বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০২:২০ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

দেশের মানুষ এখন কেন বেশি ভাত খাচ্ছে

নিতাই চন্দ্র রায়:

পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, ২০১০ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ভাত খাওয়ার পরিমাণ ছিল ৪৭৯ গ্রাম। ২০১৭ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩৮৬ গ্রামে। শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষ দ্বিগুণ ভাত খায়। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের মানুষের ভাত খাওয়ার পরিমাণ কমে আসছিল। বাড়ছিল অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের পরিমাণ। দেখা গেছে, মাথাপিছু আয়, শিক্ষার হার ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও সবজিসহ নানা পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ বেড়ে যায় এবং ভাত গ্রহণের পরিমাণ কমে যায়। কিন্তু করোনা মহামারীকালে তার উল্টো ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) পক্ষ থেকে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার ওপর করোনার প্রভাব বিষয়ে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্য খাদ্যের চেয়ে ভাতের দাম কম হওয়ায় এবং আয় কমে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের মানুষ ভাত খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভাত খাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধির অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় গরিব মানুষের সহায়তা হিসেবে চাল দেওয়া বাড়িয়ে দিয়েছে। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকেও করোনার কারণে আর্থিক সমস্যায় থাকা মানুষের সহায়তা হিসেবে চাল দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে বাজার থেকে চাল কেনা বেড়ে গেছে এবং বেড়ে গেছে পরিভোগের পরিমাণও।

দেশে উৎপাদিত চালের শতকরা ৫৪ ভাগ আসে বোরো মৌসুম থেকে। আর বাকি ৪৬ ভাগ আসে আমন ও আউশ থেকে। সে জন্য দেশের ১৬ কোটি ৮১ লাখ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় বোরো মৌসুমের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি চালের গড় ফলন যেখানে ৩.২ মেট্রিক টন, সেখানে বোরো মৌসুমে হেক্টরপ্রতি চালের গড় ফলন ৪ মেট্রিক টনেরও বেশি। আমন মৌসুমে হেক্টরপ্রতি চালের গড় উৎপাদন মাত্র আড়াই মেট্রিক টন। আমন মৌসুমে ৫৬ লাখ হেক্টর জমি থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয়। অন্যদিকে বোরো মৌসুমে ৪৯ লাখ হেক্টর জমি থেকে ২ কোটি ৯ লাখ থেকে ২ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয়। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বোরো ধানের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হলে, দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। বাজারে চালের দাম বেড়ে যায়। সরকারকে বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে চাল আমদানি করে খাদ্য সংকট মোকাবিলা করতে হয়। ২০১৭ সালে আগাম বন্যায় হাওরের বোরো ধান বিনষ্ট হলে দেশে ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল কম উৎপাদিত হয়। সরকার খাদ্য সংকট মোকাবিলায় চাল আমদানি শুল্ক হ্রাস করে। সেই সুযোগে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে প্রায় ৬০ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করে। ফলে পরবর্তী দুই বছর কৃষক উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। তারা ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচও তুলতে পারেননি। প্রতি মণ ধান ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দরে বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হন। আর মিল মালিকরা সেই ধান থেকে চাল উৎপাদন করে সরকারি গুদামে সরবরাহ করে বিপুল বিত্তের মালিক হন।

করোনা মহামারীর কারণে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের আয় কমে গেছে। দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৪০ ভাগে। এ ছাড়া পরপর তিন বারের বন্যার কারণে শাকসবজির দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলে মানুষ দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও খাদ্য বাবদ ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়। এ কারণে বেড়েছে মানুষের ভাত খাওয়ার পরিমাণ। করোনাকালে বাংলাদেশের মানুষের ভাত খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় দুই লাখ টন। চাল ভোগের পরিমাণ বাড়লেও যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ বলছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ বছর বাংলাদেশে প্রায় ছয় লাখ টন চাল কম উৎপাদিত হবে। সংস্থাটির হিসাবে, এ বছর বাংলাদেশে মোট ৩ কোটি ৫৩ লাখ টন চাল উৎপাদিত হবে। আর মানুষের খাদ্য হিসেবে দরকার হবে ৩ কোটি ৬১ লাখ টন। গত বছরের উদ্বৃত্ত চাল দিয়ে ওই ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কমপক্ষে পাঁচ লাখ টন চাল আমদানি করতে হবে। সম্প্রতি (১৫.১১.২০২০) ইউএসডিএ থেকে ‘বাংলাদেশ : গ্রেইন অ্যান্ড ফিড আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চালের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি এর দামও বেড়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বাংলাদেশে মোটা চালের দাম ৩২ শতাংশ বেড়েছে। প্রতি কেজি মোটা চাল বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা দরে।

এখনো সারা দেশে রোপণকৃত আমন ধানের শতকরা ৫০ ভাগও কাটা হয়নি। বর্তমানে প্রতি মণ আমন ধান বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা দরে। আর বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ব্রি-ধান ২৮ ও ব্রি-ধান ২৯ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে। এ কারণে এ বছর বোরো ধান আবাদে কৃষকের মধ্যে প্রবল আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এখন সারা দেশে চলছে বোরো ধানের বীজতলা তৈরির মহোৎসব। কৃষক বিভিন্ন বেসরকারি বীজ কোম্পানির হাইব্রিড জাতের ধানবীজ কিনছেন প্রচুর, যা গত বছর দেখা যায়নি। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন কর্তৃক বাজারজাতকৃত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল বিভিন্ন ইনব্রিড জাতের বোরো ধানের বীজ কেনায়ও কৃষকদের মধ্যে প্রচুর উৎসাহ-উদ্দীপনা দৃশ্যমান হচ্ছে।

সঠিক সময়ে সঠিক বয়সের চারা রোপণ, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ, সেচ প্রদান এবং সময় মতো আগাছা, পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনের ওপর বোরো ধানের ফলন বহুলাংশে নির্ভর করে। দেখা গেছে দেশের অধিকাংশ গভীর নলকূপের মালিকরা বেশি লাভের আশায় বিলম্বে সেচযন্ত্র চালু করেন। ফলে কৃষক বোরো মৌসুমে ৩০ থেকে ৩৫ দিন বয়সের চারা মূল জমিতে রোপণ করতে পারেন না। এতে ধানের ফলন ব্যাপকভাবে কমে যায়। এ ব্যাপারে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা এবং উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের সময় মতো গভীর নলকূপগুলো চালু এবং নির্দিষ্ট বয়সের ধানের চারা রোপণে নলকূপ মালিক এবং বোরো ধানচাষিদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

আউশ ও আমন ধানের তুলনায় বোরো ধানের উৎপাদন খরচ বেশি। সেচ, সার ও বালাইনাশক কেনায় কৃষককে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। এ জন্য বোরো ধানচাষিরা যাতে সময় মতো স্বল্পসুদে কৃষিঋণ পান সে ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং দেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে সময় মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ বছর আমন মৌসুমে যে ছয় লাখ মেট্রিক টন চাল কম উৎপাদিত হবে, বোরো মৌসুমে ফলন বৃদ্ধির মাধ্যমে তা অবশ্যই আমাদের পূরণ করতে হবে। বোরো মৌসুমে যেখানে ২ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয় সেখানে ২কোটি ১৬ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন করা খুব কঠিন কাজ নয়। এ জন্য আমাদের হাইব্রিড ও উচ্চ ফলনশীল ইনব্রিড জাতের গুণগতমানের বীজের ব্যবহার বাড়াতে হবে। বিশুদ্ধ বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে ধানের ফলন শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ বাড়ানো যায়। দেশে বোরো মৌসুমে ১৯.৬৭% জমিতে হাইব্রিড ও ৭৯.৬৬% জমিতে উচ্চ ফলনশীল ইনব্রিড জাতের চাষ হয়। হাইব্রিড জাতের গড় ফলন যেখানে ৪.৮১ টন, ইনব্রিড জাতের ফলন ৪.০১ টন। তাই হাইব্রিড বীজের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমেও বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। হাইব্রিড ধান চাষের মাধ্যম্যে চীন ইতিমধ্যে হেক্টরপ্রতি চালের উৎপাদন ৬.৫ মেট্রিক টনে বাড়াতে সক্ষম হয়েছে, যা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানির প্রতি কেজি হাইব্রিড ধানবীজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকা দামে। এত বেশি দামে হাইব্রিড বীজ কেনার সামর্থ্য অনেক কৃষকের নেই। ফলে ইচ্ছে থাকলেও বহু কৃষক অর্থের অভাবে হাইব্রিড জাতের ধানবীজ কিনতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে সরকার হাইব্রিড ধানচাষের ওপর কৃষকদের প্রণোদনা প্রদান করতে পারে। সরকার সেচের ওপর যে ভর্তুকি প্রদান করে, তা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের কোনো কাজে লাগে না। এই ভর্তুকির সব সুবিধা ভোগ করেন এক শ্রেণির গভীর নলকূপের মালিক। তাই সেচ ভর্তুকির অর্থ সেচযন্ত্রের মালিকদের পরিবর্তে ধান উৎপাদনকারী কৃষকদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সরাসরি প্রদান করা উচিত। এতে ধানের উৎপাদন খরচ কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে এবং প্রকৃত ধান উৎপাদনকারী কৃষকরা লাভবান হবেন।

লেখক সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ লি.

netairoy18@yahoo.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION