রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪৮ অপরাহ্ন
রাউফুন নাহার:
আত্মহত্যা, আত্মহত্যার চেষ্টা, প্রবণতা বা চিন্তাভাবনা স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। এটি সরাসরি কোনো মানসিক রোগ না হলেও বেশ কিছু মানসিক রোগের শক্তিশালী উপসর্গ। ফলে একজন ব্যক্তি আত্মহত্যার আগে নিজের সম্পর্কে, অন্যের সম্পর্কে বা পৃথিবী সম্পর্কে যেভাবে চিন্তাভাবনা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সেটি সবসময় যৌক্তিক বা পূর্ণাঙ্গ চিত্র নাও হতে পারে। কোনো একটি পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক, সেই পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এক বা একাধিক বিকল্প থাকে। কিন্তু মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত ও বিপর্যস্ত অবস্থায় মানুষের মস্তিষ্কের আবেগীয় অঞ্চল যতটা উদ্দীপ্ত থাকে, যৌক্তিক অঞ্চল ততটাই নিষ্ক্রিয় থাকে। ফলে সেই মুহূর্তে মানুষ সমস্যা সমাধানের যৌক্তিক ও সহায়ক রাস্তাগুলো দেখার বা আবিষ্কার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে এবং মস্তিষ্কের আবেগীয় অঞ্চল দ্বারা তাড়িত হয়ে এলোমেলো কিংবা জীবন বিপন্নকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে।
অতি সম্প্রতি একজন প্রবীণ নাগরিকের আত্মহত্যার যে দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটেছে সেটি হজম করা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে কঠিন। সেই সঙ্গে এই ঘটনাটি প্রবীণ নাগরিকদের শারীরিক, মানসিক, আবেগীয় ও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এসব বিষয়ে আলোকপাত করার আগে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, মৃত্যুর আগে তার বলা কয়েক মিনিটের কথার ভিত্তিতে তার জীবন, মৃত্যু এবং পরিবার সম্পর্কে গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢালাওভাবে মন্তব্য করাটা বোধ হয় তার এবং তার পরিবারের প্রতি অবিচারই হচ্ছে। তার পরিবারের মানুষগুলো বেঁচে আছে এবং তারা এক ধরনের মানসিক চাপ ও শোকের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তারা যদি কোনোভাবে দায়ী বা দোষী হয়েও থাকে এই মুহূর্তে শোক পালন এবং আবেগীয় নিরাপত্তার অধিকার তাদের আছে। প্রতিটি মানুষেরই মানসিক স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ।
আর আমাদের বাকস্বাধীনতার বিষয়ে বলব, শুধু আত্মহত্যা কেন, যে কেউ যেকোনো কিছু নিয়ে কথা বলার অধিকার রাখে। সেই সঙ্গে এও সত্যি, একটি ঘটনাকে বিশেষ করে আত্মহত্যার মতো সংবেদনশীল ঘটনাকে কেন্দ্র করে বলা আমাদের অনুমাননির্ভর কথা কিংবা আবেগীয় প্রতিক্রিয়াগুলো অন্য কাউকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে কি না সে বিষয়ে ভাববার এবং দায়িত্বশীল হওয়ার প্রয়োজন আছে। একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা সবার মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, আর নিজের অনুভূতি ও ভাবনা শেয়ার করলে সেই চাপ কিছুটা কমে বলেই হয়তো অনেকেই সেই বিষয়টি সম্পর্কে নিজের অনুভূতি, চিন্তাভাবনা বা উপলব্ধিগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে। এতে দোষের কিছু নেই। মুশকিল হলো, আত্মহত্যা নিয়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা তথ্যভিত্তিক কথা বললে সচেতনতা বাড়ে, অন্যদিকে আত্মহত্যাকে মহিমান্বিত কিংবা দোষারোপ করে মনগড়া কথা বললে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা মানুষের মনের ওপরে ভীষণ রকমের চাপ পড়ে। এতে করে তাদের আত্মহত্যার ঝুঁকিও বাড়ে।
একজন মানুষের আত্মহত্যার কারণ নির্ণয় কিন্তু খুব সরল কোনো বিষয় নয়। মানুষের জীবন অন্বেষণে কাউন্সেলর হিসেবে আমরা বেশ কিছু তত্ত্বের সহযোগিতা নিয়ে থাকি, তার মধ্যে অন্যতম একটি তত্ত্ব হলো এরিক এরিকসন (১৯৬৩) প্রদত্ত মনোসামাজিক বিকাশ তত্ত্ব যেখানে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের মনোসামাজিক বিকাশের ৮টি ধাপের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ একজন প্রবীণ ব্যক্তি তার জীবনের অষ্টম ধাপে রয়েছেন, আর জীবনের এই অষ্টম ধাপটিতে এসে তিনি মানসিকভাবে প্রশান্তিতে থাকবেন নাকি হতাশায় থাকবেন তা শুধু এই অষ্টম ধাপের যোগ বিয়োগের ফলাফল নয়। বরং জীবনের প্রথম ধাপ (জন্ম থেকে) থেকে এই হিসাব-নিকাশের শুরু। ফলে সম্প্রতি যে আত্মহত্যার ঘটনাটি ঘটেছে সেটিকে নিছক ‘সমাজে বয়স্ক লোকের দৈন্যদশা’, ‘অবহেলা’, ‘পরিবারের মানুষের নিষ্ঠুরতা’ ইত্যাদি বলে ন্যায্য মনে করার সুযোগ কম। শারীরিক অসুখের মতো তিনি মানসিক কোনো অসুখেও ভুগছিলেন এবং অবশ্যই তার চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল। আর যেকোনো মানসিক রোগের কারণ নির্ণয় জটিল একটি বিষয়। এখানে একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ বড় একটি প্রভাবক। সবার জীবনেই যুদ্ধ থাকে। যুদ্ধ এবং দুঃখ-দুর্দশা মানব জীবনের অংশ। আমি আমার যুদ্ধটাকে কীভাবে দেখছি, তা মোকাবিলায় আমার কাছে কী ধরনের যুদ্ধনীতি, কৌশল বা হাতিয়ার আছে তার ওপর নির্ভর করবে আমি আমার যুদ্ধটিকে কোনদিকে এবং কীভাবে পরিচালিত করব। আর জীবনকে দেখার চোখ এবং জীবনকে চালিয়ে নেওয়ার কৌশল দুটিই আমাদের ব্যক্তিত্ব ও বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত।
এবারে আসি প্রবীণ নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে। আমার একটি বইয়ে (মনের যত্ন) বিশেষ সময়ে মনের যতœ বলে একটি অধ্যায় রয়েছে। সেখানে বিশেষ সময়ের মধ্যে বয়ঃসন্ধি, মাতৃত্বকাল, মেনোপজ এবং বার্ধক্য বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে। সেখানে বার্ধক্য বিষয়ক অধ্যায়টির নাম ‘বার্ধক্য বরণ’। হ্যাঁ, বার্ধক্যকে বরণ করার বা গ্রহণ করার একটি ব্যাপার রয়েছে যা অধিকাংশ প্রবীণ ব্যক্তিদের জন্য কঠিন। ক্রমশই ঢিলে হতে থাকা ত্বক, ক্ষয় হতে থাকা দাঁত, নাজুক হতে থাকা শরীরকে গ্রহণ করে নেওয়া কঠিন; তার থেকেও বেশি কঠিন কর্র্তৃত্ব বা ক্ষমতার চাকাটিকে উল্টো ঘুরতে দেখা।
আমি এ পর্যন্ত যতজন প্রবীণ ব্যক্তিকে একক কাউন্সেলিং বা পারিবারিক কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে মানসিক সহায়তা দিয়েছি অধিকাংশ ক্ষেত্রে খেয়াল করেছি, যেসব পরিবারে অভিভাবকরা কর্তাব্যক্তি হিসেবে সন্তানদের মতামতকে অগ্রাহ্য করেছেন, দমিয়ে রেখেছেন, শাস্তি প্রদান করেছেন; সেসব পরিবারের সন্তানরা পরিণত বয়সে এসে বয়স্ক পিতা-মাতাকে যতœ ও আন্তরিক সহযোগিতা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক একদিনের নয়। শুরু থেকেই এই সম্পর্ক আন্তরিক থাকলে হঠাৎ করে পিতা-মাতার বার্ধক্যে এসে এই সম্পর্ক তিক্ত হয়ে যাওয়ার কথা নয়। এ কারণেই মানসিক স্বাস্থ্যে শিশুবিকাশ এবং প্যারেন্টিং ব্যাপারগুলো এতটা গুরুত্ব পেয়েছে। শৈশব-কৈশোরে যারা শর্তহীন ভালোবাসা পেয়ে বড় হয়, পরিণত বয়সে তারাই আবার শর্তহীন ভালোবাসা প্রদান করে। সেইসঙ্গে সন্তানরা পরিবারে যে ধরনের নেতৃত্ব দেখে বড় হয়, ক্ষমতার যে ধরনের প্রয়োগ দেখে বড় হয়, তারা তা-ই শেখে এবং পরিণত বয়সে এসে পরিবারের নেতৃত্বপ্রদান ও ক্ষমতা প্রয়োগের সময় তারাও একই ধরনের আচরণ করে। উল্লেখ্য, ক্ষমতা ব্যাপারটি নেতিবাচক নয়। কীভাবে আমরা তা প্রয়োগ করছি তার ওপর নির্ভর করে এর ফলাফল। নন-ভায়োলেন্ট কমিউনিকেশনের প্রতিষ্ঠাতা মার্শাল রোজেনবার্গের মতে (২০০৩) ক্ষমতার চর্চা কিংবা বলপ্রয়োগ দুই ধরনের হতে পারে: ১। ক্ষমতার সুরক্ষামূলক চর্চা (Protective use of force), ২। ক্ষমতার শাস্তিমূলক চর্চা (Punitive use of force)। যেমন, পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করার জন্য বা অল্প বয়সে প্রেম করার জন্য, বা বাবা-মায়ের অপছন্দের কারও সঙ্গে প্রেম করার জন্য যখন সন্তানকে মারধর করা, তিরস্কার করা বা বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয় সেটিকে ক্ষমতার শাস্তিমূলক চর্চা বলা যেতে পারে। এই ধরনের চর্চা বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের আন্তরিক সংযোগ স্থাপনে বাধা সৃষ্টি করে, ফলে সন্তানরাও পরিণত বয়সে এসে বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করে না, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষমতার পালাবদলের পর সন্তানরা বাবা-মায়ের প্রতি শাস্তিমূলক আচরণও করে বসে।
আরেকটি বিষয় হলো যেসব বাবা-মা সন্তানের মানবিক গুণ বিকাশের বিষয়ে কোনো তোয়াক্কা না করে শুধু পড়ালেখা বা ক্যারিয়ায়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করে, সেইসব সন্তানরাই হয়তো পরবর্তী সময়ে ক্যারিয়ার গঠনের দৌড়ে বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতে শেকড়ের কাছে ফেরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অর্থাৎ দেখা যায়, সন্তান বড় করার ক্ষেত্রে বাবা-মা যদি মমতা ও ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগ করেন, খুব সম্ভাবনা থাকে সন্তানও বাবা-মায়ের প্রতি তেমনই আচরণ করবে। বাবা-মা হিসেবে সন্তান পালনে যেমন ভালোবাসা, মায়া, মমতার পাশাপাশি সন্তানের সুরক্ষার জন্য কিছুটা ক্ষমতা চর্চা বা নিয়ন্ত্রণ রাখার প্রয়োজন হয়; সন্তান হিসেবেও তেমনি বয়স্ক বাবা-মায়ের খেয়াল রাখার জন্য ভালোবাসা, মায়া, মমতার পাশাপাশি বাবা-মায়ের সুরক্ষার জন্য কিছুটা ক্ষমতা চর্চার প্রয়োজন হয়। যেমন, বয়স্ক বাবা-মা সুষম খাবার গ্রহণ, শরীরচর্চা, বা শারীরিক ও মানসিক অসুখের চিকিৎসার বিষয়ে অনিচ্ছা পোষণ করলে কিছুটা বলপ্রয়োগ করে হলেও এই ব্যাপারগুলো নিশ্চিত করা দরকার।
বয়স্ক পিতামাতার খেয়াল রাখা সন্তান পালনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বাবা-মা হিসেবে তারা যেমনই হোক, প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে সন্তানের দায়িত্ব রয়েছে বাবা-মায়ের শারীরিক ও মানসিক টানাপড়েনগুলোকে বুঝবার এবং সহযোগিতা প্রদান করবার। প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে চাইলেই আমরা মমতার চর্চা শুরু করতে পারি এবং ক্ষমতার শাস্তিমূলক ব্যবহারের দুষ্ট চক্রটিকে ভেঙে দিতে পারি। অর্থাৎ চাইলেই আমরা বাবা-মায়ের প্রতি রাগ-অভিমানের দেয়াল টপকে তাদের প্রতি মমতাশীল হয়ে উঠতে পারি এবং প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে আমাদের যে ক্ষমতা রয়েছে তা তাদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োগ করতে পারি। এক্ষেত্রে নিজের জন্য মানসিক সহায়তা প্রয়োজন হলে কাউন্সেলরের শরণাপন্ন হতে পারি, বাবা-মায়ের জন্যও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারি, এমনকি পারিবারিক কাউন্সেলিং সেবাও নিতে পারি।
লেখক সহকারী অধ্যাপক, এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলোজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়