মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৩৫ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

মিথ্যার নানা রূপ

মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম:
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা সত্যকে অবলম্বন কর। কারণ সত্যবাদিতা ভালো কাজে উপনীত করে। আর ভালো কাজ উপনীত করে জান্নাতে। মানুষ সত্য বলে ও সত্যবাদিতার অন্বেষায় থাকে, একপর্যায়ে সে আল্লাহর কাছে সত্যবাদী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে যায়। আর তোমরা মিথ্যা থেকে দূরে থাক। কারণ মিথ্যা উপনীত করে পাপাচারে। আর পাপাচার উপনীত করে জাহান্নামে। ব্যক্তি মিথ্যা বলে ও মিথ্যার অন্বেষায় থাকে, এভাবে একসময় আল্লাহর কাছে সে চরম মিথ্যুক হিসেবে লিখিত হয়ে যায়।’ সহিহ্ মুসলিম : ২৬০৭

বর্ণিত হাদিসের অর্থ একেবারেই সরল, মর্ম খুবই প্রাঞ্জল। অর্থাৎ সত্যবাদিতা যেমন একটি ভালো গুণ, তার বৈশিষ্ট্য হলো মানবজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এটি ভালো প্রভাব সৃষ্টি করে, ভালোর দিকে পরিচালিত করে। ফলে লোকটির ঠিকানা হয় জান্নাত। পক্ষান্তরে মিথ্যা খোদ একটি মন্দ ও ঘৃণিত স্বভাব। সেই সঙ্গে তার একটি মন্দ প্রতিক্রিয়া হলো এটি মানুষের মধ্যে পাপাচার ও অবাধ্যতার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করে। পুরো জীবন অন্যায় ও অনাচারে কলুষিত করে তোলে। ফলে তার পরিণতি হয় জাহান্নাম।

মিথ্যার রয়েছে বহুক্ষেত্র। ইসলামি শরিয়তে সবিস্তারে মিথ্যার পরিধি বর্ণনা করা হয়েছে। এমন কিছু মিথ্যা আছে, যেগুলোকে অনেকসময় মিথ্যাও মনে করা হয় না। ইসলাম সেগুলো থেকেও বেঁচে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। নিম্নে মিথ্যার অবহেলিত কিছু দিক তুলে ধরা হলো

যাচাই-বাছাই ছাড়া কথা বলা ও প্রচার : এটি মিথ্যার একটি সূক্ষ্ম রূপ, যাচাই-বাছাই ছাড়া শোনা কথা বলে বেড়ানো। কারণ এর মাধ্যমে অনায়াসেই একটি ভুল তথ্য সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে কোরআন বলছে, ‘হে মুমিনরা! কোনো ফাসেক যদি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবসত কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি না করে বস! ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদের অনুতপ্ত হতে হয়।’ সুরা হুজুরাত : ৬

হাদিসে এসেছে, ‘কারও মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে (কোনো বাছ-বিচার ছাড়া) তাই প্রচার করতে থাকে।’ সহিহ্ মুসলিম : ৫

বলাবাহুল্য, অসাবধানতা, অসতর্কতা, যাচাই-বাছাই ছাড়া দ্বীনের ব্যাপারে বেপরোয়া ও বল্গাহীন কোনো কিছু প্রচার না করা। সেই সঙ্গে যেসব কথায় সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে, সম্প্রীতি বিনষ্ট হতে পারে সেসব যাছাই-বাছাই ছাড়া প্রচার না করা। তাই, ইসলামি স্কলারদের পরামর্শ হলো সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে মুখরোচক, আতঙ্ক কিংবা উদ্বেগজনক কিছু শুনেই তা প্রচারের বিষয়ে সতর্ক থাকা।

সাক্ষ্য প্রদানে মিথ্যা : ইসলামে সত্য সাক্ষ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এর মাধ্যমে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে সামান্য হেরফেরের মাধ্যমে অন্যের ওপর বড় ধরনের জুলুম হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় অন্যের সম্পদ আত্মসাতের মতো ভয়াবহ গোনাহ সংঘটিত হয়, মিথ্যা সাক্ষ্যের কারণে। তাই ইসলাম সত্য সাক্ষ্যের প্রতি উৎসাহিত করেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। যে তা গোপন করে, অবশ্যই তার অন্তর পাপী।’ সুরা বাকারা : ২৮৩

মিথ্যা সাক্ষ্য অনেক বড় গোনাহ। এর মাধ্যমে অনেকসময় নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার হয়। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বড় (কবিরা) গোনাহগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।’ সহিহ্

বোখারি : ২৬৫৩

ব্যবসায় মিথ্যা : ব্যবসা হালাল উপার্জনের একটি উত্তম উপায়। কেউ যদি ব্যবসা করে এবং আল্লাহ ও তার রাসুলের দেওয়া বিধি-বিধান পালনের পাশাপাশি সততা ও আমানতদারি রক্ষা করে, এর মাধ্যমে দুনিয়াতে যেমন তার জন্য রয়েছে শান্তিও সমৃদ্ধি, পরকালেও রয়েছে অনেক মর্যাদা ও পুরস্কার। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী (আখেরাতে) নবী-রাসুল, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।’ জামে তিরমিজি : ১২০৯

ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেক সময় খুব সাধারণভাবেই মুখে মিথ্যা চলে আসে। অনেক মিথ্যার ধরন এমন, ‘ভাই! মাত্র পাঁচ টাকা লাভ করছি! আপনাকে কেনা দামেই ছেড়ে দিচ্ছি! এটাই সবচেয়ে ভালো কোম্পানির; এর চেয়ে ভালো আপনি আর কোথাও পাবেন না! ’ ইত্যাদি বাক্য মুখে মুখে থাকে! অথচ এখানে কেবল কী মিথ্যা? ধোঁকা, প্রতারণা ও খেয়ানতের মতো বড় বড় অনেকগুলো গোনাহের সমাবেশ ঘটে! বিশেষত ধোঁকা ও প্রতারণার বিষয়টি তো একেবারে স্পষ্ট।

মিথ্যা বলে গ্রাহককে ত্রুটিযুক্ত পণ্য ধরিয়ে দেওয়াও পাপ। হাদিসে এসেছে, ‘এটা অনেক বড় খেয়ানত যে, তুমি তোমার ভাইকে কোনো কথা বলছ, সে এটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে নিচ্ছে, অথচ তুমি এতে মিথ্যাবাদী।’ মুসনাদে আহমাদ : ১৭৬৩৫

মিথ্যা প্রতিশ্রুতি : ব্যক্তিগতভাবে একে অপরকে, অনেক সময় রাজনৈতিকভাবেও জনগণকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। যাকে কেবল কবিরা গোনাহ নয়, হাদিসে মুনাফিকের স্বভাব বলা হয়েছে। হাদিসে মুনাফিকের একটি নিদর্শন বলা হয়েছে, ‘মুনাফেকের একটি নিদর্শন হলো, ওয়াদা করে ভঙ্গ করে।’ সহিহ্

মুসলিম : ১০৭

শিশুদের সঙ্গে মিথ্যা : বাচ্চাদের সঙ্গে কৌতুক, তাদের মন ভোলানো কিংবা তাদের কান্না থামানোর জন্য তাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও প্রলোভন দেওয়া হয়। যা কেবল গোনাহ নয়, আরও অনেক ক্ষতি ডেকে আনে। এর মাধ্যমে শিশুর কোমল অনুভূতিতে মিথ্যার মতো অপরাধকে হালকা করে দেওয়া হয়, তার স্বভাবে মিথ্যা অনুপ্রবেশের রাস্তা খুলে দেওয়ার পাশপাশি প্রকারান্তরে এই অপরাধের প্রতি উৎসাহিত করা হয়। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এখানে সুন্দর একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। নবী যুগের ঘটনা। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমের (রা.) বলেন, একদিন হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। তখন আমি ছিলাম ছোট্ট শিশু। খেলতে বের হচ্ছিলাম। আম্মা আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, এদিকে এসো, তোমাকে একটি জিনিস দেব। তখন হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আম্মাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তাকে কী দেওয়ার ইচ্ছা করেছ? আম্মা বললেন, আমি তাকে একটি খেজুর দেওয়ার ইচ্ছা করেছি। নবীজি (সা.) বললেন, মনে রেখো! যদি তুমি তাকে কিছু না দিতে, তাহলে তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যার গোনাহ লিখে দেওয়া হতো।’ সুনানে আবু দাউদ : ৪৯৯১

বন্ধুদের সঙ্গে মিথ্যা : বন্ধুদের আড্ডা ও হাস্যরসের আসরগুলো যেন মিথ্যা ছাড়া জমে না। রসিয়ে রসিয়ে এবং মিথ্যার মিশেলে যে যত সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারে এবং বন্ধুদের হাসাতে পারে, সে তত বাহবা পায়! হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘ধ্বংস তার জন্য, যে মানুষকে হাসানোর জন্য কথা বলার সময় মিথ্যা বলে! ধ্বংস তার জন্য! ধ্বংস তার জন্য!’ মুসনাদে আহমাদ : ২০০৪৫

আরও কিছু মিথ্যা : এখানে মিথ্যার কিছু রূপ তুলে ধরা হলো। এছাড়া মিথ্যার আরও বহু ক্ষেত্র ও রূপ রয়েছে। অর্থাৎ মিথ্যা যেমন হতে পারে কথায়, তেমনি হতে পারে লেখায়ও। বিশেষ করে গণমাধ্যমে। এছাড়া জাল সার্টিফিকেট, মিথ্যা প্রত্যয়নপত্র, মিথ্যা দলিলপত্র ও সনদপত্র ইত্যাদি সবই এর আওতাভুক্ত। আমাদের উচিত, সব ধরনের মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকা।

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION