সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০১:১৪ পূর্বাহ্ন
মো.মিকাইল আহমেদ:
বায়ুদূষণ বিশ্বমহামারীর রূপ নিয়েছে।দূষিত বায়ুর মধ্যে থাকলে একজন মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।বায়ুদূষণের সংযোগ রয়েছে ফুসফুসের অসুখ, ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের মতো মারাত্মক সব রোগের সঙ্গে যে কারণে একে ‘নতুন ধরণের ধূমপান’ বলা হচ্ছে।বিজ্ঞানীদের একটি নতুন গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঘরের বাইরের দূষিত বাতাস কারণে মানুষের আয়ু গড়ে প্রায় তিনবছর পর্যন্ত কমে যাচ্ছে যা আগের যেকোনো গবেষণা ফলাফলের চেয়ে বেশি এবং এমনকি ধূমপানের ফলে যে পরিমাণ আয়ু কমে তার চেয়েও বেশি।
নানাবিধ পরিবেশ দূষণের মধ্যে সর্বাধিক ক্ষতিকর বায়ু দুষণ। নির্মল ও পরিষ্কার বায়ু অনিবার্য আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য তাই বায়ুর গুণমান বজায় রাখা ছাড়া অার কোন উপায় নেই। বিশ্বব্যাপী আনুমানিক যে ৭ মিলিয়ন মানুষ প্রতি বছর মারা যায় বায়ু দূষণের কারণে এর মধ্যে ৪ মিলিয়ন মানুষের বসবাস এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। বায়ু দূষণের ফলে মৃত্যুবরণকারী নব্বই ভাগেরও বেশি মানুষ বাস করে গরীব দেশগুলোতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বে প্রতি ১০ জনের মধ্যে প্রায় ৯ জন মানুষই শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যবহার করে মাত্রাতিরিক্ত দূষিত বায়ু।
কার্ডিও ভাসকুলার রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পৃথিবীতে যুদ্ধসহ সবধরণের সংঘাতে প্রতি বছর মানুষের আয়ু যতটা কমে তার চেয়ে প্রায় দশগুণ বেশি গড় আয়ু কমে বায়ুদূষণের ফলে।বিজ্ঞানীরা বলছেন, ধূমপানের ফলে হওয়া মৃত্যুর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে বায়ুদূষণের কারণেহ ওয়া প্রতি বছর মৃত্যুর হার।এজন্য ২০১৫সালে মানুষের গড় আয়ুও মৃত্যুর হার গণনা করে তারা দেখতে পেয়েছেন যে বায়ুদূষণের কারণে পৃথিবীতে ৮৮ লাখ মানুষ মারা যায়।বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থার দেয়া হিসাব অনুযায়ীধূমপানেরকারণেপ্রতিবছর৮২লাখেরবেশিমানুষমারাযায়।গবেষণায় অারও বলা হয়, ৭০লাখের বেশি মানুষ মারা যায় সরাসরি সিগারেট এবং তামাক জাতপণ্যের ব্যবহারের কারণে।
বায়ুদূষণের সঙ্গে মানুষের গড় আয়ুর বিষয়টি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে কিনা কমেছে সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত।লাইফ ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, সারাবিশ্বে বায়ুদূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু কমেছে ২.২বছর। গবেষকেরা মনে করেন, নির্মল বায়ুর জন্য স্থায়ী কোনো নীতি যেটি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে পারে সেটা গড় আয়ু বাড়ানোর পাশাপাশি জল বায়ুর ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে।গবেষকেরা এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে চীনকে উল্লেখ করে বলছেন, চীনারা ২০১১ সালের তারা যে নীতিগ্রহণ করেছে তাতে তাদের গড় আয়ু বেড়েছে ২.৬বছর।
বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি কর প্রভাব পড়ে শ্বাসতন্ত্রের উপর।যার ফলে হাঁপানি, ফুসফুসের কাশি ছাড়াও লাংক্যানসার, স্ট্রোকের সমস্যা দেখা দেয়।সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হয় ইট ভাটার কারণে।দিনদিন ইট ভাটার সংখ্যাবৃদ্ধি পাচ্ছে। অারসেই সাথে পাল্লাদিয়ে বাড়ছে বায়ুদূষণের মাত্রা।বায়ুদূষণের একটা বড় কারণ জীবাশ্মজ্বালানি।গণপরিবহন ব্যবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই।গণপরিবহন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমানো সম্ভব হবে না অার এধরনের জ্বালানির ব্যবহারও কমবেনা।
গবেষকরা অারও বলছেন, গতকয়েক দশকে ধূমপানের তুলনায় বায়ুদূষণের দিকে মনোযোগদেয়া হয়েছে অনেক কম।তারা মনে করেন, জীবাশ্মজ্বালানি নির্গমন যদি শূন্যে নামিয়ে আনা যায় তাহলে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাবে।গবেষণায় আরো দেখাগেছে বায়ুদূষণের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সমূহ জাতীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে পড়ছে বেশি।যেমন পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে গড় আয়ু চার বছরের মতো হ্রাস পেয়েছে যেখানে গড় আয়ু সবচেয়ে কম হ্রাস পেয়েছে ওশেনিয়াতে। বায়ুদূষণের প্রভাব একেক দেশে একেক রকম হয়।বায়ুদূষণেরে কারণে আফ্রিকার চাঁদে গড় আয়ু কমেছে সাত বছরের বেশি, অন্যদিকে কলম্বিয়াতে কমেছে চার মাসের কিছু বেশি সময়।বায়ুদূষণের কারণে বয়স্করা থাকেন সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঝুঁকিতে।স্বাস্থ্যঝুঁকি ও বয়স্কদেরই বেশি।বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, হৃদরোগের কারণে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় অার এরপরেই রয়েছে ফুসফুসের সংক্রমণ, তাই বায়ু দূষণের কারণে মৃত্যুর ক্ষেত্রে বয়স্ক ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।
সাম্প্রতিক সময়ে অামরা দেখেছি ভারতের রাজধানী দিল্লিতে জনস্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগের মুখে জরুরি অবস্থা জারি করেছে দেশটির প্রশাসন। এমনকি সেখানে কয়েকদিন স্কুল পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। লোকজনকে ঘর থাকতে সতর্ক করা হয়েছে। শ্বাসজনিত রোগে হাসপাতালগুলোতে হাজার হাজার রোগীর ভিড় জমেছে। কারণ দিল্লি বায়ুদূষণের দিক থেকে বসবাসের অযোগ্য একটি শহর। দূষিত বাতাসের কারণে এসব ঘটছে। ভারতের রাজধানী দিল্লির বাতাস হচ্ছে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত। দিল্লিকে এখন বলা হয় ‘গ্যাস চেম্বার’। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ছয়টি নগরীর পাঁচটিই উত্তর ভারতে। তাই উত্তর ভারতে দিল্লিই একমাত্র নগরী নয় যেখানে বায়ু দূষণ এত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।গ্রীনপীসের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ৩০টি নগরীর ২২টিই ভারতে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে মাত্রার দূষণকে বসবাসের জন্য গ্রহণযোগ্য বলে মনে করে ভারতের নগরীগুলোতে দূষণের মাত্র তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি। বিশ্বে প্রতি বছর ৭০ লাখ মানুষ অপরিণত বয়সে মারা যায় বায়ু দূষণের কারণে।
বায়ু দূষণের দিক দিয়ে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা একদম পিছিয়ে নেই। ক্রমশই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে প্রাণের শহর ঢাকাও। ঢাকা শহরে বায়ু দূষণের মাত্রা দিন দিন কেবল বাড়ছেই। ঢাকা, দিল্লির মতো জনবহুল এ নগরীগুলো এখন যে ধোঁয়াশায় ঢেকে আছে তার কারণে সেখানে মানুষের মধ্যে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার, ডায়াবেটিস এবং আরও অনেক ধরণের ক্রনিক ফুসফুসের রোগ বেশি হারে হচ্ছে। উত্তর ভারতের এই বায়ু দূষণের কারণে সমতলভূমির ভারতের প্রতিবেশি নেপাল এবং বাংলাদেশও ব্যাপক ঝুঁকিতে আছে। কারণ এই ধোঁয়াশা আর ধূলিকণা সেখানে চলে যেতে পারে পশ্চিম দিক থেকে আসা বাতাসে ভর করে।
বায়ু দূষণ মানুষের হৃদপিণ্ডের রক্তনালীর ক্ষতি করে অক্সিডেটিভ চাপ বাড়িয়ে যা পরে উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক হার্ট-অ্যাটাক এবং হার্ট-ফেল, ডায়াবেটিসের মতো মারাত্মক রোগের কারণ হয়ে ওঠে। বায়ু দূষণ সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্যই বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।বায়ু দূষণ যে নতুন ধূমপান এটি এখন কোন আর গোপন কথা নয়। সুতরাং জনস্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের অারও সিরিয়াস হবার সময় এসেছে।বায়ু দূষণের অর্থনৈতিক প্রভাবও নেহাত কম নয়। বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয় । তাছাড়া ধারণা করা হচ্ছে গ্রাউন্ড-লেভেল ওজোন-দূষণের কারণে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীর প্রধান ফসলগুলোর উৎপাদন ২৬ শতাংশ হারে হ্রাস পাবে।
পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে পরিবেশ রক্ষায় সারাবিশ্বেই বায়ুমণ্ডল এর সার্বিক অবস্থা ক্রমাগতভাবে অবনতি হচ্ছে। নগর পরিবেশ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে জনবহুল শহরগুলোর অবস্থা শোচনীয়। দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে শহরগুলো। অাকাশচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণে বিশ্বের ধনী দেশগুলো যতটা মনোযোগ দিচ্ছে তার ছিটেফোঁটাও দিচ্ছে না বায়ুদূষণ রোধে। দালানের পর দালানে ছেয়ে যাচ্ছে শহরগুলো। নগরায়ন ও শিল্পায়নে পরিবেশ বান্ধব গাছপালা কেটে উজাড় করা হচ্ছে। পরিবেশ দূষণের জন্য প্রধানত দায়ীঅনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণের সাথে সাথে অপরিকল্পিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন।সবশেষে, কবিরভাষায়বলতেহয়, ‘দাওফিরেসেঅরণ্য, লওএনগর।‘
লেখক: মো.মিকাইল আহমেদ
শিক্ষার্থী, আইসিএমএবি,ঢাকা।
ইমেইল: mekailahmed117@gmail.com