মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০২:২৮ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বড় বাজেটে সুবিধা কার

রাজেকুজ্জামান রতন:
সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ না থাকলেও তাদের জীবনকে সমস্ত দিক থেকে প্রভাবিত করে প্রতি বছরের বাজেট। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে ‘বাজেট’ শব্দটি আছে কি? সংবিধানের ৮৭(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে ‘বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি’। বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক অর্থবছর সম্পর্কে উক্ত অর্থবছরের জন্য সরকারের অনুমিত আয় ও ব্যয়-সংবলিত একটি বিবৃতি সংসদে উপস্থাপিত হবে।’ বাজেট শব্দটি তাহলে কোথায় আছে? সংবিধানে না থাকলেও বাজেট আছে সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে। বিধির ১১১(১)-এ বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিকে ‘বাজেট’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কার্যপ্রণালি বিধিতে সংসদে বাজেট উপস্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অর্থমন্ত্রীকে। বিধির ১১১(২)-এ বলা হয়েছে, ‘সংবিধানের বিধান সাপেক্ষে অর্থমন্ত্রী যেরূপ উপযোগী মনে করবেন, সেই আকারে বাজেট সংসদে পেশ করবেন।’ কিন্তু অর্থমন্ত্রী যে রকম মনে করেন সে রকম বাজেট কি উপস্থাপন করেন বা করতে পারেন? রাষ্ট্র যে নীতিতে চলে, সরকার যে পদ্ধতি অবলম্বন করে বাজেটে তারই প্রতিফলন ঘটে। বাজেটে অন্তত তিনটি বিষয় থাকে। প্রথমত, নীতি, দ্বিতীয়ত, নির্দেশনা, তৃতীয়ত, বাস্তবায়ন কৌশল। বাজেট বিশ্লেষণে এই বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হয়।

৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা নিয়ে বাংলাদেশের ৫০তম ও করোনাকালের দ্বিতীয় বাজেট ঘোষণা হয়েছে। সবচেয়ে বড় শুধু নয়, সবচেয়ে বেশি ঘাটতিরও বাজেট এটি। বাজেট বড় হলেই যেমন উল্লাসের কোনো ব্যাপার থাকে না, আবার ঘাটতি বাজেট তেমন কোনো আতঙ্কের ব্যাপার নয়, যদি বাজেটের আয় কোথা থেকে আসবে আর ব্যয় কোথায় হবে তা জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে গ্রহণ করা হয়। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তাসহ জনমুখী খাতে যদি বরাদ্দ বাড়ে তাহলে তার প্রভাব পড়ে সারা দেশের মানুষের ওপর। বাজেটের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা সংগ্রহ করা হয় জনগণের ওপর ট্যাক্স আরোপ করে অথবা ঋণ করে। বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা কিন্তু এই টাকায় তো বাজেটের টাকা পূর্ণ হচ্ছে না। তাহলে উপায়! ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ঘাটতি পূরণের উপায় ঋণ করা। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে তাই ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা আর বিদেশি ঋণ নেওয়া হবে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। এরপর অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হবে ৫ হাজার ১ কোটি টাকা। ঋণ অতীতেও নেওয়া হয়েছে। তার সুফল জনসাধারণ কতটুকু পেয়েছে তা হিসাব করা কঠিন হলেও বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঋণের সুদ বাবদ ৬৮ হাজার কোটি টাকা এ বছরই শোধ করতে হবে।

বাজেট আয়তনে বৃদ্ধি পেয়েছে যতখানি সাধারণ মানুষের প্রতি দায় কি তত গ্রহণ করেছে? ১৯৭২ সালের তুলনায় ৭৬৮ গুণ বড় এই বাজেট কৃষি, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তত বড় নয় বরং প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। জীবন ও জীবিকার প্রাধান্য দিয়ে বাজেট ঘোষণা হলেও তা সাধারণ মানুষের জীবনের ও জীবিকার প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। গত বাজেটের চেয়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা এবং সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৬৫ হাজার কোটি টাকার বেশি এই বাজেট করোনাকালীন সাধারণ মানুষের জীবনমান রক্ষা ও জীবিকার নিশ্চয়তার চেয়ে বৈষম্য বাড়িয়ে তুলবে। ভ্যাটের আওতা সম্প্রসারিত হবে মানে স্বল্প আয়ের মানুষ এবং সস্তা দ্রব্যের ক্রেতা ভ্যাট দেবেন। ধরা যাক ১০ টাকা দামের চিপসের প্যাকেটের প্রকৃত মূল্য ৮ টাকা এবং ভ্যাট ২ টাকা, এবার ভ্যাট বেড়ে ৩ টাকা হলে চিপসের দাম হবে ১১ টাকা বা ১০ টাকা দাম রাখলে ২৫ গ্রাম আলুর পরিবর্তে আলু থাকবে ২০ গ্রাম। যাই হোক না কেন, বোঝা কিন্তু সাধারণ উৎপাদক ও ক্রেতার কাঁধেই পড়বে।

কর্মহীন মানুষের জন্য খাদ্য সরবরাহ, খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা, শ্রমিক-কৃষক, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীদের জীবন বাঁচাতে রেশনব্যবস্থা চালু, শ্রমজীবীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল ও চিকিৎসায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন ছিল। যে কৃষি ও কৃষক ধান, ভুট্টা, মাছ, মাংস, সবজি, ফল উৎপাদন করে করোনাকালে দেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে, ৪২ শতাংশ শ্রমজীবীর কর্মসংস্থান করেছে সেখানে বরাদ্দ ও ভর্তুকি বাড়ানো দরকার ছিল কিন্তু বাজেটে তিন বছর ধরে কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রায় একই পরিমাণ অর্থাৎ ৯৫০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। ফলে মুদ্রাস্ফীতির বিবেচনায় কৃষিতে ভর্তুকি কমে গিয়েছে। করোনায় দেশবাসীকে বাঁচিয়ে রেখেছে কৃষি, এই কথার প্রতিফলন বাজেটে নেই। কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন কম্বাইন্ড হারভেস্টার কিনতে ২০ লাখ টাকার বেশি লাগবে, এই সহায়তা সাধারণ চাষি কীভাবে পাবে। ফলে শ্রমিক-কৃষক দেশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে আছে কিন্তু বাজেট বরাদ্দে নেই।

করোনার এত বড় ধাক্কার পরও চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ জিডিপির ০.৯৫ শতাংশ বা বাজেটের ৫.৪২ শতাংশ। গত ১২ বছর ধরে জিডিপির ১ শতাংশের নিচে রাখার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে সরকার। আবার যা বরাদ্দ হয় তার ৬০ শতাংশের বেশি দুর্নীতি সহায়ক অবকাঠামোগত খাতে খরচ বা লুটপাট হয়। চিকিৎসা খরচের ৭২ শতাংশ ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী খরচ হয়, যা জনগণকেই বহন করতে হয়। এবারের বাজেটেও সেই ধারা অব্যাহত থাকল। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম বলে তিনি বলেন, করোনায় আগের তুলনায় ২.৫ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪২ শতাংশের বেশি হয়েছে অথচ তাদের জীবনরক্ষায় প্রয়োজনীয় বরাদ্দ করা হয়নি। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে উপকারভোগীর সংখ্যা বেড়েছে ১৪ লাখ আর বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধির ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা এবং পেনশনভোগীদের জন্য টাকার বাড়তি বরাদ্দ বাদ দিলে বরাদ্দ আসলে কতটুকু বেড়েছে? রাজস্ব আয় বাড়াতে গিয়ে জনগণের ওপর ভ্যাটের বোঝা চাপালেও করপোরেট ট্যাক্স ২.৫ শতাংশ কমিয়ে দিয়ে সরকার তার ধনীদের প্রতি পক্ষপাতের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন ভালোভাবেই।

ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্প দেশের কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি। কিন্তু বাজেট বরাদ্দে তাদের অবস্থান প্রান্তিকপর্যায়ে। তারা প্রণোদনা ঠিকমতো পায়নি, বাজেটেও তাদের জন্য বরাদ্দ খুঁজে বের করা কঠিন। কমসুদে ঋণ পেলেও এরা কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করতে পারবে। গত বাজেটে কৃষিঋণের সুদ ৪.৫ শতাংশ অথচ গার্মেন্টসহ শিল্পে তা ২ শতাংশ করা হয়েছিল, কৃষিঋণের সুদ কমাতে এবারের বাজেটেও কোনো প্রস্তাবনা নেই।

৬ কোটি ৮২ লাখ শ্রমজীবীর মধ্যে করোনায় কাজ হারিয়েছে ১ কোটি ৫৬ লাখ শ্রমিক, যাদের কাজ আছে তাদের আয় কমেছে ২০ শতাংশ, কাজ না থাকায় খাদ্য ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছে ৫২ শতাংশ, রেমিট্যান্স সৈনিক বলে আখ্যায়িত শ্রমিকরা ২২.৭৫ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন বলে অর্থমন্ত্রী স্বস্তি প্রকাশ করলেও ৬ লাখের বেশি প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরেছে, তাদের জন্য কী আছে বাজেটে? প্রতি বছর শ্রমের বাজারে আসে ২২ লাখ তরুণ যুবক তাদের কর্মসংস্থানের কোনো পদক্ষেপ বাজেটে নেই। বলা হয়েছে, আইটি সেক্টরে ১০ লাখ কর্মসংস্থান হবে। এই হাওয়াই প্রতিশ্রুতি কি বাস্তবের মুখ দেখবে? যারা নিজেরা নিজেদের কাজের ব্যবস্থা করে নিয়েছেন তাদের পাশে দাঁড়ানোর কোনো প্রতিশ্রুতি ও প্রস্তাবনা বাজেটে নেই।

সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থী এবং ২০ লাখের বেশি শিক্ষক করোনাকালে বিপর্যস্ত। ছাত্রদের জন্য শিক্ষা সহায়তা এবং শিক্ষকদের জন্য দুর্যোগ ভাতা প্রয়োজন থাকলেও বাজেটে তার নির্দেশনা নেই। কিন্তু বেসরকারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট নেওয়া হবে। দেশের ২৫০০-এর মতো কলেজের মধ্যে ৩০৬টি সরকারি। ৪৮৯টি উপজেলার সব কটিতে সরকারি কলেজ নেই। মেডিকেল কলেজ ৬৫টি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৭টি। এ ছাড়া কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নাম নিয়ে চলা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক। ছাত্রছাত্রীর ৮০ শতাংশের বেশি পড়াশোনা করে বেসরকারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভ্যাট আরোপ মানে বেতন ফি বৃদ্ধি। বলা হয়েছিল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করা যাবে না। বাজেটের ফলে এসব প্রতিষ্ঠান এখন প্রবলভাবে বাণিজ্যিক হবে এবং আঘাত বাড়বে সাধারণ মানুষের জীবনে। অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং পাহাড় সমতলের আদিবাসী মানুষরা করোনায় অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিপদাপন্ন হয়েছেন। তাদের রক্ষায় কোনো বরাদ্দ ও নির্দেশনা নেই। এ ক্ষেত্রে গতানুগতিকভাবে দায়সারা গোছের ভূমিকা পালন করা হয়েছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ২০০৬ কোটি টাকা এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৩৭৭৫ কোটি বাড়ানো হয়েছে।

কালোটাকা বৈধ করার ধারাবাহিক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় যে, কালোটাকা উৎপাদনের ব্যবস্থা বহাল আছে। একদিকে বাজেটে জনগণের ওপর কর বাড়ানো, অন্যদিকে ট্যাক্সের টাকা লুটপাট করার আইনি ও রাজনৈতিক বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। কালোটাকা উৎপাদন প্রক্রিয়া যেমন ব্যাংক লুট, দুর্নীতি, চাকরি, বদলি, গ্রেপ্তার বাণিজ্য, ওভার আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধ করার পাশাপাশি কালোটাকা বাজেয়াপ্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন ছিল। অর্থনীতি সমিতি হিসাব করে দেখিয়েছিল এভাবে রাষ্ট্রের হাতে ১ লাখ কোটি টাকা আনা সম্ভব ছিল।

বিশাল বাজেটের বড় বোঝা জনগণের ওপর চাপিয়ে বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, আমলা সহায়ক এই বাজেট কৃষককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, শ্রমিককে দুর্দশায় ফেলবে, বেকারদের হতাশায় নিমজ্জিত করবে, ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্পকে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জে ফেলবে। শ্রমিক-কৃষক দেশের উৎপাদনের দায়িত্ব পালন করে কিন্তু বাজেটে তাদের প্রতি দায় পরিলক্ষিত হলো না। বাজেটে টাকা নেই এ কথা বলা যাবে না, কিন্তু বরাদ্দের ক্ষেত্রে নজর ও পক্ষপাতিত্ব যে নিম্ন আয়ের ও শ্রমজীবীদের দিকে নয়, বাজেট বিশ্লেষণের সময় এ কথা জোরেশোরেই বলতে হবে।

লেখক রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামনিস্ট

rratan.spb@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION