বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১০:২৭ পূর্বাহ্ন
পাভেল পার্থ:
একের পর এক বিপদ। করোনার দুঃসময়েই আরেক শঙ্কায় নির্ঘুম বাংলাদেশের উপকূল। উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। সোমবার রাতে লেখাটি তৈরির সময় ৭ নম্বর বিপদসংকেত চলছে। পূর্বাভাস বলছে, ১৯ মে রাত থেকে ২০ মে’র ভেতর এই ‘অতি প্রবল’ ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়তে পারে উপকূলে। বন্যা-খরার দেশে ঘূর্ণিঝড়ের এই মাতম দিনকে দিন আরও জটিল ও প্রকট হয়ে উঠছে। সমসাময়িককালে সিডর, আইলা, মহাসেন, ফণী, বুলবুলের নির্দয় স্মৃতি মুছতে না মুছতেই আবার আম্পান। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্রিয়তা ও তৎপরতা বেড়েছে। আগেরগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় বুলবুলে মানুষের প্রাণহানি কমেছে। যদিও প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ই স্থানীয় জীবনে নানামুখী দাগ রেখে গেছে। আইলায় যেমন গ্রাম-জনপদ ডুবেছে লবণজলে আবার বুলবুলে নিহত হয়েছে গাছ। ঘূর্ণিঝড়ের প্রকৃতি এবং এর স্থানীয় প্রভাব নয়, করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কীভাবে আমরা এই বিপদ মোকাবিলা করতে পারি, এমন কিছু প্রশ্ন হাজির করতে চাই এখানে।
আশ্রয়কেন্দ্র ও করোনা স্বাস্থ্যবিধি
করোনাকালের ঝুঁকি নিয়েই দুর্যোগ কমিটিগুলো সভা করেছে। আশ্রয়কেন্দ্র ও পাকা দালানের স্থানীয় বিদ্যালয়গুলো প্রস্তুত করছে। এই কেন্দ্রগুলো নারী-শিশু-প্রবীণ-বিশেষভাবে সক্ষম মানুষের জন্য কতটা উপযোগী এই তর্ক আবার তোলার সময় হয়তো এই করোনাকাল নয়। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে প্রাণিসম্পদের থাকার জায়গা নেই, তাই বুলবুলের সময় অনেক নারী তাদের হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগলকে নিয়ে নিজের ঝুপড়ি ঘরেই বাঁচার লড়াই করেছেন। করোনাকালের সুরক্ষাবিধি মানার মতো যথেষ্ট কেন্দ্রও আমাদের নেই। অন্যসময় এক একটি আশ্রয়কেন্দ্রে যেভাবে গাদাগাদি করে একসঙ্গে অনেক মানুষকে থাকতে হয়, এবার কি তা সম্ভব! আর বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রের পক্ষে কি এমন অবকাঠামোগত প্রস্তুতি আগে থেকেই নিয়ে রাখা সম্ভব? এই পরিস্থিতিতে আমাদের আশ্রয়কেন্দ্র বাড়াতে হবে। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে যোগ করতে স্থানীয় বিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠান, হোটেল কিংবা ব্যক্তি মানুষের পাকা দালানবাড়ি। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামোটি বেশ চমৎকার। স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয়ভাবে নানা কমিটি আছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির কাজ হবে স্ব-স্ব এলাকার মানুষের ঝুঁকিকে বিন্যস্ত করে তালিকা তৈরি করে ফেলা। ইউনিয়ন পরিষদের কাছে গ্রামের মানুষের ঘরবাড়ি, আয়-রোজগার ও সামাজিক অবস্থা কার কেমন, সেই হিসাব আছে। অতি বিপদাপন্ন, বিপদাপন্ন, ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিমুক্ত পরিবারদের তালিকা অনুযায়ী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এই সংকটে জায়গা করে দিতে পারে দুর্যোগ কমিটি। নানাভাবে আশ্রয়স্থল বাড়িয়েই এই করোনাকালে ‘শারীরিক দূরত্ববিধি’ বজায় রাখা সম্ভব। দুর্যোগ কমিটি, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কমিটি ও স্থানীয় যুব প্রতিনিধিরা বরাবরই ঘূর্ণিঝড়ে একসঙ্গে কাজ করেন। এখনো তারা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর দায়িত্ব ভাগ করে নিতে পারেন। সরেজমিন দেখে প্রতিটি স্থাপনায় কত পরিবার শারীরিক দূরত্ব মেনে আশ্রয় নিতে পারেন, তা এখনই ঠিক করে ফেলতে পারেন। কারণ নয়-দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আগেভাগে আশ্রয়কেন্দ্রে এসে ওঠার একটা হুড়োহুড়ি এতে সামাল দেওয়া সম্ভব। এ সময় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে আগেভাগেই। প্রতিটি কেন্দ্রে একজন স্বাস্থ্যকর্মী থাকতে পারেন। যিনি কেন্দ্রে প্রবেশের আগে সবার সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নথিভুক্ত করবেন। কেন্দ্রের প্রবেশমুখে হাত ধোয়ার উপকরণ ও প্রয়োজনীয় ওষুধ রাখা জরুরি। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকাকালীন কেউ করোনার উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে দ্রুত তাকে হাসপাতালে স্থানান্তরের জন্য ব্যবস্থা রাখতে হবে। যদি এমন ঘটনা ঘটে তবে তার সংস্পর্শে আসা সবাইকে বিধি মোতাবেক আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এই বিপদে সবাইকে আশ্রয় দেওয়া রাষ্ট্রবিধির অংশ। কিন্তু করোনাকালে এই মানবিক বিধিই হয়তো সংক্রমণ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। আমরা কেউ এমনতর বিপদের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো যেটা করতে পারে কেন্দ্রে আসা সবার পূর্বসময়ের ভ্রমণকালীন ও সংস্পর্শের ইতিহাস জানতে পারে। প্রাথমিক তথ্য ও কোনো উপসর্গভিত্তিক লক্ষণের মাধ্যমে যদি দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে করোনা-সংক্রান্ত কোনো সন্দেহ তৈরি হয়, তবে এমনদের জন্য একটি পৃথক আশ্রয়কেন্দ্র আগেভাগেই প্রস্তুত করে রাখা যেতে পারে।
করোনাকালে ঘূর্ণি-দুর্গতদের সহযোগিতা
বরাবরই আশ্রয়কেন্দ্রে কমবেশি খাদ্য সহযোগিতা থাকে। ঘূর্ণিঝড়ের পর আরও নানামুখী সহায়তা কর্মসূচি তৈরি হয়। এবার বিষয়টি কি একই রকম থাকবে? কিংবা আগের মতোই একইভাবে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় একই ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত রাখা সম্ভব? সিডর, আইলা বা বুলবুলের পর যেমন আমরা দেখেছি ত্রাণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সংস্কার, মাটিকাটা এ রকমের কাজ। যদি আম্পানেও কোনো ক্ষয়ক্ষতি ঘটে, তবে আমাদের সহায়তা কর্মসূচিকেও করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভিন্নভাবেই সাজাতে হবে। ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী এ সহায়তা জনগোষ্ঠীভিত্তিক হওয়া জরুরি, তবে স্বাস্থ্যবিধির কৌশলগুলো মানার উপায় রাখতে হবে। করোনাকালে ঘূর্ণি-দুর্গতদের খাদ্য সহযোগিতার ক্ষেত্রেও বিশেষভাবেই চিন্তা করা জরুরি। করোনাকালে যেসব খাদ্যবিধি আলোচিত হচ্ছে, ঘূর্ণি-দুর্গতদের জন্য যারাই খাদ্য সহযোগিতা করবেন, তাদের এই খাদ্যবিধি বিবেচনায় নেওয়া দরকার।
এবারও আশা সুন্দরবন
সিডর থেকে বুলবুল। বারবার নিজের জীবন দিয়ে সুন্দরবন সুরক্ষা করে চলেছে উপকূল। সুন্দরবন অঞ্চলের কথা বলেছি, এখনো বনজীবী মৌয়ালি, বাওয়ালি, জেলেদের শতভাগ আস্থা এই বাদাবনের ওপর। বুলবুলের সময়ের মতোই এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া নিয়ে একটা দোটানা আছে বনজীবী পরিবারে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনাভীতি। আমরা সুন্দরবনের সঙ্গে উন্নয়ন-বাহাদুরি করি না কেন, এই রক্ত লাগা বন আবার নিজের জীবন দিয়ে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করবে আম্পান। কিন্তু বনজীবীসহ উপকূলবাসীর করোনাভীতি দূর করে তাদের নিরাপদ সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে আইলার মতো নির্দয় প্রাণহানি ঘটতে পারে।
উপকূলের তারুণ্য ও সেন্দাই লক্ষ্যপূরণ
২০১৫ থেকে ২০৩০ পনেরো বছরের জন্য দুর্যোগ মোকাবিলায় ‘সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্ক’ নামে বৈশ্বিকভাবে দুর্যোগ সামালের এক কাঠামো তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশও এই কাঠামোর আলোকে জাতীয় দুর্যোগ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। নিত্যনতুন নানা কৌশল ও বিধি যুক্ত হচ্ছে দুর্যোগ মোকাবিলায়। মানুষ প্রতিটি আপদ-বিপদ থেকেই এক একটি নতুন বাঁচার পথ খুঁজে নেয়, যা কৌশল হয়ে সমাজে চর্চা হতে থাকে। হয়তো করোনাকালীন আম্পানও আমাদের এমন অনেক লোকায়ত জনকৌশল সামনে আনবে। কিন্তু লেখাটি শেষ করতে চাই ত্রিশ বছর বয়সী উপকূলের যুব-তরুণদের দিকে তাকিয়ে। সিডর থেকে বুলবুল মিলিয়ে এ বয়সেই যাদের সামাল দিতে হয়েছে পাঁচটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়। প্রতিটি দুর্যোগের পরই বদলে যেতে বাধ্য হয়েছে যাদের জীবন ও ইচ্ছাগুলো। আইলার পর এই গ্রামীণ তরুণদের একটা বড় অংশই লবণপানিতে কৃষিকাজ হারিয়ে ইটের ভাটায় শ্রম বেচতে বাধ্য হয়েছে। করোনাকালে আবার কাজ হারিয়ে ফিরেছে উপকূলের গ্রামে। করোনার বিপদের ভেতর আবার আম্পান, ছোট্ট এক জীবনে কত আর সয়! কাজহারা এই তরুণরা জানে না সামনে কী আছে, করোনার পর দুনিয়া কেমন হবে। জানে না আম্পানে কতটা আবার বদলে যাবে জীবন। দুর্যোগের প্রস্তুতি তখনই জোরালো হয়, যখন মানুষের সামাজিক বঞ্চনা, বৈষম্য আর আহাজারি দূর হতে থাকে, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সক্ষমতা বাড়তে থাকে। উপকূলের একটা বড় অংশ এই তরুণ যুবসমাজ। ঘূর্ণিঝড় কী করোনা মোকাবিলায় এরাই এখনো নির্ঘুম। পরিবার ও সমাজের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বিপদ ও দুর্যোগ মোকাবিলার দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি হিসেবে এই তরুণদের জন্য বিশেষভাবেই আমাদের মনোযোগী হতে হবে। সক্রিয় হতে হবে। এটিই করোনাকালীন ঘূর্ণিঝড় আম্পানের একটি জরুরি বার্তা। সুত্র:দেশ রূপান্তর।
লেখক : লেখক ও গবেষক
animistbangla@gmail.com