কিচ্ছু করতে পারবে না। এই প্রক্রিয়ায় বড়লোক হওয়া প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার নামে এক ব্যক্তিকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হচ্ছে। প্রতিষ্ঠান দখল করার জন্য নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলেছেন, শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন, দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে টাকাও সরিয়েছেন। এমনকি দেশের বাইরেও কোম্পানি খুলেছেন। আর এসব কাজে তাকে সব ধরনের সমর্থন ও সহায়তা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনএ দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনেই সবকিছু ঘটেছে। কিন্তু তারা কিছুই বলেননি বা করেননি। ভদ্রলোক প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে এখন পলাতক রয়েছেন। তিনি কানাডায় আছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এই লুটপাটের প্রক্রিয়া চলছে তো চলছেই। ‘লুটপাটের শিক্ষা’ এবং সেই শিক্ষার বাস্তবায়নে কতিপয় বঙ্গসন্তান যে অপরিমেয় ভূমিকা পালন করে চলেছেন, তাতে করে সত্যি গর্ববোধ হয়! কবি যথার্থই বলেছেন, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি!’

লেখক: লেখক ও কলামনিস্ট

chiros234@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION