রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫৪ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

উন্নতি চরমে তবু আমরা নিরাপদে নেই

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী:

উন্নতি আকাশ ছুঁই ছুঁই, কিন্তু ভেতরে মানুষ নিরাপদে নেই। নিরাপদে থাকছে না। উন্নতির ফ্লাইওভারে কাটা পড়ছে মানুষের হাত-পা; নিচে রয়েছে অন্ধকার, খানাখন্দ, বিপদ-আপদ। শিক্ষাক্ষেত্রে ওই যে আমাদের গর্বিত অগ্রযাত্রা, সেখানে মান বাড়ছে না; কিন্তু বাড়ছে ঝরে-পড়াদের সংখ্যা; যাদের খবর আমরা রাখি না। প্রয়োজন মনে করি না রাখার। রাখলে দেখতাম গত দুই বছরের করোনার তৎপরতায় শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ যে ঝরে পড়বে সেটা নিশ্চিত। আর যারা সামর্থ্যরে আনুকূল্যে শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্ত থাকবে তাদের ভবিষ্যতের বিষয়েও শঙ্কা দেখা যাচ্ছে। তারা কোথায় যাবে, কোন অন্ধকারে থাকবে, কী করবে কে জানে।

মাদ্রাসায় যে লাখ লাখ কিশোর-কিশোরী ‘শিক্ষিত’ হচ্ছে তাদের ভবিষ্যৎটাই বা কী? বিষয়টি নিয়ে ইংরেজি দৈনিকে এক ভদ্রমহিলা কলাম লিখেছেন। তিনি চিন্তিত। কাগজে পড়েছেন যাত্রাবাড়ী থেকে কাঁচপুর এই ৮ কিলোমিটার জায়গার মধ্যে ৬৮টি মাদ্রাসা রয়েছে, যার ৬৬টিই কওমি মাদ্রাসা যাদের পাঠ্যসূচি রক্ষণশীল ও গোঁড়া প্রকৃতির। তিনি জানতে পেরেছেন যে গত ৫০ বছরে দেশে মাদ্রাসার সংখ্যা ১৩ গুণ বেড়েছে। সে তুলনায় প্রাইমারি স্কুল বেড়েছে যৎসামান্য। চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে তার নিজের বসবাস। সেখানে একশ’ বছরের পুরনো একটি প্রাইমারি স্কুল আছে, যেখানে তার পিতামাতা পড়েছেন, পড়েছেন ভাইবোনেরা, এখন পড়ছে তার ছেলে। কিন্তু প্রাইমারি স্কুল ওই একটাই। মাদ্রাসা বলা যায় অসংখ্য। প্রাইমারির প্রসার নেই, প্রসার যত মাদ্রাসার। একটা উন্নতির খবর অবশ্য তার লেখাতে রয়েছে। সেটি হলো তাদের শতবর্ষী স্কুলটির আগে নাম ছিল প্রতাপপুর প্রাইমারি স্কুল, নামের আধুনিকীকরণ ঘটিয়ে সেটা এখন হয়েছে সিদ্দিকনগর প্রাইমারি স্কুল। উন্নতি না বলে উপায় কী? তবে এলাকায় ঘুরতে গিয়ে যে সত্যটি তাকে আঘাত করেছে সেটি, তার ভাষায় ‘উন্নতির তুমুল নিনাদের মধ্যে এই বাস্তবতা যে স্কুলের শিক্ষকরা আন্তরিক, কিন্তু তাদের বেতন অপর্যাপ্ত এবং ছাত্রছাত্রীরা আগ্রহী কিন্তু তারা অনাহারী।’ এ প্রশ্নটা অবশ্য তিনি করেননি যে মাদ্রাসায় শিক্ষিতরা তাদের শিক্ষা নিয়ে করবেটা কী? কোথায় তাদের কর্মসংস্থান হবে? তারা কি বেকার হয়ে ঘুরবে? লুম্পেন হবে? হতাশ হয়ে নাম লেখাবে জঙ্গিদের দলে?

এ প্রশ্নটা যদি করা হয় তবে মাদ্রাসা শিক্ষা কেন এভাবে বেড়ে উঠেছে সে-জিজ্ঞাসাটা উঠবে, এবং তার জবাব খুঁজতে খুঁজতে হয়তো এই স্থূল সত্যটার কাছে পৌঁছে যেতে হবে যে এই শিক্ষা বঞ্চিত মানুষকে বঞ্চিত রাখার একটি ষড়যন্ত্র বৈ অন্য কিছু নয়। বঞ্চিতরাই তাদের ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পাঠায় এবং মাদ্রাসা থেকে শিক্ষিত হয়ে বঞ্চনার পুরনো শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েই থাকে। ব্যবস্থাটা এই রকমেরই। একশ’ বছর আগেও এরকম কথা সমাজমনস্ক কেউ কেউ বলেছেন যে, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রয়োজন নেই, ধর্ম শিক্ষা ছেলেমেয়েরা বাড়িতেই নেবে, স্কুলে আসবে তারা ইহজাগতিক শিক্ষা নিতে, যে-শিক্ষা কাজে লাগবে, যে-শিক্ষা সাহায্য করবে জাগতিক উন্নতিতে। একশ’ বছর আগে আমরা ছিলাম ইংরেজদের অধীনে, তারপরে গেলাম ইসলামওয়ালা পাকিস্তানিদের অধীনে, এখন তো আমরা পুরোপুরি স্বাধীন, কিন্তু একশ’ বছর আগে মাদ্রাসা শিক্ষার উপযোগিতা নিয়ে যে জিজ্ঞাসা তৈরি হয়েছিল এখন তা নেই, অথচ এখন তো আমরা নিজেরাই শাসন করছি নিজেদের। আসলে সবাই নই, শাসন করছে অল্পকিছু মানুষ; এবং তারাও স্বাধীন নয়, তারা অধীনে রয়েছে এমন একটি ব্যবস্থার যেটি আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি পরিশুদ্ধ প্রকারের পুঁজিবাদী।

আকাশজয়ের আগে সমুদ্রজয়ের কাহিনীটা বেশ প্রচার পেয়েছিল। তা সমুদ্র-যুদ্ধে কাকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ? মনে হয় মিয়ানমারকে। মিয়ানমার কি এখন সেই পরাজয়েরই শোধ নিচ্ছে তাদের নিজেদের ভূমিতে যত রোহিঙ্গা ছিল প্রত্যেককে গুনে গুনে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে? আশঙ্কা করা গিয়েছিল যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে স্থায়ীভাবেই রয়ে যাবে, আশঙ্কা মনে হয় মিথ্যা প্রমাণিত হবে না। কারণ যতই আকাশ জয় করুক বাংলাদেশ, তার রাজনীতিক ও কূটনীতিকদের এমন ক্ষমতা নেই যে বিশ্বময় তুমুল হৈ চৈ বাধাবে, বিশ্ববাসীকে ও আন্তর্জাতিক সব সংস্থাকে ডেকে বলবে ওই গণহত্যার মর্মান্তিক অন্যায়ের ব্যাপারে, মিয়ানমারকে বাধ্য করবে তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে। আমাদের পরম মিত্র প্রতিবেশী ভারত; কিন্তু রোহিঙ্গা প্রশ্নে সে সাড়া দেয় না, বরং তাদের এলাকায় যেসব রোহিঙ্গা আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে তাদের ঠেলে দিতে চায় বাংলাদেশের দিকে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হামেশাই ঘোষণা দিতে ভালোবাসেন যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক পদ্মা, মেঘনা, যমুনার মতো চিরপ্রবহমান; অথচ ভারতের কল্যাণেই আমাদের নদীতে আজ পানি নেই, আমাদের দৈনিকের শিরোনাম হয় ‘ইলিশের পদ্মায় বালুর রাজত্ব’। ওটা যে শতভাগ সত্য তাতে তো কোনোই সন্দেহ নেই।

এমনকি আমাদের আকাশজয়ের গৌরবেও তো মনে হয় কিছু কিন্তু টিন্তু আছে। উপগ্রহটি তৈরি করেছে একটি ফরাসি কোম্পানি, উড়িয়েছে একটি আমেরিকান কোম্পানি, কক্ষপরিসর ভাড়া দিয়েছে রাশিয়া, টাকাটাই যা আমাদের। তা টাকার পরিমাণও যে খুব কম তাও নয়, তিন হাজার কোটি টাকার মতো। ওড়ানোর কাজ ৫৬টি দেশ আমাদের আগেই সাঙ্গ করেছে। এই উপগ্রহ জীবিত থাকবে মাত্র পনের বছর, উপগ্রহটির কর্মপরিধি মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাবে না, যার অর্থ এর আবির্ভাবের দরুন মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর কোনো উপকার হবে না। আরও শোনা যাচ্ছে যে এর অতিরিক্ত বাণিজ্যিক সেবাক্ষমতা কারা পাবে তাও পূর্বাহ্নেই নির্ধারিত হয়ে রয়েছে।

ওদিকে আকাশ যে আমাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করছে তাও তো নয়; খরা ও অতিবর্ষণ দু’টোই বাড়ছে। বায়ুদূষণ তো রেকর্ডই ভাঙছে। তথ্য বলছে আমাদের প্রাণপ্রিয় রাজধানী ঢাকা শহর বায়ুদূষণের দিক থেকে এখন সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয়। ভারতের রাজধানী দিল্লি একটু এগিয়ে আছে ঠিকই, প্রথম স্থানে রয়েছে; তবে ভরসা করা অন্যায় হবে না যে উন্নতির বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই আমরা দিল্লিকে হারিয়ে দিতে পারব। পুঁজিবাদ কাকে বলে মহাচীনের মানুষও এখন বেশ ভালোভাবেই টের পাচ্ছে, সে-দেশের অন্যান্য সূচকের মধ্যে বায়ুদূষণের সূচকটাও নাড়াচাড়া দিচ্ছে। দূষণের বিশ্বমাপে চীনের বেইজিং এবং সাংহাই পিছিয়ে নেই, ইতিমধ্যেই তারা সসম্মানে পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি এই সংবাদটিও মোটেই তাৎপর্যহীন নয় যে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে প্রাণ দ-াদেশ পেয়েছিলেন, মওকুফ করে সেটিকে যাবজ্জীবন শাস্তিতে নামানো হয়েছে। দুর্নীতি ও বায়ুদূষণ কিন্তু পরস্পরের অপরিচিত নয়; খোঁজ নিলে জানা যাবে একই পরিবারের সদস্য তারা, যমজ ভ্রাতাও বলা চলে।

কত আগে, সেই ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভগবানের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন “যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো। তুমি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, বেসেছো তাদের ভালো?” ভগবান এখন আর তেমন একটা কার্যকর নন, বিপন্ন মানুষদের প্রার্থনার প্রয়োজনেই যা একটু কাজে টাজে লাগেন; তার জায়গাতে রাষ্ট্র এসেছে, আর রাষ্ট্র নিজেই যখন অপরাধী হয়ে বসে আছে তখন কার জবাব কে দেয়। বস্তুত রাষ্ট্রকে এখন ভগবান বলা কঠিন, শয়তান বলাটা বরং সহজ।

লেখক ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION