শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:১৫ অপরাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক:
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার চতুর্থ দফায় দ্বিতীয় দিনে তিন জন সাক্ষির সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এ নিয়ে এই মামলায় মোট ২০ স্বাক্ষীর স্বাক্ষগ্রহন সম্পন্ন হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম জানান, বুধবার সকাল সোয়া ১০ টায় জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে এ সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
তিনি জানান আজ প্রথমে স্বাক্ষী হামজালালকে ওসি প্রদীপের আইনজীবী সহ তিন আসামির আইনজীবী জেরা করেন। এছাড়া সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তাফা খান, টেকনাফ উপজেলার হোয়াইকং ইউনিয়নের লম্বাবিল গ্রামের গৃহবধূ বেবি বেগম এবং ছালেহ আহমেদ আদালতে জবানবন্দি দেন।
তিনি জানান আগামী ধার্য তারিখে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা বেবি বেগমকে জেরা করবেন। আদালত আজ বুধবার সন্ধ্যা সাতটায় মুলতবি ঘোষণা করে আগামী ১০ ১১ ও ১২ অক্টোবর এই মামলার স্বাক্ষগ্রহনের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন।
পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জানিয়েছেন, আদালতে জবানবন্দি দানকালে সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তাফা খান জানিয়েছেন ওসি প্রদীপের বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতি ক্রসফায়ারের নিউজ করায় তাকে নানা ভাবে হুমকি দেয় একপর্যায়ে সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তাফা স্বপরিবারে ঢাকায় চলে যান। ওসি প্রদীপ ঢাকার মিরপুর থেকে তাকে আটক করে কক্সবাজারে নিয়ে আসে এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখায়। এক পর্যায়ে ওসি প্রদীপ তাকে টেকনাফ থানায় নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায় তার চোখে মরিচের গুঁড়ো দিয়ে থেঁতলে দেয়। ঐ অবস্থায় তাকে কক্সবাজার সমিতি পাড়ায় তার বাসায় নিয়ে এসে চার হাজার পিস ইয়াবা, অস্ত্র এবং বিদেশি মদের বোতল ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে একে একে ছয়টি মামলা দিয়ে জেলে পাঠায়। এ সময় ওসি প্রদীপ ও তার বাহিনীর নির্যাতনে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলেও ওসি প্রদীপ বাধা দেয়।
আদালতে স্বাক্ষদানকালে গৃহবধূ বেবিবেগম জানান, ওসি প্রদীপ টেকনাফ থানায় দায়দায়িত্ব পালনকালে তার বাড়িতে ইয়াবা তল্লাশির নামে তার স্বামীকে আটক করে নিয়ে যায়। ওসি প্রদীপ তাদের কাছে ৪০ লক্ষ টাকা দাবী করে। তারা ১৫ লক্ষ টাকা দিলেও ওসি প্রদীপ তাকে ছাড়েনি। পরে তার মেয়েকেও আটক করে থানায় আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণ করে। এক পর্যায়ে তার মেয়েকে ইয়াবা মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে জেলে পাঠায়। এসব বিষয়ে তৎকালীন পুলিশ সুপারকে বিচার দিতে গেলে ওসি প্রদীপ কৌশলে তাকেও গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। জেল খানায় তার মেয়ের সাথে দেখা হলে তার মেয়ের উপর শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণের কাহিনি তাকে জানায়।
একই এলাকার দিনমজুর ছালেহ আহমেদও আদালতে জবানবন্দি দানকালে ওসি প্রদীপের ক্রসফায়ারের নানা কাহিনি তুলে ধরেন।
এর আগে গত ২৩ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত মামলার প্রথম দফার সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। এতে সাক্ষ্য দেন মামলার বাদী ও সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস এবং ২ নম্বর সাক্ষী ঘটনার সময় সিনহার সঙ্গে একই গাড়িতে থাকা সঙ্গী সাহেদুল সিফাত। পরে দ্বিতীয় দফায় ৪ দিনে চারজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। তৃতীয় দফায় ৩ দিনে পর্যন্ত ৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।
আজ বুধবার সকাল সাড়ে ৯ টায় কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে ওসি প্রদীপ সহ মামলার ১৫ আসামিকে প্রিজেন ভ্যান করে কড়া পুলিশ পাহারায় আদালতে আনা হয়।
পিপি ফরিদুল বলেন, মামলায় সাক্ষ্যদানের জন্য ৮৩ জন সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত ২৯ জনকে আদালত নোটিশ দিয়েছিলেন। গত ২৩ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত তিনদিনে মামলার বাদী ও ২ নম্বর সাক্ষি জবানবন্দি প্রদান করেন। মামলায় দ্বিতীয় দফায় চারদিনে ৪ জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। তৃতীয় দফায় তিনদিনে সাক্ষ্য নেয়া হয় সিনহার মৃতদেহের ময়নাতদন্তকারি চিকিৎসকসহ ৮ জন প্রত্যক্ষদর্শীর। চতুর্থ দফায় মোট সাতজন আদালতে তাদের জবানবন্দি দিয়েছেন।
গত বছর ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।
এ ঘটনায় গত বছর ৫ আগস্ট সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত সাবেক ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় লিয়াকত আলীকে। আদালত মামলার তদন্ত ভার দেয়া হয় র্যাবকে।
ঘটনার ৬ দিন পর ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকতসহ ৭ পুলিশ সদস্য আত্মসমপর্ণ করেন।
ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় একটি এবং রামু থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করেন।
পরে র্যাব পুলিশের দায়ের মামলার ৩ সাক্ষি এবং শামলাপুর চেকপোস্টে দায়িত্বরত আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ানের (এপিবিএন) এর ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় টেকনাফ থানা পুলিশের সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মাকে। সর্বশেষ গত ২৪ জুন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন টেকনাফ থানার সাবেক এএসআই সাগর দেব।
গত বছর ১৩ ডিসেম্বর র্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়ানের তৎকালীন দায়িত্বরত সহকারি পুলিশ সুপার খাইরুল ইসলাম ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।
গত ২৭ জুন আদালত ১৫ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এতে সাক্ষি করা হয় ৮৩ জনকে।
ভয়েস/আআ