বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১১:০৪ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বাবরি মসজিদের রায় যে কারণে বিস্ময়কর নয়

সৌমিত্র দস্তিদার:
অযোধ্যার নাম তো এখন সবাই জানেন। উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদ জেলার আওধ বা অযোধ্যার নাম আগেও শোনা ছিল। লখনৌ, আওধ বললেই কেমন মুঘল সংস্কৃতি, খানদানি মুসলিম ঐতিহ্য মনে পড়ে যায়। সত্যজিত রায়ের ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ দেখার পরে পরেই বাঙালি জীবনে ওয়াজিদ আলি শা, কত্থক, ঠুমরি প্রবলভাবে ঢুকে পড়ে। কিন্তু ক’বছর ধরে অযোধ্যা শুধুই হয়ে পড়ছে হিন্দু তীর্থস্থান। রামের জন্মভূমি। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে দীর্ঘ সময় কেটে গেছে। মামলার পর মামলা, কমিশনের পর কমিশন, হাজারও তদন্ত, গরমাগরম বিবৃতি, এসবের শেষ পরিণতি একটাই। একদা ধর্মনিরপেক্ষ ভারত ক্রমেই গণতন্ত্রের যাবতীয় মুখোশ খুলে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ হওয়ার পথে শনৈঃশনৈঃ গতিতে এগিয়ে চলছে। তিন দশক হাজার বাগাড়ম্বরের আড়ালে আটশো সাক্ষী, সাত হাজারের বেশি দলিল, ছবি, ভিডিও টেপ সব খতিয়ে দেখে বাবরি মসজিদ মামলার মাননীয় বিচারপতি বত্রিশ জন মূল অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করে দিয়েছেন। চোখের সামনে ষোড়শ বছরের প্রাচীন, ঐতিহাসিক মসজিদ কারা ভেঙেছিল তা সবাই দেখার এত বছর পর জানা যাচ্ছে কেউ নাকি কিস্যু দেখেনি। গরমাগরম স্লোগান উঠেছিল ‘এক ধাক্কা আউর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো’, ‘ইয়েতো স্রেফ ঝাঁকি হায় মথুরা কাশী বাকি হায়’। তবু কেউ কিছুই করেননি। মসজিদ দিনের আলোয় মাত্র চার ঘণ্টায় মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার পরেও রায় বের হচ্ছে এ নিছক অজানা কিছু দুষ্কৃতকারীর স্বতঃস্ফূর্ত তা-বমাত্র! কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পেছনে কাজ করেনি।

অনেকেই বলবেন যে, একটা মসজিদ ধ্বংস নিয়ে এত শোরগোলেরই-বা কী আছে! অমুক দেশে যখন মন্দির ভাঙা হয়, বা বুদ্ধমূর্তি অথবা পুরনো গির্জা তখন তো এত গেল গেল রব ওঠে না! এর একটা ব্যাখ্যা দেওয়াই যায়। প্রথমত কোনো ধর্মীয় স্থান ভাঙাই অত্যন্ত আপত্তিজনক। যথেষ্ট নিন্দের। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যখন কোথাও অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্থান ভাঙা হয় তার পেছনে থাকে এক ধরনের সংখ্যাগুরুর ঔদ্ধত্য। আধিপত্যবাদী সংস্কৃতি জোর করে অন্যের ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। এবং বার্তা দেওয়া যে, বেশি বাড়াবাড়ি করলেই হাল খারাপ হবে। এই অপরকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি উপমহাদেশে বহু পুরনো। দাঙ্গার ইতিহাসও উপমহাদেশের রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়। কিন্তু বাবরি মসজিদ ধ্বংসের গুরুত্ব বা প্রভাব কখনোই অন্য দেশের সঙ্গে তুলনীয় নয়। অধিকাংশ জায়গায় যা হয়েছে তা কিছুটা সত্যিই স্বতঃস্ফূর্ত ক্রোধের প্রকাশ হয়তো। বড় কোনো নীলনকশা এসব ঘটনার পেছনে বোধহয় থাকে না। বাবরি তা নয়। বাবরি নিছক মসজিদ ভাঙা কিন্তু নয়। বাবরির বদলে অন্য কিছু ধ্বংস হতো। বাবরি মসজিদ ভাঙাই একমাত্র উদ্দেশ্য তাও কিন্তু নয়। ১৯৯১ সালে রামরথ, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস, ২০০২-এর গুজরাট গণহত্যা সব একই নীলনকশার অঙ্গ। দীর্ঘ সময় ধরে আজকের যে প্রবল হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ভারতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তার আনুষ্ঠানিক সূচনাপর্ব বাবরি মসজিদ ধ্বংস।

এই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি কিন্তু বাংলাদেশেও চালান হচ্ছে। কিছুটা সতর্ক হয়ে ভেবেচিন্তেই এ কথাটা বললাম। কারণ যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি আজ ভারতের শাসন ক্ষমতায় তাদের মূল এজেন্ডা অখণ্ড ভারত নির্মাণ। নাগপুরে আরএসএস-এর সদর দপ্তরে যে সাম্রাজ্য বিস্তারের কাক্সিক্ষত মানচিত্রটি ঝোলানো আছে তাতে প্রতিবেশীর নাম আছে কি না তা খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। ‘ক্রস বর্ডার টেররিজম’ বা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে গিয়ে সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে ইদানীং খুব চর্চা হয়। আড়ালে থেকে যায় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের রপ্তানি আখ্যান। এটা না বুঝলে একটা ইস্যু সামনে এলেই শুধু হইচই হবে কিছুদিন। তারপর যে কে সেই হয়ে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যাবে। সামগ্রিক পরিকল্পনা কখনোই সামনে আসবে না। আমরা মাথা ঘামাব না এই অসতর্ক সময় ধর্মীয় রাষ্ট্র নির্মাণের পরিকল্পনায়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তা চলতেই থাকবে।

১৯২৫ সালে আরএসএস-এর জন্মলগ্নেই তার এজেন্ডা দুটি এক. হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণ, দুই. সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে তোলা। ঠিক যেমনটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে হিটলার করেছিলেন। আর্য শ্রেষ্ঠত্বের জয় ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইহুদিদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে দিয়ে। হিন্দুত্ববাদ একটা ডকট্রিন। তত্ত্ব। এই তত্ত্ব জনমনে চারিয়ে দিতে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের পাশাপাশি অন্য সম্প্রদায়কে হীন করা দরকার। এই রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ‘হেজিমনি’ই সংঘ-পরিবারের মতাদর্শ। ফলে বাবরি বা গুজরাট কোনো আলাদা ঘটনা নয়। যে কোনো ফ্যাসিবাদী রাজনীতিই গণতন্ত্রের যাবতীয় মূল নীতিকেই আঘাত হেনে তা ধ্বংস করতে চায়। গণতন্ত্রের সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভ যে বিচার ব্যবস্থা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বাবরি রায়ের পরে। কিন্তু এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে বিচারব্যবস্থা কোনো বিমূর্ত বিষয় যেমন নয়, তেমনি তা নিরপেক্ষ হতেই পারে না।

সমস্যা হচ্ছে এই রায়ের পরপরই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভারতের গণতন্ত্রের প্রতি এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। বস্তুত ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হওয়ার যে আশঙ্কা সংখ্যালঘু মনে জাগছিল তা বাবরি রায়ের পরে আরও গভীর ভাবে আতঙ্কিত করেছে এ দেশের নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়কে। নরেন্দ্র মোদি যেবার প্রথম জিতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার শপথ নিলেন তখনই কেউ কেউ খেয়াল করলেন এই প্রথম শাসক দলের সাংসদদের মধ্যে ঘটনাচক্রে একজনও মুসলিম সদস্য নেই। ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী একটা দেশের পক্ষে যা একটু দৃষ্টিকটু বৈকি। এরপর কখনো স্রেফ গরুর মাংস ফ্রিজে আছে সন্দেহে বা সামান্য অজুহাতে ‘মব লিঞ্চিং’-এ কিংবা দিল্লি দাঙ্গায় বেছে বেছে ‘সিএএ’ ও ‘এনআরসি’বিরোধী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম তরুণদের গ্রেপ্তারও সংখ্যালঘু মনে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। মজা হচ্ছে চোখের সামনে দিল্লি দাঙ্গায় পিস্তল নিয়ে দাপাদাপি করার ঘটনা দেখেও প্রশাসন শাসক-ঘনিষ্ঠদের ধরা তো দূরে থাক, মামুলি এফআইআর করারও প্রয়োজন মনে করেনি।

ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়কে প্রায়ই গাল দেওয়ার মতো করে সবসময় দুটি অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগ দুটি আবার পরস্পরবিরোধী। একটি, তারা যথার্থ ‘দেশপ্রেমিক’ নন ও দ্বিতীয়টি ‘সংখ্যালঘু তোষণ’। এই ‘তোষণ’ এমন যার কোনো স্বীকৃতি এদেশের সরকারি দলিল-দস্তাবেজেই নেই। পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীতে মুসলিম মাত্র তিন শতাংশ। স্কুলছুট থেকে হতদরিদ্র মুসলিম এ দেশে এখনো সর্বাধিক। সংগঠিত শ্রমেও তাদের উপস্থিতি নাম মাত্র। কোর্ট ও হসপিটালে গেলে বোঝা যায় এদেশে প্রকৃত গরিব কারা। খোঁজ নিলেই পিছিয়ে পড়া অংশ চিনতে আপনাকে আলাদা করে কোনো গবেষণা করতে হবে না। ফলে তোষণ শব্দটা যে রাজনৈতিক হাতিয়ার তা নিয়েও কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না। আর দেশপ্রেম!এই বায়বীয় অহেতুক সন্দেহ নিতান্তই এক মানসিক অসুখ যা নিয়ে কোনো আলোচনা চলে না। অদ্ভুতভাবে এই কল্পিত প্রচারে বিভাজনের রাজনীতির মধ্য দিয়ে বহুত্ববাদী ভারত ক্রমে ক্রমেই হিন্দুত্ববাদী হয়ে যাচ্ছে এটা যেকোনো ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের কাছেই দুঃখের ও যন্ত্রণার। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মামলার রায় তাই অন্তত আমার কাছে কোনো বিস্ময়কর ঘটনা নয়।

লেখক : ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা/sdastidar27@gmail.com

সূত্র:দেশ রূপান্তর।

 

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION