বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৩৮ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বিজয়ের রাজনীতি

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:

বিজয়ের ৫০ বছরের প্রাক্কালে এক কঠিন সময়ের টানেলে ঢুকে পড়েছে আমাদের বাংলাদেশ, যেমন করে ঢুকেছে পুরো পৃথিবী। ২০২০-এর পৃথিবীতে সংক্রমণের আতঙ্ক এমনভাবে ছড়িয়ে পড়বে সে কথা কে ভেবেছিল? আমরা কেউ ভাবিনি, কেউ চাইনি, তবু অসুখ আমাদের ছুঁয়েছে, এক উৎকণ্ঠা আমাদের মনের মধ্যে চোরাঘূর্ণি সৃষ্টি করেই চলেছে। অতীতের মতো মানব সভ্যতা নিশ্চয়ই অসুখের আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসবে একদিন। এক রৌদ্রস্নাত পৃথিবী আবার ঝলমল করে উঠবে।

কিন্তু বাংলাদেশ এই বিজয়ের মাসে অন্য যে অসুখ দেখলো সেটি থেকে কি বের হতে পারবে? দেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের দ্বারপ্রান্তে তখন আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে এমন এক তত্ত্বকে, যাকে পরাজিত করেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু সেই তত্ত্বের প্রবক্তারা আবার যেন আঘাত হানতে শুরু করেছে। আধুনিক শিল্প সংস্কৃতিবিরোধী শক্তি যেন ফিরিয়ে আনতে শুরু করেছে পুরনো সাম্প্রদায়িক চেহারাকে।

আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে মান এতে করে রাজনৈতিক কারণে সংঘাত অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমনকি সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতাও নতুন নয়। স্বাধীনতার আগে এবং পরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বারবার ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করা, তার ভাস্কর্যে আঘাত করা, নতুন করে বিতর্ক তোলা হচ্ছে রাজনৈতিক কারণেই।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে অনেক লড়াই সংগ্রাম করেও যে উদারনৈতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি রক্ষিত হয়েছে, এখন একটি অরাজনৈতিক রাজনৈতিক গোষ্ঠী সেই ভিত্তিভূমিকেই বদলে দিতে চাইছে।

পুরো প্রক্রিয়াটাকে আমার কাছে মনে হয়েছে উগ্র মনোভাবের ভিত্তিতে একটা বিচ্ছিন্নতা প্রতিষ্ঠিত করার সচেতন প্রচেষ্টা। সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থরক্ষার নামে বিভেদের রাজনীতি এবং অসহিষ্ণুতার রাজনীতিকে বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে একটি মহল।

ইতিহাস বলে, সাম্প্রদায়িকতার এই বীজ বপন করেছিল পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ১৯৪৭ সালেই। ভারত বিরোধিতার নামে ধর্মীয় উন্মাদনা ও ধর্মাশ্রয়ী জাতীয়তাবাদ তৈরি করেছিল জিন্নাহর পাকিস্তান। কালক্রমে এই সাম্প্রদায়িকতা সমাজে বিভেদের পথ প্রশস্ত করেছিল। শাসক গোষ্ঠী আর তার অনুচরেরা সেই বিভেদকে নিজের স্বার্থে বারবার উসকে দিয়েছে।

যখন জাতি নতুনের প্রেরণায়, উন্নয়নের সম্পৃহায় জেগে উঠতে চেয়েছে তখনই প্রবলভাবে প্রকাশ পেয়েছে ধর্মবিদ্বেষ। সাবেক পূর্ব পাকিস্তান থেকে বর্তমান বাংলাদেশ একই অবস্থা চলছে। আমরা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে সেই শক্তিকে পরাজিত করে স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। কিন্তু এরা আবার শক্তি সঞ্চয় করেছে স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভেতরে থেকেই। রাজনৈতিক ধার্মিক শ্রেণি এই ধর্মীয় মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে। বাড়িয়েছিল। ব্রিটিশরা পরিকল্পিতভাবে এই উপমহাদেশে হিন্দু মুসলিমের সরাসরি রাজনৈতিক দল গঠনে উৎসাহ জুগিয়েছিল। ১৯৪৭-এর পর পাকিস্তানিরা আরও বেশি করে এই কাজ করেছে। করা হয়েছে ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরেও। আজ যে উগ্র ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আমরা দেখছি তার শিকড়ও সেখানে।

ধর্মের জিগির তুলে নিজেদের অশুভ স্বার্থ চরিতার্থ করতে ধর্ম ব্যবসায়ীরা মুনাফা লোটার চেষ্টা করেন। সাধারণ সরল বিশ্বাসী মানুষ রাজনীতির মারপ্যাঁচ না বুঝতে পেরে এদের কথায় উত্তেজিত হয়। মিথ্যার ফাঁদে পা দেয়। শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ সবসময় এদের কারণে আতঙ্ক ও অস্বস্তিতে থাকে। সাধারণ রাজনৈতিক দলগুলোও এদের তোষণ করে ভোটের হিসাব কষে।

করোনার আতঙ্ক থেকে আমরা বের হবোই। কিন্তু উগ্র শক্তির সহিংস আচরণ থেকে আমাদের মুক্তি কোথায়? বাংলাদেশ মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, নানা নৃ-গোষ্ঠী সকলের। সবাইকে নিয়ে এই দেশ, আমাদের মাতৃভূমি।

আমাদের মনে রাখা দরকার, এদের যত তোষণ করা হোক না কেন, এদের সাথে যতই আপস করা হোক না কেন, এরা এদের মৌলিক জায়গা থেকে সরে না। তারা যে সমাজের বিভাজনের রাজনীতি করে সেটা যতটা না ধর্মীয় কারণে তার চেয়ে বেশি রাষ্ট্রকে চাপে রাখতে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে। কাজেই ধর্ম নয়, আসলে ক্ষমতা হলো এই বিভাজনের মৌলিক কারণ।

আমরা কেউ ধর্মের বিরুদ্ধে নই। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ধর্মপ্রাণ, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। কিন্তু কারা তাদের উত্তেজিত করে, কারা তাদের সবসময় সংঘাতের পথে সক্রিয় রাখতে চায় সেই শক্তি সকলের কাছে উন্মোচিত।
ধর্ম বৃহত্তর মিলনের মধ্য দিয়ে মুক্তির পথে নিয়ে যাক সেটাই আমরা চাই। সে জন্য শাসক দলের আসল রাজনীতি করতে হবে, যা জনগণকে সর্বদা সজাগ রাখবে উগ্রবাদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে একটি গোষ্ঠী সাম্প্রতিককালে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ভয়ংকর উত্থান ঘটানোর চেষ্টা করছে। তার কারণ উদঘাটন করা প্রয়োজন। সহিংস উগ্রবাদী এই প্রেক্ষাপট তৈরিতে কি শুধু ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো দায়ী? আমরা মনে করি সৃষ্টিশীলতার অভাবে বামপন্থীরা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। অন্য উদারনৈতিকরা যথেষ্ট উদার থাকেনি। এই রাজনীতির পর্বতপ্রমাণ ভুল ও অবহেলায় বিপর্যস্ত হয়েছে উদারতার সব পথ। সাম্যবাদী স্বপ্নের জাহাজডুবির পর শূন্যতার সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত বিশাল তারুণ্যকে কাছে টেনে নিয়েছে মৌলবাদীরা। সাধারণ মানুষ আর তরুণ সমাজ যখন দেখে এই রাজনীতির কারবারিদের অনেকেই আজ মহা ধনাঢ্য এবং দুর্নীতিগ্রস্ত, তখন তারা পথ হারায়।

তাই শুধু তাদের দায়ী না করে নিজেদের ভুল কোথায় ছিল সেই আত্ম অনুসন্ধান প্রয়োজন। এদের উত্থান আসলে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির নৈতিক পরাজয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দলান্ধ হলে, দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থাকলে, নিজেদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাতে ব্যস্ত থাকলে এটি ঘটবেই। বের হওয়ার পথ হলো সেই রাজনীতি, যা বিজয় এনেছিল।

লেখক: সাংবাদিক

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION