বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:৪৮ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ওয়াজ হোক তথ্যনির্ভর

ইসলামী জীবন

শাহীন হাসনাত:

‘মাঝি বাইয়া যাওরে, অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে’, ‘তোমাকেই চাই শুধু তোমাকেই চাই, আর কিছু পাই…’ বিখ্যাত এসব গান কোনো পেশাদার বা শৌখিন গায়ক কিংবা মডেলের কণ্ঠে নয়, কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে নয়; এগুলো ভেসে আসছে রাতের গভীরে কোনো ওয়াজ মাহফিলের মাইক থেকে। বক্তা খুব কসরত করে গেয়ে শোনাচ্ছেন উপস্থিত শ্রোতাদের। শ্রোতারাও গান শুনে বেশ উদ্বেলিত, ঘুমের ঝিমুনি ভাবটা কেটে যায়, বক্তা উজ্জীবিত হয়ে তিরস্কার করতে থাকেন এসব গানের গায়ককে, ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করেন শ্রোতাকে। আবার উদাহরণ দিতে নতুন কোনো লাইনের কলি গেয়ে গর্জে ওঠেন, গলার রগ ফুলিয়ে, শরীরের সর্বশক্তি ব্যয় করে হুমকি-ধামকি দেন, চোখ রাঙিয়ে কথা বলেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এখনকার ওয়াজ মানেই চিল্লাপাল্লা, গানের দু’লাইন গাওয়া, হাসাহাসি, ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ আর পরচর্চা। কোনো কোনো বক্তার ওয়াজ শুনে বুঝার উপায় নেই, এগুলো ওয়াজ নাকি কৌতুকের আসর! এই হলো এখনকার ওয়াজ মাহফিলের সাধারণ চিত্র। যা কোনোভাবেই আমাদের ঐতিহ্যবাহী ওয়াজ সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এগুলো সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষাগত অবক্ষয়। এসব কারণে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের চিরায়ত ওয়াজ সংস্কৃতি ছিনতাই হয়ে গেছে। আমলদার আলেম, পীর-মাশায়েখদের পরিবর্তে ওয়াজ চলে গেছে গলাব্যবসায়ীদের দখলে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়, এটা সমাজের জন্য অশনি সংকেত। আশার কথা হলো, ইসলামি স্কলাররাও এগুলো নিয়ে কথা বলছেন, ভাবছেন।

এখনকার কিছু বক্তার ওয়াজ শুনে সহজেই বোঝা যায়, কোরআন-হাদিসের প্রকৃত জ্ঞান তাদের মধ্যে নেই। সুর ও গলার শক্তির ওপর নির্ভর করে তারা ওয়াজ ব্যবসা করছেন। ঘুরেফিরে একই কথা বারবার বলেন। ভুল-বানোয়াট তথ্য দেন। অশুদ্ধ, অশালীন ভাষায় কথা বলেন। ব্যক্তিগত গল্প, পারিবারিক কেচ্ছা আর অন্যের দোষ ধরা ছাড়া বিশেষ কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না তাদের ওয়াজে। অথচ ওয়াজ হবে, কোরআন-হাদিস নির্ভর। ওয়াজে থাকবে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনভিত্তিক আলোচনা, সাহাবিদের জীবনীনির্ভর জ্ঞানের কথা, নীতি-নৈতিকতা ও সভ্যতানির্ভর ঘটনা, আমলের কথা, ইবাদতের কথা। সোজা কথায়, ওয়াজ হবে কোমল ভাষায়, মোলায়েম ও হৃদয়স্পর্শী কথায়। এখন এসব নেই, ওয়াজ মানে চিৎকার-চেঁচামেচি, পরস্পরকে আক্রমণ, পরস্পরবিরোধী মনগড়া ফতোয়া দিয়ে সময় পার করা থেকে শুরু করে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ, নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাস প্রচার, বিরোধীদের আক্রমণ করতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত জঘন্য ভাষা ব্যবহার। যার কারণে ওয়াজের প্রতি মানুষের মনে এক ধরনের নেতিবাচক মানসিকতা সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো ও ইসলাম প্রচার-প্রসারের জন্য যতগুলো মাধ্যম রয়েছে, তার মধ্যে ওয়াজ অন্যতম মাধ্যম। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমার রবের পথে আহ্বান জানাও হিকমতের সঙ্গে (সুকৌশলে) এবং উত্তম ভাষণের মাধ্যমে। আর তর্ক করো সর্বোত্তম পন্থায়।’ -সুরা নাহল: ১২৫

ইসলাম প্রচারের জন্য ওয়াজ বা বক্তৃতা একটি শক্তিশালী কৌশল। এটা একটি শিল্প। বক্তৃতায় রয়েছে মানুষের মনকে আকর্ষণ করার বিশেষ শক্তি, এটা আদর্শ প্রচারের হাতিয়ার, জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। আল্লাহতায়ালা বক্তৃতার অসাধারণ গুরুত্বের কথা ও সুবক্তা হওয়ার প্রশংসা করে ইরশাদ করেন, ‘আমি তার সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় করেছিলাম এবং তাকে দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও ফয়সালাকারী বাগ্মিতা।’ -সুরা সোয়াদ : ২০

মানবজীবনে বক্তৃতার গুরুত্ব সীমাহীন। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই কোনো কোনো বয়ান ও বক্তৃতায় জাদু রয়েছে।’ -সহিহ বোখারি

পবিত্র কোরআন ও হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, বয়ান ও বক্তৃতার ক্ষেত্রে বিশেষ পারঙ্গমতা অর্জন, ভাষার মাধুর্য, সুন্দর উপস্থাপনা ও হিকমতপূর্ণ বক্তব্য নিঃসন্দেহে একটি বিশেষ গুণ। ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য বক্তৃতা একটি প্রশংসনীয় দিক। মানবজাতির শ্রেষ্ঠ বক্তা ছিলেন নবী-রাসুলরা। মানুষকে সত্যের জ্ঞানদান, সঠিক পথপ্রদর্শন এবং আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে আদর্শ সমাজ গড়ার জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন তারা। এ কাজ তারা করেছিলেন মানুষকে বুঝানোর মাধ্যমে। তাই তাদের সবাইকে সারা জীবন

বক্তৃতা করতে হয়েছে। তাদের বক্তৃতা ছিল সবচেয়ে সুন্দর, চমৎকার ও আকর্ষণীয়। পবিত্র হাদিস ও সিরাত সাহিত্যের মাধ্যমে জানা যায়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বক্তা ছিলেন নবী করিম (সা.)। তার বক্তব্য ছিল সব দিক থেকে অনন্য, হৃদয়গ্রাহী ও বৈশিষ্ট্যম-িত। নবী করিম (সা.) সমাজের আমূল পরিবর্তন এমনিতেই আনতে পারেননি। এর পেছনে তার [(রাসুল সা.)] অসাধারণ বাকশক্তি ও সাহিত্যপূর্ণ বক্তৃতার বিরাট প্রভাব ছিল। যুগ যুগ ধরে নবী করিম (সা.)-এর অনুসরণে সাহাবি, তাবে-তাবেইন থেকে শুরু পূর্ববর্তী আলেমরা ওয়াজের ময়দানে সরব ছিলেন। এভাবে যুগে যুগে অনেক বক্তা কোরআন ও হাদিসের আলোকে হৃদয়স্পর্শী বক্তৃতার মাধ্যমে দেশ-বিদেশে ইসলামি জাগরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। এটাই ওয়াজের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু হাল সময়ে ওয়াজের নামে কিছু বক্তা কুৎসিত পথে ধাবিত হয়ে নোংরা প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছেন। এই ধারা থেকে এখনই বেরিয়ে আসা দরকার, পরিবর্তন দরকার; তাদের নিয়ন্ত্রণে সজ্জন ও জ্ঞানী আলেমদের এগিয়ে আসা দরকার।

লেখক : মুফতি ও ইসলামবিষয়ক লেখক

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION