বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৩৮ পূর্বাহ্ন
নিতাই চন্দ্র রায়:
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করে যখন দেশের ধর্মীয় উগ্রপন্থি গোষ্ঠী ফতোয়া দিচ্ছে, মিছিল-মিটিং করছে, ঠিক সেই মুহূর্তে কুষ্টিয়া শহরে বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন একটি ভাস্কর্য ভেঙে ফেলল একদল দুষ্কৃতকারী। তারা শুধু ভাস্কর্যটিই ভাঙেনি, গাড়ির ভেতর থেকে ফাঁকা গুলি করে আনন্দ-উল্লাসও করেছে প্রকাশ্য দিবালোকে। কী দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতির! জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিব বর্ষ’ উদযাপনের সময়ে এই ঘটনা জাতিকে স্তম্ভিত করেছে। সারা দেশে নিন্দার ঝড় উঠেছে।
গত ৪ ডিসেম্বর, শুক্রবার রাতের আঁধারে দুর্বৃত্তরা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটির ডান হাত, পুরো মুখম-ল ও বাঁ হাতের অংশবিশেষ ভেঙে ফেলে। পরদিন তা জনতার নজরে এলে শহরের বঙ্গবন্ধু সুপার মার্কেট চত্বর ও থানার মোড়ে আওয়ামী লীগ, জাসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠন বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল ও মানববন্ধন করে। পৌরসভার উদ্যোগে শহরের ব্যস্ততম পাঁচ রাস্তার মোড়ে বঙ্গবন্ধুর এই ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শুরু হয় নভেম্বর মাসে। একই বেদিতে বঙ্গবন্ধুর তিন ধরনের তিনটি ভাস্কর্য স্থাপনের উদ্যোগ ও জাতীয় চার নেতার ভাস্কর্য স্থাপনেরও পরিকল্পনা আছে সেখানে। ভাস্কররা দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে বিভিন্ন ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। এ কারণে সব সময় এই শিল্পীদের একটি মহলের চাপে থাকতে হয়। আর কুষ্টিয়ার এ ভাস্কর্যটি ছিল বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের প্রতীক।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনে, বেঁচে থাকার সংগ্রামেরও বিরোধিতা করেছে এমন ধর্মান্ধ গোষ্ঠী আর স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিগুলো। এরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বাঙালির বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারী ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধে সহায়তা করেছে। রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠন করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাসহ সব অপকর্মে অংশগ্রহণ করেছে। বাঙালির শাশ^ত ভাষা সংগ্রামের প্রতীক শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও প্রভাতফেরিকেও তারা ইসলামবিরোধী কাজ বলে অভিহিত করে এই চর্চার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দেশের হাজার হাজার শহীদ মিনারে জনতার ঢল থামানো যায়নি।
ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে ঢাকায় নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারটি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক ভেঙে ফেলার প্রতিবাদে প্রখ্যাত কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ তার বিখ্যাত ‘স্মৃতির মিনার’ কবিতায় লিখেছিলেন ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু/আমরা এখনো/চার কোটি পরিবার/খাড়া রয়েছি তো!’ বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অমর কৃতির জন্য বাঙালি জাতির জীবনে অবিনশ্বর এক ভাস্কর্য হয়ে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। সে ভাস্কর্য ধর্মীয় উগ্রপন্থি আর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো ভাঙবে কীভাবে? হাতুড়ি বা শাবল চালিয়ে সেই অবিনাশী ভাস্কর্য অপসারণ করা যাবে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর যখনই এ ধরনের নগ্ন আঘাত এসেছে, তখনই জনগণের হৃদয়ে তার আসন আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। দৃঢ়তার শেকড় প্রোথিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালে নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেও তাই তারা এ জাতির ইতিহাস থেকে শেখ মুজিবকে মুছে ফেলতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর পুনর্জন্ম হয়েছে। শোষিত মানুষের মুক্তির দূত, স্বাধীনতার অগ্নিপুরুষ হিসেবে আরেক নতুন শেখ মুজিবের জন্ম হয়েছে ইতিহাসের অগ্নিগর্ভে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙার নিন্দা জানিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ. ম রেজাউল করিম তাই যথার্থই বলেছেন যে‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা যায় না। বঙ্গবন্ধু একটি অবিনাশী সত্তা। তার মৃত্যু হয় না।’
আজ যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙছে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের জন্য আন্দোলন করছে তাদের এখনই দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। প্রতিবাদের অগ্নি পতাকা উড়াতে হবে সারা দেশে। না হলে এরা একদিন আমাদের শহীদ মিনার ভাঙবে। জাতীয় স্মৃতিসৌধ ধ্বংস করবে। শিখা চিরন্তন নিভিয়ে দেবে। পতাকা পোড়াবে। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি জানাতেও দ্বিধাবোধ করবে না।
দেশে উগ্রপন্থি ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর সাম্প্রতিক কর্মকা- লক্ষ করলে তাদের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির কয়েকটি বিশেষ দিক চোখে পড়বে। বিগত দিনগুলোতে দেখা গেছে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের যুবকদের ফেইসবুক আইডি হ্যাক করে এক শ্রেণির উগ্র ধর্মান্ধ যুবক ধর্ম অবমাননা ও মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে অবমাননার মিথ্যা অজুহাতে হিন্দুদের বাড়িঘরে, মন্দিরে আগুন দিচ্ছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট করছে। সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার কুরবানপুরের ঘটনা আমাদের ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দ্বারা অবরুদ্ধ বাংলাদেশের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এর আগে ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মন্দির ও বাড়িঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ এবং ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনারগুলোর সঙ্গে এখন জাতির জনকের ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনাকে কি আলাদা করে দেখার সুযোগ আছে? কারণ যারা আজ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছে তারা দীর্ঘদিন ধরেই অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশেরও বিরোধিতা করে আসছে।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ইয়েমেন, তুরস্ক, পাকিস্তানসহ সব মুসলিম দেশেই তাদের নিজ নিজ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করে বহু ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানেও মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর ভাস্কর্য থাকতে পারলে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করা হবে আর বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা হবে, এটা কখনোই হতে পারে না। এমনকি বাংলাদেশেও চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ লাগোয়া জিয়া স্মৃতি জাদুঘরের সামনে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের একটি ভাস্কর্য আছে। তাহলে এই গোষ্ঠীগুলো কেন জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙার জন্য কোনো আন্দোলনে নামছে না; ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে না।
বাংলাদেশের ধর্ম ব্যবসায়ীদের ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে অবস্থান আসলে বাংলাদেশে বাঙালির হাজার বছরের লালিত ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। রাজধানী ঢাকায় ২০০৮ সালে বিমানবন্দরের সামনে নির্মাণাধীন বাউল ভাস্কর্য ভাঙা আর সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্য স্থানান্তরিত করার ঘটনার মধ্য দিয়ে উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে যে আশকারা দেওয়া হয়েছিল আজ তারই ফলভোগ করতে হচ্ছে এই জাতিকে। এই অপশক্তি তাই আজ প্রবল প্রতাপে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার দুঃসাহস দেখাচ্ছে।
গত ১৩ নভেম্বর খেলাফত মজলিসের নেতা মাওলানা মামুনুল হক ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য তৈরির তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি সরকারে প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন ‘ভাস্কর্য নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে না দাঁড়ালে আর একটি শাপলা চত্বরের ঘটনা ঘটানো হবে এবং ভাস্কর্য ছুড়ে ফেলে দেওয়া হবে।’ আর হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ২৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে হাটহাজারী পার্বতী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত এক মাহফিলে ‘কোনো ভাস্কর্য তৈরি হলে তা টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেওয়া হবে’ বলে হুমকি দেন। ওইসব ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যের রেশ ধরেই তাদের অনুসারীরা এই বিজয়ের মাসে গত ৪ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ায় রাতের আঁধারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানে স্বীকৃত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মাণাধীন ভাস্কর্যের অংশবিশেষ ভেঙে ফেলে।
২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে জাতিকে এসব পশ্চাৎপদতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। একতাবদ্ধ হতে হবে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রগতির পতাকা হাতে নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে হবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ১৯৭১ সালের মতো দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বাঙালি বীরের জাতি। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে জয় আমাদের হবেই। আর বাঙালির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর যে ভাস্কর্য জাগরূক হয়ে আছে সেটা কখনোই ভাঙা যাবে না।
লেখক সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড
netairoy18@yahoo.com