বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১১:০৪ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ফাঁসিতে কি ধর্ষণ কমবে

চিররঞ্জন সরকার:
একের পর এক নৃশংস সব নারী ধর্ষণের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সচেতন মানুষ এখন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী মানুষ ধর্ষণকারীদের ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। অনেকে ধর্ষকদের প্রকাশ্যে ফাঁসি অথবা নপুংসক করে দেওয়ার মতো ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তিই প্রাপ্য বলে মনে করেন। ফাঁসির পক্ষে যারা, তাদের মত হচ্ছে ধর্ষণকারীকে ফাঁসি দেওয়া হলে ভবিষ্যতের ধর্ষকদের মনে ভয় ঢুকবে; আর কোনো দুষ্কৃতকারী ভবিষ্যতে ধর্ষণ করার চিন্তাও মাথায় আনবে না। যারা নৃশংস অপরাধ করেছে এবং আইন মোতাবেক সুষ্ঠ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপরাধীর দোষ সাব্যস্ত হয়েছে, তার তো চরম শাস্তিই প্রাপ্য! না হলে সম্ভাব্য অপরাধীরা উৎসাহিত হবে। তার থেকেও বড় কথা, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার কি যথার্থ ন্যায়বিচার পাবে সর্বোচ্চ শাস্তি না হলে? আর রাষ্ট্রকে তো এমন মানুষ নামধারী অপরাধপ্রবণ নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবেই। কারণ সময় বদলে যায়, রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলায়, রাষ্ট্র যদি সমাজকে এদের হাত থেকে মুক্ত না করে, তাহলে অনবধানে আবার এদের ভিড়ে মিশে যাওয়ার আশঙ্কা থাকেই। এই নিকৃষ্টতম আশঙ্কাটাকে প্রতিদিন, বছরের পর বছর জিইয়ে রাখা হবে কেন? কিছু দুঃস্বপ্নের ইতি হওয়াই মঙ্গল!

উল্লেখ্য, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের পর থেকে কয়েক দিন ধরে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করার দাবি উঠেছে প্রতিবাদ সমাবেশগুলো থেকে। সবখান থেকে আওয়াজ উঠেছে : ধর্ষণকারীদের দ্রুত বিচার চাই, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, ফাঁসি চাই। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করতে এ-সংক্রান্ত আইন সংশোধন করা হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক। একদল ধর্ষণকারীদের মৃত্যুদন্ড ও ফাঁসির পক্ষে কথা বলছে। আরেক দল ধর্ষণের কঠিন শাস্তি দাবি করলেও মৃত্যুদন্ডের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করছে। তারা বলছেন, আইনে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবনের যে সাজা এখন আছে, সেটারই প্রয়োগ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলেই এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে।

মৃত্যুদন্ডের অনুকূলে যারা, তারা সাধারণত দুধরনের যুক্তি দিয়ে থাকেন। একটা যুক্তি ব্যবহারিক, আর একটা যুক্তি নৈতিক। ব্যবহারিক যুক্তি এই যে, মৃত্যুদণ্ডের ভয়ে অপরাধীরা নিরস্ত হয়, ফলে অপরাধ কমে। এটা সেই রকম একটা কথা, যা শুনলেই মনে হয়, হ্যাঁ, ঠিকই তো। মুশকিল হলো, যুক্তি তো গানের সুর নয় যে, কানে ঠিক শোনালেই তাকে ঠিক বলে মেনে নেওয়া চলে। প্রমাণ চাই। প্রমাণের উপায় কী? যেখানে মৃত্যুদণ্ড, সেখানে কম অপরাধ, এমনটা দেখাতে পারলেই হয়? কিংবা যদি দেখানো যায় যে, একই জায়গায় মৃত্যুদণ্ড চালু করার ফলে অপরাধ কমেছে অথবা মৃত্যুদন্ড রদ করার ফলে অপরাধ বেড়েছে, তাহলেই উপপাদ্য প্রমাণিত?

এখানেও দুটো সমস্যা আছে। প্রথমত, এ বিষয়ে নানা দেশে বিভিন্ন সময়ে অনেক ধরনের গবেষণা হয়েছে, কিন্তু একেকটার ফল একেক রকম। দ্বিতীয়ত, যদি সব সময়ে সব জায়গায় মৃত্যুদন্ড ও অপরাধের বিপরীত সম্পর্ক দেখা যেত, তাহলেও কার্যকারণ সূত্র প্রমাণিত হতো না, কারণ অপরাধ কেবল দন্ডের ওপর নির্ভর করে না, আরও হাজারটা কারণে বাড়ে বা কমে অথবা একই থাকে। সুতরাং প্রমাণ যে কেবল মেলেনি তা-ই নয়, প্রমাণ অসম্ভব। নৈতিক যুক্তি, স্বভাবতই অনেক বেশি জটিল এবং নৈতিকতা বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন মাত্রার হতে পারে। তবে নীতির দিক থেকে মৃত্যুদন্ডের সমর্থকদের প্রধান প্রতিপাদ্য এই যে, অপরাধের নৃশংসতা একটা মাত্রা ছাড়ালে অপরাধী তার বেঁচে থাকার নৈতিক অধিকার হারায়। এই অভিমতের পেছনে থাকে আর একটি ধারণা : এ ধরনের পৈশাচিক অপরাধের পরেও যদি অপরাধীকে বাঁচতে দেওয়া হয়, তাহলে অপরাধ এবং শাস্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় না, ন্যায়বিচার ‘ক্লোজার’ বা সম্পূর্ণতা পায় না। ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ, খতিয়ে দেখা দরকার। খতিয়ে দেখা মানে প্রশ্ন করা।

মৃত্যুদন্ডের পক্ষে বা বিপক্ষে দাঁড়ানোটা তাই শেষ পর্যন্ত নিজের নিজের বিশ্বাসের প্রশ্ন, যুক্তি দিয়ে মেটানোর ব্যাপার নয়। এ বিষয়ে বিতর্ক অনিবার্যভাবেই অন্তহীন। এ খেলায় কোনো হারজিৎ নেই। তাহলে এই সওয়াল-জবাব চালিয়ে লাভ কী? লাভ আছে। খুব বড় লাভ। মৃত্যুদন্ড বিষয়ে একটা সমাজ কী ভাবছে, কী বলছে, কীভাবে বলছে, সেটা ওই সমাজের ওপরে আলো ফেলে, তাকে চিনতে সাহায্য করে।

এবং সেই কারণেই চারপাশের সমাজটাকে দেখে আজকাল আতঙ্ক হয়। যেকোনো বড় অপরাধ বা সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটলেই এখন এ দেশে ‘ফাঁসি চাই’ বলে শোরগোল শুরু হয়। মৃত্যুদণ্ডের নীতিগত বিরোধিতা করলে তার সমর্থকরা তীব্র স্বরে ‘তাহলে আপনি জঘন্য অপরাধীদের প্রশ্রয় দিতে বলছেন’ বলে আক্রমণ করেন। দেখেশুনে সন্দেহ হয়, এই সমাজের একটা খুব বড় অংশের কাছে অপরাধ ও শাস্তির ভারসাম্যের আসল মানেটা হলো শোধবোধ। ফাঁসি চাই মানে আসলে বদলা চাই।

কিন্তু বদলাতে কি অপরাধ কমে? বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা কিন্তু এর পক্ষে কথা বলে না। বারবার মৃত্যুদন্ডের দৃষ্টান্ত রাতারাতি ধর্ষণ বা নারী-নির্যাতন কমিয়ে ফেলেছে, এমন নজির কোথাও নেই। আবার ব্রিটেনের মতো দেশ মৃত্যুদন্ড রদ করার পরে ধর্ষণ হু-হু করে বেড়ে গিয়েছে এমনটাও ঘটেনি। গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস ঘেঁটে, দেশের পর দেশের গবেষণা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মৃত্যুদণ্ড ধর্ষণের বিরুদ্ধে কোনো বাড়তি প্রতিরোধ গড়ে তোলে না। জাতিসংঘ মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে প্রস্তাব নেওয়ার সময়ও বারবার বলেছে মৃত্যুদন্ড বা ফাঁসির সাজা অপরাধ কমায়, এটা স্রেফ গল্পকথা বা মিথ। ধর্ষণের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিলে সেটা হবে একটা পশ্চাৎমুখী পদক্ষেপ। ফাঁসি নয়, বরং অপরাধ প্রমাণ হলে ধর্ষককে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কারাবন্দি রাখা যেতে পারে, যা অনেক দেশে বলবৎ আছে।

আইন কার্যকর করার পাশাপাশি দরকার জনমত গঠন। ন্যায়বিচারের জন্য সমাজের কান্নাকে মৃত্যুদন্ডের অজুহাত করা বা সে কান্নাকে থামানোর জন্য মৃত্যুদন্ডকে ব্যবহার করা কোনোটাই এ দেশের সেরা আইন বিশেষজ্ঞরা সমর্থন করেননি। ফাঁসির দাবি করার সময় সে কথাটা মনে রাখা চাই। ফাঁসি দিয়ে ধর্ষণ নামক ব্যাধি ঠেকানো যাবে না। প্রকৃত শিক্ষা দরকার, যা মানুষকে বোঝাবে, মেয়েরা ভোগ্যপণ্য নয়। ছোট থেকে মেয়েদের সম্মান করতে শেখাটা বেশি জরুরি। স্রেফ কারও মা বা স্ত্রী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে। শুধু ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে ধর্ষণের মোকাবিলা সম্ভব নয়।

এ দেশের বেশির ভাগ বিবাহিত মেয়ে সবচেয়ে বেশি ধর্ষিত, লাঞ্ছিত হয় নিজের স্বামীর কাছেই। এই দেশের বেশির ভাগ পুরুষ আজও ‘দাম্পত্য ধর্ষণ’ কী, জানে না, মানেও না। ভাবখানা এমন যে, আরে বাবা, ড্যাংড্যাং করে বিয়ে করেছি, আমার স্ত্রীর শরীরটা নিয়ে যা খুশি করার হক আমার আছে। বিয়ে করা বউ তো আমার সন্তান উৎপাদন আর বিনোদনের যন্ত্র! অতএব, মেয়েদের কাছ থেকে ‘না’ শুনতে প্রস্তুত নয় পুরুষ। সমাজে ধর্ষণ ইত্যাদি বেড়ে যাওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ : মেয়েরা পুরুষদের হাতের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী পুরুষ মেয়েদের হাতের পুতুল করে রেখেছিল, কিন্তু নারী আর পুতুল হয়ে থাকতে চায় না। যে ক্ষেত্রগুলোয় যুগে যুগে পুরুষরাই একা, এককভাবে রাজত্ব করত, এখন মেয়েরা সেসব জায়গায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মেয়েদের যোগ্যতার কাছে ক্রমাগত কোণঠাসা পুরুষ তার শরীর নিয়ে, পোশাক নিয়ে কটাক্ষ করছে। যখন কোনো পুরুষ মহিলার পোশাক নিয়ে টিটকিরি দেয়, কোনো কর্মরত মহিলার শরীর নিয়ে যৌন ইঙ্গিত করে, বুঝতে হবে সেটা সেই পুরুষটির মেয়েদের দুনিয়ায় ক্রমাগত হেরে যাওয়ার হতাশা থেকে সৃষ্ট। বিবাহিত পুরুষরাই যখন স্ত্রীর সাফল্য উপভোগ করতে শেখেনি, শুধু মেয়েদের দাবিয়ে রাখার মন্ত্র শিখেছে, সেই দুনিয়ায় মেয়েরা কী করে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরবে? পুরুষের কাম-ক্রোধ-হিংস্রতা থেকে রেহাই পাবে?

শেষ কথা হলো, কঠোরতম শাস্তির চেয়ে ধর্ষণ মামলায় বিচার ও শাস্তির হার ৪-৫ শতাংশ থেকে কীভাবে আরও ওপরে তুলে আনা যায় এবং পর্যায়ক্রমে শতভাগ করা যায়, সেটাই আপাতত মূল লক্ষ্য হওয়া দরকার। একমাত্র তাহলেই কমতে পারে ‘যেকোনো কিছু করে পার পেয়ে যাওয়া যায়’ এই সর্বব্যাপী বিশ্বাস। তাই একটি দুটি ঘটনায় মৃত্যুদন্ড নয়, যৌনসহিংসতার সব ঘটনায় দ্রুত, যথাযথ তদন্ত ও বিচার হোক। ইতিমধ্যে যে আইন আছে, সেটি প্রচারিত হোক আর সর্বস্তরে তা মান্য হোক, কার্যকর করা হোক।

লেখক লেখক ও কলামনিস্ট

chiros234@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION