মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৩৭ অপরাহ্ন
এস.এম রুবেল:
মানুষ স্বপ্ন দেখে উন্নত জীবনের, তেমনি মহেশখালীর মানুষও আশাহত হৃদয়ে স্বপ্ন দেখে উন্নত জীবনযাপনের। পাশাপাশি তাদেরও স্বপ্ন দেখান অনেকেই। কিন্তু এই স্বপ্নের আড়ালে অনেক বাধা আর কষ্ট লুকায়িত আছে। যা অনেকই এড়িয়ে যান আবার অনেকই দেখেও না দেখার ভান করে সময় পার করেন। আমরা বেশকিছু উন্নয়নের মাধ্যমে সামনে অগ্রসর হয়েছি কিন্তু এটা টেকসই নয় ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে। মহেশখালী এখন আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখার দ্বাপ্রান্তে। অথচ আমাদের সেই দীর্ঘ ৪০ বছর আগের সমস্যা এখনো আগে মতোই।যেগুলো দেখে সাধারণ মানুষ আক্ষেপ করে উদাসীন হয়ে পড়ে। বাস্তবিকভাবে বলতে গেলে এই প্রধান সমস্যাগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং ব্যক্তিদের কাছে অবহেলিত।যে সমস্যাগুলো আমাদের প্রতিনিয়ত ভোগায় আর ভাবায়। অপরূপ সৌন্দর্য্য আর প্রাকৃতিক সম্পদের ভরপুর এই মহেশখালী থেকে কখন মিলবে মুক্তি এসবের?
১। লবণ শিল্পের বেহাল দশা: মহেশখালী দ্বীপের প্রধান অর্থনৈতিক শিল্প হচ্ছে লবণ। লবণ চাষের উপর নির্ভর করে এই জনপদের সিংহভাগ মানুষের জীবিকা। এছাড়াও লবণ মাঠের সাথে পর্যায়ক্রমে ১৪/১৫ শ্রেণী পেশার মানুষের কর্ম জড়িত। যেমন- লবণ জমির মূল মালিক, লাগিয়ত নেয়া মালিক ও চাষা, লবন চাষ করতে মৌসুম পর্যায়ের দিনমজুর, দৈনিক দিন মজুর, লবন পরিবহনের শ্রমিক, লবন পরিবহনে ব্যবহৃত নৌকা ও ট্রলার মালিক ইত্যাদি শ্রেণীপেশার মানুষ জড়িত। কিন্তু লবণ মৌসুম চলাকালীন সময় ও মৌসুম পরবর্তী লবনের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় চরম ক্ষতির সম্মূখিত হতে হয় চাষীদের। তাই দিন দিন এ শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এখানকার লবন চাষীরা।
২। মহেশখালী থেকে কক্সবাজার ঘাট: মহেশখালী উপজেলা থেকে জেলা সদর কক্সবাজারে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নদীপথ। যানবাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয় কাঠের বোট ও স্পীড বোট। প্রতিদিন হাজারো পর্যটক ও স্থানীয়রা নিয়মিত যাতায়াত করে থাকেন। কিন্তু ঘাটে নির্দিষ্ট কোন নিয়মশৃঙ্খলা না থাকায় ঘাটে যাত্রী উঠানামা, পারাপার, ভাড়া আদান প্রদান, মালামাল পরিবহন সহ অন্যান্য সেবায় জনসাধারণ মারাত্মক ভাবে হয়রাণীর শিকার হচ্ছে। এমনকি প্রতিদিন পর্যটক সহ স্থানীয়রা পানিতে পড়ে যায়। যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই, নেই কোন পাবলিক টয়লেট। বিশেষ করে মহেশখালী ঘাটে একটি পল্টুন না থাকায় শিশু, বৃদ্ধ, মহিলা সহ অসুস্থ রোগীদের বোটে উঠতে কষ্টের সীমা থাকেনা। এই ঘাট দুটিতে বড় সমস্যা হচ্ছে, স্পীড বোট ও কাঠের বোট চালকদের হাতে যাত্রীদের ভাড়া দিতে হয়। অনেক সময় যাত্রীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া ও নির্ধারিত যাত্রীর অধিক যাত্রী পরিবহন করে। এই সমস্যা দুর করতে দুই পাশে টিকেট কাউন্টার স্থাপন করা প্রয়োজন।
৩। মাদকের নতুন রুট: টেকনাফে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদক বিরোধী শক্ত অবস্থান থাকার পর মাদক ব্যবসায়ীরা মহেশখালীকেই মাদক পরিবহণের বিকল্প নতুন রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে। কুতুবজোমের বিভিন্ন পয়েন্ট ও মহেশখালী থেকে আলাদা দ্বীপ সোনাদিয়ায় বিভিন্ন ধরণের মাদক ইয়াবা, ফেনসিডিল, বিদেশী মদ ইত্যাদি এনে জমা রাখে। সেখান থেকে বড় মহেশখালী, মহেশখালী পৌরসভা, হোয়ানক সহ বিভিন্ন জায়গায় মজুদ রেখে নানান কলাকৌশলে তা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছায় দেয়।
৪। পাহাড়ে অস্ত্র ও বাংলা মদ তৈরীর কারখানা: মহেশখালীর পাহাড়ে এক সময় অহরহ অস্ত্র তৈরীর কারখানা ছিল। তবে পুলিশ, র্যাবের অভিযানে অনেক আস্তানা ভেঙ্গে দেয়া এবং মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে অনেক সন্ত্রাসী আত্মসমর্পনের পরেও কিছু কিছু পাহাড়ে অস্ত্র তৈরীর কারখানা রয়েছে বলে জানা যায়। এই অস্ত্রও দেশের বিভিন্ন সন্ত্রাসী, কিশোর গ্যাং, ডাকাত দলের কাছে বিক্রি করা হয়। অপরদিকে পাহাড়ে অনেক সন্ত্রাসী জনগোষ্ঠী বাংলা মদের কারখানা গড়ে তুলেছে। বিশেষ করে বড়মহেশখালী, হোয়ানক, শাপলাপুর ও কালারমারছড়ার পাহাড়ে এসব কারখানা গড়ে উঠেছে বলে জানা যায় এবং কুতুবজোমের চরাঞ্চলে, ঘটিভাঙ্গায় বাংলা মদ বিক্রি করা হয়।
৫। ফৌজদারী অপরাধ: করোনাকালীন সময়ে ২০২০ সালের মে মাসের পর থেকে মহেশখালীতে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরণের ফৌজধারী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। তারমধ্যে শাপলাপুরে কলেজ ছাত্র মিরাজ হত্যাকান্ড এবং একই এলাকার স্কুল ছাত্রী নাছিমা হত্যাকান্ড, হোয়ানকের রহমত উল্লাহ হত্যাকান্ড, ছোট মহেশখালীর ছালেহ আহমদ হত্যাকান্ড এবং একই এলাকায় ছলিম উল্লাহ হত্যাকান্ড, বড় মহেশখালীতে মুক্তিযোদ্ধাপুত্র রুবেল হত্যাকান্ড, কালারমারছড়ার গৃহবধু আফরোজা হত্যাকান্ড আলোচিত ছিল। সর্বশেষ ২০২১ সালের শুরুতে বড় মহেশখালীতে আবদুল গফুর হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। এছাড়াও জমিজমা নিয়ে মারামারির ঘটনা ঘটে প্রায় সময়। মহেশখালী উপজেলাটি উত্তর-দক্ষিণ লম্বালম্বি। কিন্তু থানার অবস্থান একেবারে দক্ষিণে হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশকে নানা ধরণের সমস্যায় পড়তে হয়। ইতিমধ্যে মাতারবাড়ি, হোয়ানক, কালারমারছড়া পুলিশ ক্যাম্প করা হয়েছে। এছাড়াও দুরত্বের দিক বিবেচনায় শাপলাপুর ইউনিয়নে আরো একটি পুলিশ ক্যাম্প করা প্রয়োজন।
৬। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা: চলমান রাস্তার উন্নয়ন কাজ শেষ হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকটা উন্নত হবে। তবে উপজেলার ভিতরের রাস্তা গুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। বেশির ভাগ এলাকার রাস্তাঘাট যান চলাচল অনুপযোগী। যার কারণে বিশেষ করে বর্ষাকালে স্থানীয়দের যাতায়াতে চরমভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। উপজেলার মাতারবাড়ি, ধলঘাটা, শাপলাপুরের বিভিন্ন সড়ক একেবারেই বিধ্বস্ত অবস্থায় আছে। অন্যদিকে বড়মহেশখালী, হোয়ানক, ছোট মহেশখালী, পৌরসভার পুটিবিলা, কুতুবজোমের গ্রামীন সড়ক গুলোর অবস্থা খুব খারাপ।
৭। মানসম্মত আবাসন: মহেশখালী অপার পর্যটন সম্ভবনাময়ী একটি জনপদ। প্রতিদিন হাজারো দেশী বিদেশী পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন। কিন্তু পর্যটক সহ অন্যান্যদের থাকার জন্য মানসম্মত কোন আবাসন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। মহেশখালীতে চাকরী বা বিভিন্ন সূত্রে থাকা লোকজন ও পর্যটকদের মানসম্মত খাবারের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এখানে মানসম্মত একটি রেষ্টুরেন্ট বা খাবার হোটেল নেই। নামে মাত্র যে কয়েকটা আছে তাদের খাবার পরিবেশনা অপরিস্কার, অপরিচ্ছন্ন ও মানসম্মত নয়। বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমান আদালতে এসব খাবার হোটেল ও রেষ্টুরেন্টে অভিযান চালিয়েও সমস্যা সমূহ কাটিয়ে উঠা সম্ভব হচ্ছেনা।
৮। বাল্য বিবাহ, জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও বহুবিবাহ প্রচলন: মহেশখালীতে বাল্য বিবাহ একটি বড় সমস্যা। ইতিমধ্যে এটি সমাজে ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়েছে। বাল্য বিবাহের কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যকর কোন কর্মসূচী চালু না থাকায় ব্যাধিটি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনসাধারণের অসচেতনার কারণে জনসংখ্যা দিন দিন জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ জন্ম নিয়ন্ত্রণ না করা এবং সমাজে বহু বিবাহ প্রথা চালু থাকা। এই বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে তোলা প্রয়োজন।
৯। অনুন্নত চিকিৎসা: চিকিৎসা ক্ষেত্রে একেবারে পিছিয়ে থাকা একটি জনপদ মহেশখালী। পুরো উপজেলার জনসাধারণের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে একটি মাত্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। সেখানেও নানান অনিয়ম, জনবল সংকট ও আন্তরিকতার অভাবে জনসাধারনকে কাঙ্খিত সেবা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছেনা বলে জানা যায়। মহেশখালী থেকে কক্সবাজার রোগী পরিবহণের জন্য একটি নৌ-এ্যাম্বুলেন্স নেই। অপরদিকে সেই সুযোগে গলাকাটা বাণিজ্য করছে বেসরকারী ভাবে গড়ে উঠা ডায়াগনস্টিক সেন্টার গুলো। যারা অনেক সময় ভুল রিপোর্ট দিয়ে রোগীদের ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়। তাই মহেশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে বন্ধ থাকা এক্সরে সেবাটি চালু করা খুবই জরুরী। পাশাপাশি প্যাথলজি সেবা আরো গতিশীল করে তোলা প্রয়োজন।
১০। মেগা প্রকল্প সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা:দেশের ১০টি চলমান বড় প্রজেক্টের মধ্যে মহেশখালীর মাতারবাড়িতে চলছে একটি। ইতিমধ্যে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, গভীর সমুদ্র বন্দর ও এলএনজি টার্মিনাল এ তিনটি প্রকল্প মহেশখালীতে চলমান আছে। এ প্রকল্প সমূহ করার জন্য স্থানীয়দের জমি অধিগ্রহণ করেছে সরকার। ইতিমধ্যে অনেকের বাড়িঘর অধিগ্রহণে পড়ায় অন্যত্র চলে গিয়েছে। বিশেষ করে মেগা প্রকল্পে বেশির ভাগ লবন চাষের জমি পড়ায় স্থানীয়দের পেশা পরিবর্তন করতে হচ্ছে। আগে তারা লবন চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করা লোকজন এখন বেকার ঘুরছে। কারণ এখানে বিকল্প পেশারও সুযোগ নেই বললেই চলে। তাই বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী বেকারত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এতে তারা অস্থিত্ব সংকটে পড়তে পারে। স্থানীয়দের অভিযোগ এসব প্রকল্পে সিন্ডিকেট করে অবৈধভাবে উৎকোচ নিয়ে বাইরের লোকজনদেরকে চাকরী দেয়া হচ্ছে। এতে করে বঞ্চিত হচ্ছে এসব প্রকল্পের জন্য যারা জমি দিয়েছিলেন তারা সহ স্থানীয় অন্যান্যরা। তাই স্থানীয়দের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন পদে চাকরী দেয়ার দাবী জানান তারা। লেখক- ভয়েস প্রতিবেদক, মহেশখালী।
ভয়েস/জেইউ।