সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:২৮ অপরাহ্ন
মো. আব্দুল হামিদ:
পূর্বপুরুষদের চেয়ে আমাদের দৌড়ঝাঁপ বহুগুণে বেড়েছে। কিন্তু আমাদের জীবন কি সত্যিই তাদের চেয়ে অনেক বেশি সুখময় হয়েছে? যদি তা না হয়, তবে ঠিক কী অর্জনের জন্য আমাদের নিরন্তর এই ছুটে চলা, এত বেশি চাপ নেয়া?
নগরজীবনে যারা সিক্স ডিজিট স্যালারি পায়, তাদের গ্রামে বাস করা আত্মীয়স্বজন এটা বুঝে উঠতেই পারে না যে প্রতি মাসে তারা এত টাকা দিয়ে কী করে? অথচ বাস্তবে দেখা যায়, শহরে বাস করা উচ্চ আয়ের সেই ব্যক্তির প্রতি মাসে ঋণ-দেনার পরিমাণ বাড়ছে!
কেন এমনটা হয়? আসলে আজকাল আমরা অসংখ্য বস্তুকে সুখের ইন্ডিকেটর হিসেবে গ্রহণ করেছি। মনে মনে ভাবি, ওই বস্তুটার মালিক হলেই জীবন অতিশয় সুখের হবে। অথচ বিস্ময়করভাবে সেই (ফ্ল্যাট, গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ প্রভৃতি) বস্তুগুলো অর্জনের খুব স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ‘ভালো লাগা’র অনুভূতিগুলো কোথায় যেন উবে যায়!
ফলে ড্রাগের প্রভাব যেমন একটা সময় অন্তর শেষ হয়, নতুন ডোজ না নিলে অস্থির লাগে; ঠিক তেমনিভাবে নতুন সম্পদ অর্জনের টার্গেট নির্ধারিত হয়। সেটা অর্জনের জন্য শুরু হয় নতুন দৌড়। কিন্তু প্রত্যাশিত সুখ পাখিটা স্থায়ীভাবে ধরা দেয় না। কখন, কীভাবে যেন বারবার হাত ফসকে বেরিয়ে যায়!
এমনটা হওয়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? গুণীজন বলেন, আমরা ভেতরের জিনিস বাইরে খুঁজি বলেই তেমনটা হয়। কিসে আমার অন্তর সত্যিই প্রশান্ত হবে, তার খোঁজ না করে…বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের শেখানো ‘সুখের উপকরণ’ লাভের মাধ্যমে আমরা সুখী হতে চেষ্টা করি। ফলে ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’-এর চক্র থেকে কোনোভাবেই বেরোতে পারি না।
মাঝেমধ্যে কিছু খবর সত্যিই ভাবনার উদ্রেক করে। এই যেমন জর্ডানের রাজার বোন একাধিকবার প্রাসাদ থেকে পালাতে চেষ্টা করেছেন। এমনকি বর্তমান রাজার এক স্ত্রী, সন্তানসহ পালাতে গিয়ে এক পর্যায়ে ধরা পড়েছেন! আমাদের দেশেও বিত্তশালী পরিবারের আদুরে কন্যার ড্রাইভারের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা শোনা যায়। নাটক-সিনেমায় তো ধনীর দুলালীর সঙ্গে গরিব ছেলের প্রেম না হলে জমেই না! কেন অভিজাত পরিবারের সদস্যরা নিজ অবস্থানে সুখ খুঁজে পান না?
আসলে মানুষের যা বিদ্যমান থাকে, তা একসময় অভ্যাসে পরিণত হয়। সেগুলোর উপস্থিতি তাদের ‘বিশেষ’ কোনো অনুভূতি দেয় না। এটা বোঝার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো, আপনার বর্তমান ফোন সেটটি কিনে শোরুম থেকে বের হওয়ার সময় যে দারুণ অনুভূতি হয়েছিল, এখনো কি তা আছে? অবশ্যই না। বরং মাঝে মধ্যেই সেটার নানা সীমাবদ্ধতা খুঁজে পান।
ঠিক তেমনিভাবে উল্লিখিত পরিবারগুলোর সদস্যদের আপাতদৃষ্টিতে কোনো কিছুর অভাব নেই। মুখ ফুটে চাওয়ার আগেই সবকিছু হাজির। তবুও তারা সুখী হতে পারছে না। কারণ তারা এমন কোনো বিষয়কে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভাবছে, যা সেই রাজপ্রাসাদে বা পরিবারে অনুপস্থিত। সেটা হতে পারে ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’ কিংবা অন্য কিছু। ফলে বস্তুগত সুখের সব উপকরণ তারা অনায়াসে অগ্রাহ্য করতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে বাহ্যিক সম্পদ দিয়ে সুখ অর্জন সম্ভব নয়। তাছাড়া সুখী হতে নির্দিষ্ট কিছু জিনিসের অধিকারী হওয়া জরুরি নয়। তবুও আমরা বস্তুগত নানা উপাদান লাভের মাধ্যমে সুখী হতে চেষ্টা করি। অথচ দীর্ঘদিন অসুস্থ ব্যক্তি যদি এক বেলা তীব্র ব্যথা অনুভব না করেন কিংবা রাতে ভালো ঘুমাতে পারেন…নিজেকে অনেক সুখী মনে করেন! আবার বন্ধুর আকস্মিক মৃত্যুর সংবাদে মারাত্মক অসুখী হন। ফলে সুখানুভূতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা প্রায় অসম্ভব এক ব্যাপার।
তাহলে কি ‘সুখ’ অধরাই রয়ে যাবে? যদি তার নাগাল না-ই মিলবে, তবে কেন এই নিরন্তর ছুটে চলা? এটা বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। বিশেষ উদ্দেশ্যে বেশ কিছুদিন ধরে এ বিষয়ে পড়াশোনা ও পর্যবেক্ষণ করছি। যেটুকু বুঝলাম, এটা নিতান্তই মানসিক এক অবস্থা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, সুখ খুবই ক্ষণস্থায়ী! কোনো ঘটনা, দৃশ্য বা অনুভূতি আমাদের মনে বিদ্যুৎ চমকের মতো সুখের দোলা দিয়ে আবার হারিয়ে যায়। তখন হন্যে হয়ে আবার তা খুঁজতে থাকি।
সাগর সেচে মুক্তা আহরণের মতোই আমরা জীবনের সিংহভাগ সময় সুখের অনুসন্ধানে ব্যয় করি। কারো ভাগ্যে মাঝেমধ্যে জোটে, অধিকাংশ সময়ই থাকে বঞ্চিত। তবুও সুখের লাগিয়া ছুটে চলাই বুঝি জীবন। তবে হ্যাঁ, যারা অসংখ্য চাওয়ায় লাগাম দিতে শেখেন তাদের সুখী হওয়ার প্রবণতা বেশি।
বিশ্বাস না হলে লালনের মাজারে মনের আনন্দে গান করা ফকিরকে পর্যবেক্ষণ করুন। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। এমনকি রাতে কী খাওয়া হবে, সেটাও জানা নেই। অথচ কত গভীর দরদ দিয়ে সাঁইজির গান গেয়ে যাচ্ছেন, হাসি-ঠাট্টায় মেতে আছেন। চলমান ইঁদুর দৌড়কে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করার মধ্যেই বুঝি এমন সুখ নিহিত রয়েছে।
অন্যদিকে এক সপ্তাহের শাটডাউনের ঘোষণা শুনে তিন মাসের খাবার মজুদ করা লোকের সংখ্যা চারপাশে নেহাত কম নয়। দৃষ্টিভঙ্গির এত পার্থক্য হওয়ার কারণ কী? পৃথিবীর অন্য কোনো জন্তুর খাবার মজুদ থাকে না, ব্যাংক ব্যালান্স নেই, চলাচলের গাড়ি লাগে না। তার পরও তাদের জীবনে কি ছন্দপতন ঘটে? পাখির গান শুনে বা সিংহের দিবানিদ্রা দেখে কি মনে হয় তার লাঞ্চ বা ডিনারের জন্য নিশ্চিত কোনো বন্দোবস্ত নেই?
বলতে পারেন, তারা তো জন্তু, মানুষের সঙ্গে তুলনা করলে চলে? এ ব্যাপারে সেদিন ক্লাস থ্রিতে পড়া জাইন বাবুর প্রশ্ন উল্লেখ্য। সে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, বাবা, মানুষ কোন ধরনের অ্যানিমেল? প্রথমে একটু হোঁচট খেলাম। তবে প্রশ্নের উৎস বোঝার জন্য পাল্টা প্রশ্ন করলাম। তখন সে জানাল, রচনায় লেখা আছে গরু ‘ডমিস্টিক’ অ্যানিমেল আর বিড়াল ‘পেট’ অ্যানিমেল। তাই তার জানার ইচ্ছা: মানুষ কোন ধরনের ‘অ্যানিমেল’? ভেবে দেখলাম, নিজেদের জন্তু ভাবতে দোষ কী? অনেকের কাজকর্ম তো মাঝেমধ্যে হিংস্র পশুদেরও হার মানায়!
মজার ব্যাপার হলো, বেপরোয়া হওয়ার কথা ছিল যাদের পেটে ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই…এমন মানুষগুলোর। কিন্তু তারা তুলনামূলকভাবে নিরীহ। তাছাড়া সুখকেন্দ্রিক তাদের কোনো হাপিত্যেশ নেই। বরং তাদের ভাবনাজুড়ে থাকে একবেলা, বড়জোর একদিন।
কিন্তু তথাকথিত শিক্ষিত-সচেতন-সামর্থ্যবান মানুষগুলো শুধু মাস ও বছর নয়; বরং পরবর্তী জেনারেশন নিয়েও মারাত্মক উদ্বিগ্ন থাকে! ফলে গরিবদের সংকট শারীরিক আর ধনীদের মানসিক। পেটের ক্ষুধা কোনো না কোনোভাবে পূরণ করা যায় কিন্তু মানসিক ক্ষুধা শত বা হাজার কোটিতেও কি পূরণ করা সম্ভব?
ফলে ধন-সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে সুখী হওয়ার যে অন্তহীন দৌড়ে আমরা নাম লিখিয়েছি, সেখানে পরাজয় অনিবার্য। অনেকটা হাইজাম্প প্রতিযোগিতার মতো। যতক্ষণ ব্যর্থ না হচ্ছেন, বারের উচ্চতা বাড়তেই থাকবে। তাই সারা জীবন সর্বোচ্চ গতিতে দৌড়ালেও আমাদের অসুখী হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না! কারণ এর কোনো ফিনিশ লাইন নেই। একটা অর্জন হতে না হতেই আরেকটা এসে হাজির হয়। আবার শুরু হয় নতুন দৌড়!
অনেকে বলেন, সুখ হলো প্রজাপতির মতো। যতই ধরতে যাবেন, সে নাগালের বাইরে চলে যাবে। কিন্তু আপনি তার পেছনে ছোটা বন্ধ করুন, সে নিজেই আপনার কাঁধে এসে বসবে। খুব সম্ভবত সুখ হলো আমাদের ছায়ার মতো। আপনি যতই ধরতে যাবেন, সে দূরে সরে যাবে। কিন্তু আপনি তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজ গন্তব্যে চলতে থাকুন, সে আপনাকে অনুসরণ করবে।
এতদিন জানতাম, অনেক কিছু থাকলে সুখী হওয়া যায়। কিন্তু করোনাকালে অনুভব করছি থাকার সুখ খুবই সাময়িক। নতুন কেনা জামা-জুতা, ফোন-কম্পিউটার, বাড়ি-গাড়ি ইত্যাদি লাভের আকাঙ্ক্ষাগুলো সেই বস্তু হাতে পাওয়ার অতি অল্প সময়ের মধ্যেই হ্রাস পেতে শুরু করে।
পাশাপাশি সেগুলো হাতছাড়া হওয়ার ভয় মানুষকে তটস্থ রাখে। হয়তো সে কারণেই শিল্পপতিরা হাতে মাল্টিকালার আংটি পরেন। জীবিত ও মৃত অসংখ্য বাবার দরবারে নিজেকে সমর্পণ করে নিরাপত্তা খোঁজেন। এত দাপুটে ব্যক্তিরাও তাদের কাছে গিয়ে শিশুর মতো অসহায় হয়ে যান!
অথচ ‘না থাকা’র মাধ্যমে যে সুখ লাভ হয়, তা তুলনামূলকভাবে স্থায়ী। কি বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে? বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে ভাবুন, পরিবারে কারো জটিল কোনো রোগ না থাকা কতটা সুখের ব্যাপার। ঠিক তেমনিভাবে দুঃখ-কষ্ট, রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা-ঈর্ষা অসুস্থ প্রতিযোগিতার মতো বিষয়গুলোর অনুপস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে আমাদের সত্যিকারের সুখ লাভে বিশেষভাবে সাহায্য করে।
তাই সুখের পজিটিভ নাকি নেগেটিভ দিকগুলো গ্রহণ, চর্চা ও সংরক্ষণ করব, তার সুইচ অনেকটাই আমাদের হাতে। এক্ষেত্রে আব্রাহাম লিংকনের উক্তিটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, People are just as happy as they make up their minds to be.
মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘মস্তিষ্কের মালিকানা’ বইয়ের লেখক