রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫৪ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ভালোবাসা কারে কয়

গাজী তানজিয়া:
স্লাভয় জিজেকের মতে, ‘ভালোবাসা ব্যাপারটা চরম দুর্ভাগ্যের মতো, একটা ভয়ংকর পোকার মতো, এমন একটা স্থায়ী জরুরি অবস্থা, যা সব ধরনের ছোটখাটো আনন্দ উপভোগ করাকে নষ্ট করে দেয়।’ আবার তিনি যে ভালোবাসা থেকে দূরে থাকেন বা থাকতে পারেন তাও কিন্তু নয়। তবে তিনি যাকে ভালোবাসেন তার মতে তাকে উদ্ধত আর তিক্ততার স্বাদ দিয়ে তা প্রকাশ করেন। আর প্রাচীন মনীষী অতীশ দীপঙ্কর বলেছেন, “পৃথিবীতে ‘প্রেম’ নামক একটি শব্দমাত্র আছে ভগবান। কিন্তু তার বাস্তব অর্থ নেই। সংগ্রাম আছে, ক্ষুদ্র সুখ আছে, বিপুল দুঃখ আছে, অভিযান আছে, রাজ্য জয় আছে, কিন্তু ‘প্রেম’ নেই। হৃদয়ে হৃদয়ে সংযোগ সাধনের কোনো সূত্র নেই, তন্তু নেই, জরাবেষ্টিত পৃথক পৃথক রক্ত কুমুদের মতো মনুষ্যকুল ও জীবকুলের হৃদয়গুলো বিচ্ছিন্নভাবে সংসারের জলতলে ভাসমান।”

তাহলে পৃথিবীতে আসলেই কি প্রেম বলে কিছু নেই। শুধুই কি মোহ, মায়া আর পিটুইটারির ক্ষরণ? তাহলে প্রেম নিয়েই বা এত কিছু, এত গান, গল্প, কবিতা, চলচ্চিত্র টিকে আছে কী করে? প্রেম প্রতিটি মানুষের ভেতরে এক শক্ত ভিত নিয়ে বসে আছে বলেই তো মনে হয়। আপাতদৃষ্টিতে আমরা তার দেখা পাই না ঠিকই। কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো তার দৃশ্যমান অস্তিত্ব নেই, তবে প্রেম যে আছে, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। যদিও প্রেম নিয়ে নানা মুনির নানা মত, নানা দৃষ্টিভঙ্গি। তা ভেঙে ভেঙেই আজ আগাতে হবে বলে মনে হচ্ছে।

বিখ্যাত লেখক গোগল তার গরৎমড়ৎড়ফ নামের গল্পগ্রন্থে প্রেম বিষয়ে নিজস্ব একটা অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। যার প্রতিপাদ্য এই যে, তিনি এক যুবককে চিনতেন যিনি এক মেয়েকে কিশোরকাল থেকে ভালোবাসতেন এবং যৌবনে তাকে বিয়ে করে সুখে সংসার পাতেন। তাদের দাম্পত্য সুখ এমন ছিল যে এলাকার সবাই তাদের সবচেয়ে সুখী দম্পতি মনে করত। কিন্তু একসময়ে স্ত্রীটি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং স্বামী তাকে যথাসাধ্য সেবা-শুশ্রুষা করেও বাঁচিয়ে রাখতে ব্যর্থ হন। স্ত্রী-বিয়োগের পর তার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন চিন্তিত হয়ে পড়েন যে যুবক আবার আত্মহত্যা করে না বসে! তাই আত্মহত্যা করতে পারে এমন সব সম্ভাব্য অস্ত্রশস্ত্র তার কাছ থেকে সরিয়ে রাখা হলো। দিন ১৫ পর যুবক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলো, কাজকর্মে যোগ দিল, বন্ধুদের সঙ্গে সামান্য হাসি-ঠাট্টাও করল। কিন্তু কয়েক দিন পর সে গোপনে একটা পিস্তল কিনে আনে এবং আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে। কিন্তু সে যাত্রায় সে না মরে ফিরে এলো। এর কিছুদিন পর সে আবারও গাড়ির নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে একটা হাত ও পা প্রায় অকেজো করে বেঁচে রইল। ক্রমাগত শোকের বেদনা ও বড় বড় দুটি অপঘাতের ক্ষতি সহ্য করে যুবক যেন আরও নি®প্রাণ হয়ে পড়ল। এরপর এক বছরকাল গোগলের সঙ্গে তার দেখা নেই। এক দিন শহরের এক বড় অভিজাত ক্লাবে গোগলের সঙ্গে সেই যুবকের দেখা হলে গোগল তাকে চিনতে পারলেন না। তার যৌবন যেন বান মুখে করে ফিরে এসেছে। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে তাস খেলছে, তার হাস্যোজ্জ্বল মুখ যেন আনন্দে ঝলমল করছে, আর তার কনুই ধরে এক যুবতী তরুণী বসে আছে, যে আর কেউ নয় সেই যুবকের দ্বিতীয় স্ত্রী!

তাহলে প্রেম কি কোনো স্থায়ী বিষয় নয়! প্রেম কি সদা প্রবহমান? চোখের অলক্ষ্যে প্রেম ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে? আর বেঁচে থাকে শুধু ভালোবাসা নামের এক অলীক অনুভব! নাকি সে সময়ের স্রোতে বিলীয়মান কোনো অনুভবেরই নাম শুধু! ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুযায়ী প্রেম যৌনতার অপর নাম হলেও মন নামের এক অস্তিত্বের কথাও তো তিনি বলেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে পাশ্চাত্য দেশে মনকে আবিষ্কার করার প্রবণতা জন্মলাভ করেছিল। আর ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে সিগমুন্ড ফ্রয়েড প্রমাণ করে দিলেন যে জীবাত্মাই বলো আর পরমাত্মাই বলো মানুষের ধর্ম বলো আর ভাগ্য বা পুরস্কার বলো সবকিছুরই গাঁটছড়া বাঁধা রয়েছে ওই মনের কাছে। ‘আমার মন’ বললেও আমার আমিত্বটুকুর প্রায় ষোলোআনাই এই মনের মধ্যে বিরাজ করছে। আর বাইরে যদি খানিকটা ‘আমি’ পড়ে আছি বলে মনে হয়, তাহলে সেটা মনের দোষ নয় আমার মনে করার দোষ। সেই মনের নাগাল পাওয়া সহজ নয় বটে, কিন্তু পেলে জীবনের অনেক প্রহেলিকা সরল-সহজ হয়ে যায়। কিন্তু ডাক্তার পাভলভ, ফ্রোলব, ওয়াটসন প্রমুখ মনীষীরা মনকে এক রকম অস্বীকার করে বসে আছেন। তারা মনের অস্তিত্ব স্বীকার করতে নারাজ। একদিকে বাহ্য পরিবেশ ও অন্যদিকে মস্তিষ্ক, নার্ভতন্তুসমূহ, রসগ্রন্থিসমূহ ও পেশিসমূহ দিয়েই মানুষের জীবনের সব চেষ্টা, জ্ঞান ও ভাবধারা উদ্ভূত হয় বলে তারা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন।

আর এ যুগে এসে বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে জীবনমুখী গানের হোতারাও প্রেমকে শুধু পিটুইটারি গ্রন্থির ক্ষরণ বলে উড়িয়ে দিতে চাইছেন। ভাগ্যিস পৃথিবীতে লেখক বলে এক সম্প্রদায়ের বাস আছে, নইলে প্রেম-ভালোবাসা তো কবেই ফুরিয়ে যেত! ভালোবাসা প্রবলভাবে আছে বলেই তো দস্তয়েভস্কি বলতে পারেন, ‘নরক হলো ভালোবাসতে না পারার যন্ত্রণা।’ একই সঙ্গে জীববিজ্ঞানীদের মতে মন তো আছেই, মন না থাকলে মনন থাকবে না চিন্তাবৃত্তি থাকবে না। তবে এই মনের একচ্ছত্র অধিপতি শুধু মানুষই না কোনো কোনো জীববিজ্ঞানীর মতে মানুষ ছাড়াও স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখির মধ্যে মন বিরাজমান। সুতরাং ‘মানুষ আমি আমার কেন পাখির মতো মন’ এই কথারও তাৎপর্য আছে। সেখানে যৌনতার জন্য প্রেম থাকুক বা প্রেমের জন্য যৌনতা। মূলত জৈবিকতার অপর নাম প্রেম বা ভালোবাসা, যা একসময় বহু সাধুর কাছে পরিত্যাজ্য বা অশ্লীল হলেও পল থেকে প্লেটো, দান্তে থেকে গ্যেটে, ঘোসা থেকে নিটশে, কালিদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ, সুনীল থেকে হুমায়ূন সবাই পুলকিত অন্তরে প্রেমের জয়গান গেয়েছেন।

তাই তো গ্যেটে অশীতিপর বয়সে এসে বললেন, ‘The eternal feminine holds us’ যেখানে তিনি একজন প্রেমস্পদা নারীকেই শুধু উদ্দেশ্য করছেন না, বরং পুরুষের সামনে নারী রূপিণী চিরন্তনী প্রেমিকা শক্তিকেও উপলব্ধি করছেন। যে নারী শুধু জায়া বা জননী রূপে বিরাজ করেন না বরং ঘরের বাইরে পুরুষকে মহত্তর বা স্থায়ী সৃষ্টির উন্মাদনায় মাতিয়ে তুলতে সাহায্য করে। প্রেমিকার এই রূপকে শেকসপিয়ার থেকে শোপেনহাওয়ার, রাশফুকো থেকে রবীন্দ্রনাথ, মার্কেজ থেকে মুরাকামির মতো মনীষীরা স্বীকার করেছেন নির্দ্বিধায়।

ফ্রয়েডের মতে, ‘সচেতন মনের কাজ অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ও গতানুগতিক। এর অনুভব ও মনন নিয়ন্ত্রিত হয় ব্যক্তিগত বুদ্ধি, মস্তিষ্ক, ইন্দ্রিয় ও পারিপার্শ্বের দ্বারা। জগতের সঙ্গে লেনদেন করতে এই সচেতন মন সচেষ্ট থাকে, যা চিনতে মানুষের বেগ পেতে হয় না।’ কিন্তু মনের গভীরে যার বাস, সেই অস্তিত্বের খোঁজে ছুটেছেন ফ্রয়েডও। আর এই অচেতন বা নিরজ্ঞান মনের অস্তিত্বের খোঁজ শুধু ঊনবিংশ শতকের বিজ্ঞানীরা নন কবি-লেখকরাও খুঁজেছেন। ওই একই সময়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমি কান পেতে রই আমার আপন হৃদয় গহন-দ্বারে/কোন গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে।’ ভালোবাসা আসলে কী, তার বিশালতা বা ব্যাপ্তি কী, কী তার যাতনা, কী তার বেদনা সে কথা হয়তো স্বয়ং কবি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন কখনো কখনো। তাইতো বলেছেন, ‘সখি ভালোবাসা কারে কয়’!

শেষে এ কথা স্বীকার করতেই হয় আমাদের সচেতন মনই সবটা নয়। বরং তার ভেতরের ভাব-রসই আমাদের আবেগ ও প্রেমের দায়। তাই তো একটা সম্পর্ক কোনো কারণে ভেঙে গেলে, আরেকটা নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আবেগগত ও ইন্দ্রিয়গত আনন্দের স্মৃতিকে তো খুন করা যায় না, বরং তাকে স্মরণের নিম্নতর স্তরে সরিয়ে রাখা যায়। বরং সচেতনে যে প্রেম ফিরে এলো তার একটা দৈহিক আশ্রয় চাই।

কবি নজরুলের ভাষায় বলতে হয় :

‘প্রেম সত্য, প্রেম-পাত্র বহু-আগণন/তাই-চাই, বুকে পাই, তবু কেন কেঁদে ওঠে মন।/মদ সত্য, পাত্র সত্য নয়,/যে-পাত্রে ঢালিয়া খাও সেই নেশা হয়। …প্রেম এক প্রেমিকা সে বহু/বহু পাত্রে ঢেলে পিব সেই প্রেম/সে শরাব লোহু।’

নজরুলের এই কটি পঙ্ক্তি ক্যাসানোভা ও ডন জুয়ানের মনোবৃত্তির প্রতিধ্বনি নয়, বরং লাখ লাখ আন্তরিক প্রেম সাধকের অজ্ঞাত অন্তর্মথিত বাসনার প্রতিবিম্ব। তাহলে প্রশ্ন হলো, বিজ্ঞানের সর্বোন্নত পর্যায়ে এসে প্রেম-ভালোবাসার সেই চিরন্তন আবেদন কি হারিয়ে গেছে? হারিয়েছে কী হারায়নি তার চেয়ে বলতে হয় আরও বিস্তৃত পরিসরে এখন তার অবস্থান।

এখানে প্রেম শুধু অনুভূতিতে নয়, আছে বাণিজ্যের অনুষঙ্গ হিসেবেও। তাই তো সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন তার প্রেমের জন্য উৎসর্গ করা জীবন নিয়ে ভালোবাসার বাণিজ্যিক প্রসারে ব্র্যান্ড আইটেম হয়ে বসে আছেন। প্রযুক্তি ও বাণিজ্য প্রেমকে আরও বিস্তৃত ও ব্যাপক পরিসরে হাজির করেছে। পৃথিবীর কোনোখানে প্রেম আর রাখ-ঢাকের বিষয় নেই। ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে অফারের পর অফার এসে হাজির হচ্ছে। সেখানে প্রেম কতটা আছে? বাণিজ্যের এই ডামাডোলে পড়ে তাই এখন আবার একবার ফের জানতে ইচ্ছে হয়Ñ ‘সখি ভালোবাসা কারে কয়?’

লেখক কথাসাহিত্যিক

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION