বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:০২ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ধর্ষণ দন্ডনিদানকান্ড

মঈদুল ইসলাম:

বদখাসলত মানুষেরই হয়। মানুষও জন্মায় প্রাণী হয়ে, পশুরই মতো। পশু পশুই থাকে আজীবন, মানুষকেই মানুষ হতে হয় ধীরে ধীরে। যৌনকর্ম সব প্রাণীরই প্রকৃতিগত এবং সেটা বিপরীত লিঙ্গে। সৃষ্টির ধারা অব্যাহত রাখার এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। প্রয়োজনটা প্রকৃতিরই বেশি, প্রাণীর চেয়ে। জন্মাবধি পশু চলে সর্বকর্মে নিজ প্রজাতির স্বভাবে, প্রকৃতির ধর্মে। প্রকৃতি দাবড়ানো মানুষেরই কেউ কেউ প্রকৃতিবিরুদ্ধ পথ ধরে প্রাকৃতিককর্মেও, লাম্পট্যে নামে পশুরও নিচে। রেহাই পায় না ছেলেশিশু, এমনকি পশুও। জঘন্য ব্যভিচারে খোদার গজবে পয়গম্বর লুতের জাতির বিলুপ্তির কথা স্মরণ করানো আছে কোরআনে, বাইবেলে। সেই বাণী নিত্যই যারা পড়েন, পড়ান (ভিন ভাষায়) তাদেরও কারও কারও বিরুদ্ধে লাম্পট্যের অভিযোগ ওঠে। পরকালের দূরের বাদ্য নিজেরাই শোনে না, নগদ লুটে কুৎসিত হাতে। সভ্য হওয়ার উচ্চশিক্ষা যারা দেন তাদেরও কারও কারও বিরুদ্ধে উঠে ধর্ষণের অভিযোগ। অন্যরা তো ছিলই, এখন তারা আরও দুর্ধর্ষ। ব্যভিচার, ধর্ষণ, ফৌজদারি অপরাধ বহুকাল থেকেই। বিচারে সাজাও হয়ে আসছে। থামছে না তবু। দূরের-কাছের কোনো বাদ্যই যাচ্ছে না তাদের কানে।

১৩ বছরের বেশি বয়স্কা নিজের স্ত্রী ছাড়া নারীর সম্পূর্ণ ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছলে কিংবা বলে পুরুষের যৌনসম্ভোগকে ধর্ষণের (জধঢ়ব) অপরাধ বলে আমাদের ১৮৬০ সালের পেনাল কোডে (৩৭৫ ধারায়)। সাজা (৩৭৬ ধারায়) যাবজ্জীবন কিংবা ১০ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের (১২ বছরের নিচে নিজের স্ত্রী হলে দুই বছর পর্যন্ত) কারাদন্ড (জরিমানাও)। নিচের সীমা বাঁধা নেই, দন্ডদানে বিচারকের ‘ডিসক্রিশন’ (কান্ডজ্ঞান) খাটানোর অবাধ ক্ষমতা। বিচার দায়রা আদালতে। ১৯৯২ সালের দিকে এক সাব-জজ দন্ডদানে ‘ডিসক্রিশন’ খাটিয়ে হাইকোর্টের শোকজ খেয়েছিলেন। সেকালের সাব-জজরা একই সঙ্গে সহকারী দায়রা জজও ছিলেন (এখন সেটা যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ)। তাদের কাছেও বিচারের জন্য ধর্ষণের দু-চারটা মামলা দেওয়া হতো। তিনি দন্ড দিয়েছিলেন স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল জজ হিসেবে (১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে)। পেনাল কোডের ৩৭৬ ধারা তখন স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের বিচার্য ১৯৮৩ সালের [Cruelty to Woman (Deterrent Punishment)] অধ্যাদেশে। সহকারী দায়রা জজ (এখনকার যুগ্ম দায়রা জজও) পদাধিকারবলে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল জজ। আপিল হাইকোর্টে। দণ্ডিত আসামি আপিলে গেলে হাইকোর্ট ধরেন সেই দন্ডদাতা জজকে – ‘হোয়াই সিক্স মান্থস, নট সিক্স ইয়ার্স?’ আমরা জিজ্ঞেস করলাম, মাত্র ছয় মাস কেন ভাই? জানালেন, ‘ভিকটিম ষাট বছরের বৃদ্ধা তো তাই। ’ এ কেমনতর ‘ডিশক্রিশন’! বিশ্বাস না হলে খালাস হবে। ধর্ষিতার বয়স ধরে সাজার বাড়া-কমা হবে! ধর্মে সইবে কি না সে পরের কথা, হাইকোর্ট সইবে! সেই অধ্যাদেশ বাতিল করে ধর্ষণের অপরাধে কেবলই যাবজ্জীবন কারাদন্ড (জরিমানাও), আর ধর্ষণ করে খুন করার জন্য কেবলই মৃত্যুদন্ড করা হয় ১৯৯৫ সালে [নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইনে]। ‘ডিসক্রিশন’-এর কান্ডকারখানা বন্ধ এক্কেবারে। ১৪ বছরের দরিদ্র গ্রাম্যবালক শুকুর আলি তারই গ্রামের সাত বছরের এক দরিদ্র নাবালিকাকে ধর্ষণের পর খুনই করে ফেলে ১৯৯৬ সালের ১১ জুনে। তিন বছর গেল বিচার শুরু হতে, ১৯৯৯ সালে তার বয়স গেল ষোলো পেরিয়ে। ১৯৭৪ সালের ‘চিলড্রেন অ্যাক্ট’-এর শিশু ছিল ষোলো বছরের নিচে। সেই ষোলো ধরা হবে অপরাধকাল থেকেই নাকি বিচারকালে! দু-রকমই সিদ্ধান্ত হাইকোর্ট বিভাগের। বিচারকালেই ধরা হবে বলে বরাবরের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আপিল বিভাগের [৬৬ ডিএলআর (এডি) ১১১]। ‘চিলড্রেন অ্যাক্ট’ প্রযোজ্য হয়নি শুকুর আলির বিচারে। হলে বছর দশেকের কারাদন্ড দেওয়ার ‘ডিসক্রিশন’ ছিল আদালতের। ১৯৯৫ সালের সেই আইন বাতিল হয়ে ধর্ষণের পরে খুনের অপরাধে ‘মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড’ করা হয় ২০০০ সালে (নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে)। শুকুর আলির অপরাধ ১৯৯৫ সালের আইনের, দন্ড কেবলই মৃত্যু। বিশেষ আদালতে বিচার শেষে তার ফাঁসির রায় হলো নতুন শতকে, ২০০১ সালের ১২ জুলাই।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হলো উভয় সংকটাবস্থা। একদিকে নারীশিশু ধর্ষণের ওপর খুন, আরেকদিকে ধর্ষক ‘শিশু’র মৃত্যুদন্ড! দ্বিতীয়টি নিয়েই লাগতে হলো। শুকুর আলির পাশে দাঁড়াল ‘ব্লাস্ট’ (Bangladesh Legal Aid and Services Trust)। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ হাইকোর্ট বিভাগে এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ আপিল বিভাগেও বহাল থাকল মৃত্যুদন্ড। ১৯৯৫ সালের আইনের এই মামলায় সেই ‘চিলড্রেন অ্যাক্ট’ চলবে না এবং আইনের জটে আদালতের হাত বাঁধা বলে রাষ্ট্রপতির মার্জনা চাওয়ার কথাও বলা হলো। রিভিউও খারিজ হলো ২০০৫ সালের ৪ মে। সে বছরই আবেদনও করা হলো রাষ্ট্রপতির মার্জনা চেয়ে। রিটও (নম্বর ৮২৮৩/২০০৫) হলো আদালতের ডিসক্রিশনের ‘অপশন’ ছাড়া কেবলই মৃত্যুর সেই দন্ডবিধান চ্যালেঞ্জ করে। নিষ্পত্তি হলো পাঁচ বছর পরে ২০১০ সালের ২ মার্চ। বিকল্পহীন কেবলই মৃত্যুর দন্ডবিধান দিয়ে বিচার করতে দিলে জীবন হরণ করা মরণের চরম দন্ড ঘোষণায় বাধ্য ডিসক্রিশনহীন আদালতের হাত পরিণত হয় আইনপ্রণেতাদের রাবার-স্ট্যাম্প মাত্রে (‘the hands of the court become a simple rubber stamp of the legislature’) বলে ১৯৯৫ সালের সেই বিধান সংবিধানপরিপন্থী ঘোষিত হলো। এই যুক্তিতে ১৯৮৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পেনাল কোডের ৩০৩ ধারা (যাবজ্জীবন কারাদন্ডভোগী কয়েদি কর্র্তৃক খুনের অপরাধ, একমাত্র সাজা মৃত্যুদন্ড) সংবিধানপরিপন্থী বলে বাতিল করে। সেই নজির এই রিটে টানা হয়েছিল। শুকুর আলির মৃত্যুদন্ড রদবদল হলো না ফৌজদারির আপিল-রিভিউতে চূড়ান্ত বলে।

হাইকোর্ট বিভাগের সার্টিফিকেট নিয়ে ২০১০ সালেই ‘ব্লাস্ট’ গেল আপিল বিভাগে। আরও কয়েকটি মামলা একসঙ্গে নিয়ে নিষ্পত্তি হলো চার বছর পরে ২০১৫ সালের ৫ মে। সংবিধানপরিপন্থী বলে চূড়ান্তভাবে ঘোষিত হলো ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইনের ৬(২) ধারা (ধর্ষণের কারণে মৃত্যু), ৬(৪) ধারা (দলবদ্ধ ধর্ষণের কারণে মৃত্যু), পেনাল কোডের ৩০৩ ধারা (যাবজ্জীবন কারাদন্ডভোগী কয়েদি কর্র্তৃক খুন) এবং ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(ক) ধারার (যৌতুকের জন্য হত্যা) বিকল্পহীন কেবল মৃত্যুদণ্ডের বিধান। আপিল বিভাগে আইন হলো ওইসব অপরাধেও মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া যাবে করুণার বিশেষ কারণ (extenuating and mitigating circumstances) দেখলে ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে। শুকুর আলির মৃত্যুদন্ড রদবদল হয়নি তার অপরাধ brutal and diabolical (নৃশংস ও নারকীয়) বলে। [৬৭ ডিএলআর (এডি) ১৮৫] রাষ্ট্রপতির মার্জনা চেয়ে করা আবেদনের শেষ খবর আসেনি। শেষটায় আপিল বিভাগেরই করুণা মিলল ৩ আগস্ট ২০১৫ সালে। শুকুর আলির আগের কোনো অপরাধ কাহিনী নেই, বয়স ছিল এই অপরাধকালে ১৪ বছর (রবিঠাকুর আদর-আক্ষেপে এই ফটিকদের ‘বালাই’ বলেছেন ছুটি গল্পে) ও বিচারকালে ১৬ বছর এবং মৃত্যুভয়ে ১৪টি বছর কাটছে ‘কনডেম সেল’-এ (কারাগারে বিশেষ খুপরি) বলে তার মৃত্যুদন্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয় রিভিউতে।

সম্প্রতি আওয়াজ উঠল ধর্ষকের মৃত্যুদন্ডের আইন চেয়ে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে দেখা গেল না পক্ষে বা বিপক্ষে। আইন সংশোধন হয়ে গেল ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবরের অধ্যাদেশে, সংসদে তা পাসও হয়ে গেছে। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় (ধর্ষণ) ও ৯(৪)(ক) ধারায় (ধর্ষণের পর হত্যার বা আহতের চেষ্টা) যাবজ্জীবন কারাদন্ডের (জরিমানাসহ) সঙ্গে যুক্ত হলো মৃত্যুদন্ড। ‘পাবলিক-ডিমান্ড’ এত দ্রুত পূরণ হয়েছে কি কোনোকালে! দেরিতে হলেও বাকিগুলো পূরণ হবে! ‘যাবজ্জীবন’ কেটে কেবলই ‘মৃত্যুদন্ড’ বসানো হয়নি হয়তোবা শুকুর আলির মামলায় [৬৭ ডিএলআর (এডি) ১৮৫] আপিল বিভাগের রায়ের সম্মানে। ১১(ক) ধারায় (যৌতুকের জন্য হত্যা) ডিসক্রিশনহীন কেবল মৃত্যুদণ্ডের বিধান তুলে ‘মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন’ করাটা বাদ গেল কি ভুলে! নাকি মৃত্যুদণ্ডের ফাঁসে এখন আর কোনো শুকুর আলিকে পড়তে হবে না বলে! শুকুর আলির দুর্ভাগ্যে পোড়-খাওয়া নারী ও শিশু অধিকার বিষয়ের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রয়াসে শিশুর বয়স ও সাজার নতুন বিধান হয়েছে ২০১৩ সালের শিশু আইনে। ১৮ বছরের সবাই শিশু। এখনকার ফটিক-শুকুর আলিরা যতই অপরাধ করুক বিচার হবে শিশু আদালতে, কালো-কোট কালো-গাউন আর পুলিশি-পোশাক ছাড়া শিশুর উপযোগী পরিবেশে, বিচার শুরু করতে যদি তার বয়স ছত্রিশও ছাড়ায়। ফাঁসি তো নয়ই, দশ বছরের বেশি কারাবাসেরও (কারাদন্ড লেখা নিষেধ) বিধান নেই আইনে, অপরাধ যতই নৃশংস আর নারকীয় হোক। একাই ধর্ষণের পর হত্যার অপরাধে, আর দলবেঁধে ধর্ষণের পরে আহত বা হত্যার অপরাধে ফাঁসি কিংবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং জরিমানা (কমপক্ষে লাখ টাকা) নির্ধারিত আছে ২০ বছর আগে থেকেই [২০০০ সালের আইনের ৯(২) ও ৯(৩) ধারা]। এবার ধর্ষণের অপরাধ, আর ধর্ষণের পরে খুনের অপরাধ, একার আর দলবদ্ধ অপরাধ, সব বরাবর। সব কটিতে ফাঁসিই হলো নিয়ম, যাবজ্জীবন হলো করুণার ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে। সর্বোচ্চ সাজার আইনে কাজ না হলে কপাল ঠুকতে হবে!

আবার দাবি উঠছে ছেলেশিশুর ওপর যৌন সংসর্গকেও ধর্ষণ গণ্য করা নতুন আইনের। ১৬০ বছর আগে থেকেই ধর্ষণে যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদন্ড (৩৭৬ ধারা), আর খুনে মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড (৩০২ ধারা) নির্ধারিত আছে ১৮৬০ সালের পেনাল কোডে। ধর্ষণ গণ্য না করলেও প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনকর্মে ধর্ষণের চেয়ে কম সাজা নেই পেনাল কোডে। জুতমতো তদন্ত আর উচিতমতো বিচার হলে যাবজ্জীবন কারাদন্ড নগদেই দেওয়া যায় ৩৭৭ ধারাতেই। শুধু কঠোর আইন চেয়ে আর করে দায় সারলেই কি সাজা নিশ্চিত হবে! নাকি অপরাধ দমন হবে! দীনহীন শুকুর আলিরই বিচারে বছর বিশেক গেছে নতুন আইনের জটে। পয়সাওয়ালা দাপটওয়ালাদের বিচারে কত বিশ যাবে! বিচার আটকানো, বিচার ফসকানোর গোড়ায় হাত দিতে হবে আগে। বিচারের পথ পরিষ্কার না হলে কাজ হবে না কিছুতে।

লেখক প্রবন্ধকার ও আইন গ্রন্থকার অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক/moyeedislam@yahoo.com

সূত্র:দেশ রূপান্তর/ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION