সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:২৯ অপরাহ্ন
শাহীন হাসনাত:
ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈলে গোশত খাওয়ার লোভে গ্রামবাসীদের ধাওয়ায় একটি নীলগাইয়ের মৃত্যু হয়েছে গত মাসে। খবরে প্রকাশ, স্থানীয়দের লালসার শিকার হয়ে বিপন্ন প্রজাতির এ প্রাণীটির মৃত্যু ঘটে। নীলগাইটি কয়েক দিন ধরেই এলাকায় ঘোরাঘুরি করছিল। স্থানীয়রা এটিকে ধরার চেষ্টা করে। ফলে নীলগাইটি ছোটাছুটি করতে থাকে। একসময় নির্মাণাধীন একটি ঘরের জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে ভেতরে গিয়েই অচেতন হয়ে পড়ে। স্থানীয় পশু চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দিলেও গাইটিকে বাঁচাতে পারেননি।
সুন্দরবনে কিংবা চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকায়ও মাঝে-মধ্যে বন্যপ্রাণী লোকালয়ে এলে পিটিয়ে হত্যা কিংবা জবাই করে গোশত খাওয়ার খবর পাওয়া যায়। অবস্থা অনেকটা এমন, আশ্রয়, খাবারের সন্ধানে কিংবা পথ ভুলে কোনো বন্যপ্রাণী লোকালয়ে এলে সে আর প্রাণে বাঁচে না। লোভী মানুষ সেগুলোকে হয় মেরে খায় কিংবা পিটিয়ে মেরে ফেলে। কিছু মানুষ আছে, যাদের হাজার রকম খাবার বাদ দিয়ে নজর শুধু বন্যপ্রাণীর গোশতের দিকে। আর তাদের এই চাহিদা মেটানোর জন্য ঘৃণিত ও আইনবহির্ভূত পেশা বেছে নিয়েছে কিছু সংখ্যক শিকারি। আবার কিছু মানুষের আছে বন্যপ্রাণীর দেহাংশ সংগ্রহ করে শো-পিস হিসেবে প্রদর্শনের বদ অভ্যাস। বিশেষত হরিণ, নীলগাই, চিতাবাঘ ইত্যাদির চামড়া, হাড়, দাঁত ও মাথা ধনাঢ্যরা ড্রয়িংরুমের শোভাবর্ধনের জন্য অতি উচ্চমূল্যে সংগ্রহ করেন। প্রাণীর দেহাংশ ড্রয়িংরুমে ঝুলিয়ে রাখা কোন ধরনের মানসিকতা, তা বিবেচনার দাবি রাখে। পৃথিবীতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বন্যপ্রাণীর ভূমিকা অপরিসীম।
পবিত্র কোরআন-হাদিসে প্রাণীর বিভিন্ন অধিকার ও প্রাপ্য নির্ধারণ করা আছে। প্রাণীর শ্রেণি ও বৈশিষ্ট্যভেদে এ সম্পর্কিত বিধানে ভিন্নতা রয়েছে। ইসলাম শখের বশে, অবাধে, অকারণে কোনো প্রাণী হত্যার অনুমতি দেয়নি। কিছু প্রাণী খাওয়ার অনুমতি ইসলাম দিয়েছে, আবার জনকল্যাণ বিবেচনায় কিছু প্রাণী হত্যার অনুমতি দিয়েছে। সবকিছুর জন্য আলাদা আলাদা বিধান রয়েছে। ঢালাওভাবে কোনো আদেশ দেওয়া হয়নি।
মানুষ সৃষ্টির পাশাপাশি আল্লাহতায়ালা মানবজাতির প্রয়োজন পূরণের যাবতীয় ব্যবস্থা রেখেছেন। মানুষের কল্যাণে অসংখ্য জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন। মানুষের মতো তাদেরও রয়েছে এ ভূপৃষ্ঠে সরব বসবাস। তারা সবাই আল্লাহর সুবিশাল সৃষ্টি পরিবারের সদস্য। এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা প্রাণী সম্পর্কে বলেন, ‘ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল প্রত্যেকটি জীব এবং (বায়ুমণ্ডলে) নিজ ডানার সাহায্যে উড়ন্ত প্রত্যেকটি পাখি তোমাদের মতোই একেকটি জাতি।’সুরা আনআম : ৩৮। প্রাণীদের সুষম খাদ্য গ্রহণ, সুস্থ-সুন্দরভাবে পরিপালনে তাদের প্রতি স্নেহশীল আচরণ সৃষ্টির সেরা জাতি হিসেবে আমাদের কর্তব্য। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আহার করো ও তোমাদের গবাদি পশু চরাও। অবশ্যই এতে বহু নিদর্শন আছে বিবেকসম্পন্নদের জন্য।’ সুরা ত্বহা : ৫৪
যারা প্রাণীদের যথাযথ যত্ন নেবে এবং সেবা করবে, তাদের জন্য রয়েছে গোনাহ মাফের ঘোষণা। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবাদের এ সংক্রান্ত একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘একবার এক লোক রাস্তায় চলতে চলতে পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ল। সে একটি কূপ দেখতে পেয়ে তাতে নেমে পানি পান করল। কূপ থেকে উঠে সে দেখল, একটি কুকুর হাঁপাচ্ছে এবং পিপাসায় কাতর হয়ে কাদামাটি চাটছে। সে ভাবল, আমার যেরূপ পিপাসা পেয়েছিল কুকুরটিরও অনুরূপ পিপাসা পেয়েছে। সে আবার কূপের মধ্যে নামল এবং পায়ের মোজায় পানি ভরে তা মুখে কামড়ে ধরে উঠে এসে কুকুরটিকে পানি পান করাল। আল্লাহ তার এ কাজে খুশি হয়ে তার সব গোনাহ ক্ষমা করে দিলেন। সাহাবিরা বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এসব প্রাণীর সেবা করলেও আমাদের সওয়াব দেওয়া হবে? তিনি বললেন, প্রতিটি জীবিত প্রাণীর সেবার জন্য সওয়াব আছে।’আবু দাউদ : ২৫৫০
প্রাণী সম্পর্কিত আরেকটি বিষয় না বললেই নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা রকম রোগব্যাধি দেখা দিচ্ছে। এক সময় যা ছিল প্রাণীর রোগ, এখন তাতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বহু মানুষ এসব রোগে মারা যাচ্ছে। স্পর্শজনিত ও অন্যান্য কারণে প্রাণীর দেহে সৃষ্ট রোগের ভাইরাস মানুষের দেহে প্রবেশ করছে এবং মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। কত রোগ যে প্রাণী থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করছে, তার হিসাব নেই। একের পর এক নতুন রোগব্যাধির বিস্তার এবং তাতে মানুষের মৃত্যুর ঘটনার পেছনে, প্রাণীকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ এবং সেসব প্রাণীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও স্পর্শদোষকে দায়ী করা হচ্ছে।
মহান আল্লাহ মানুষের খাবারের জন্য কিছু জিনিস হালাল এবং কিছু জিনিস হারাম করেছেন। বলেছেন, ‘হে জনগণ, জমিনে যেসব জিনিস হালাল পবিত্র তা ভক্ষণ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না।’ সুরা বাকারা : ১৬৮। এখানে শর্ত হলো খাদ্য হিসেবে যাই গ্রহণ করা হোক না কেন, তা হতে হবে হালাল ও পবিত্র। কিন্তু দুনিয়ার অনেক মানুষ আল্লাহ কর্র্তৃক হারাম ঘোষিত ও অপবিত্র জিনিস খাদ্য হিসেবে ভক্ষণ করে। খাদ্যের ব্যাপারে অভ্যাস ও রুচির একটি দিক আছে। সেটা অনেকে মেনে চলে, অনেকে চলে না। মানুষ যদি হারাম পরিহার করে রুচিসম্মত, হালাল ও পবিত্র খাদ্যগ্রহণ করে, তবে অনেক রোগব্যাধি থেকেই রেহাই পেতে পারে, তদ্রুপ প্রাণে বাঁচতে পারে কিছু প্রাণীও।
লেখক : মুফতি ও ইসলামবিষয়ক লেখক