রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৫৬ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

দুই নির্বাচনের ভিন্ন ফল, দুই দলের ভিন্ন চরিত্র

রুমিন ফারহানা:
হিটলারের প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী গোয়েবলসকে আমরা সবাই চিনি। তিনি মিথ্যা বলতে এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে ‘গোয়েবলসীয় মিথ্যা’ বলে একটি প্রবাদই তৈরি হয়েছে। কেউ যখন অতি দক্ষতার সঙ্গে একই মিথ্যা বারবার বলে সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারে, তখন তাকে আমরা গোয়েবলস বলে ডাকি। এই মিথ্যার মজাটা হলো, মিথ্যাবাদী নিজেই একসময় নিজের বলা মিথ্যা বিশ্বাস করতে শুরু করে। এই যেমন বিএনপির আমলে পরপর পাঁচবার বাংলাদেশের দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়াÑ আওয়ামী লীগের খুব প্রিয় ‘গোয়েবলসীয় মিথ্যা’র একটি। বাংলাদেশ দুর্নীতিতে প্রথম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ‘গৌরব’ অর্জন করে ২০০১ সালে। ওই বছরের প্রায় পুরোটা সময় ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। তাই বাংলাদেশের ওই বছরের আমলনামার পেছনে একমাত্র ভূমিকা ছিল আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগ যখন ২০০১-এ ক্ষমতা ছেড়ে যায়, তখন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের স্কোর ছিল ১০-এ ০.৪, অর্থাৎ একেবারে তলানিতে। এর পরের চার বছর বিএনপির শাসনামলে পরিস্থিতির অভূতপূর্ব উন্নতি হয়। ২০০২ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্কোর ছিল যথাক্রমে ১.২, ১.৩, ১.৫ ও ১.৭। আর ২০০৬ সাল, বিএনপি সরকারের শেষ বছর বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২, অর্থাৎ ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার সময় দুর্নীতি রোধে পাঁচ গুণ উন্নতি করে যায় বিএনপি। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল বিএনপির পুরো সময়টি ব্যয় হয়েছে বীভৎস দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে। অথচ ক্রমাগত ‘গোয়েবলসীয় মিথ্যা’ দিয়ে আওয়ামী লীগ দেশের অনেক মানুষকে বিএনপির বিরুদ্ধে এই তথ্য বিশ্বাস করাতে পেরেছে এবং সম্ভবত নিজেরাও একপর্যায়ে এটি বিশ্বাস করতে শুরু করেছে।

আওয়ামী লীগের আরেকটি অতি পছন্দের ‘গোয়েবলসীয় মিথ্যা’ হলো ১৫ ফেব্রুয়ারি নিয়ে তাদের ব্যাখ্যা। আলোচক হিসেবে ‘টক শো’তে নিয়মিতভাবে যাই। নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই প্রতিপক্ষে বসা আওয়ামী লীগের আলোচক নিশ্চিতভাবেই টেনে আনেন ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কথা। সেই নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া, ভোটার উপস্থিতির নিচু হার এবং ‘জনগণের প্রতিরোধ’ নিয়ে আলাপ করেন তারা। অথচ এই নির্বাচনই ২১ বছর পর আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করেছিল।

যে আওয়ামী লীগ ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে দলীয় সরকারের অধীনে অভূতপূর্ব নির্বাচনের আয়োজন করেছে, যেখানে সরকার গঠনের জন্য মানুষের ভোটের কোনো প্রয়োজন পড়েনি, তারাই ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপনির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলেছিল। আজ আওয়ামী লীগ আর তার সঙ্গী-সাথীদের যে জামায়াতবিরোধিতা দেখা যায় তখন তা ছিল না। সম্ভবত তখন আওয়ামী লীগের চোখে তারা যুদ্ধাপরাধীও ছিল না। জামায়াতের সঙ্গে সমস্যার সূত্রপাত ঘটে যখন তারা ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। মজার ব্যাপার হলো বিএনপি কেন যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতের সঙ্গে আছে সে প্রশ্ন আওয়ামী সুশীলরা হরহামেশাই তুলে থাকেন। কিন্তু যে প্রশ্নটি তারা ভুলেও কখনো করেন না তা হলো জামায়াতকে কেন নিষিদ্ধ করা হয় না। জামায়াতের বিষয়ে খুব যৌক্তিকভাবেই বিএনপির প্রশ্ন হলোÑ আজ যদি তারা জামায়াতকে ছেড়ে দেয় তবে কাল যে আওয়ামী লীগ তাদের জোটে নেবে না সে নিশ্চয়তা কে দেবে? আওয়ামী লীগের যে রাজনৈতিক চরিত্র তাতে এই সন্দেহ অমূলক নয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার জামায়াতের ব্রেন চাইল্ড। ১৯৮৩ সালে জামায়াত এক জনসভায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ফর্মুলা দিয়েছিল। এর ঠিক ১১ বছর পর ১৯৯৪ সালের জুন মাসে একটি সম্ভাব্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা প্রকাশ করে আওয়ামী লীগ। এরপর ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে ইসলামীসহ রাজনৈতিক দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেওয়ার জন্য ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএনপি সরকারের জন্য সময় নির্ধারণ করে দেয়। সে সময় জামায়াত এবং আওয়ামী লীগের পারস্পরিক বোঝাপড়া ছিল চমৎকার।

বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে দাবি মানা হয়নি এই কারণ দেখিয়ে, ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর সংসদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীর ১৪৭ জন সংসদ সদস্য। কিন্তু পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে স্পিকার শেখ আবদুর রাজ্জাক তাদের অনুপস্থিত হিসেবে বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত দেন। অনুমতি ছাড়া অনুপস্থিতির ৯০ কার্যদিবস পূরণ হওয়ার পর সংবিধানের বিধি মোতাবেক ১৯৯৫ সালের ৩১ জুলাই সংসদীয় আসনগুলো শূন্য ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ স্পিকার তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন যাতে আওয়ামী লীগসহ অন্য দলগুলো সংসদ বর্জন না করে। শেষ পর্যন্ত সংসদ কার্যকর রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা বিএনপি করলেও আওয়ামী লীগের অসহযোগিতা, অসহিষ্ণুতা এবং সর্বোপরি যুদ্ধংদেহী মনোভাবের জন্য তা আর সম্ভব হয়নি।

এরপর ওইসব আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করে সরকার ও নির্বাচন কমিশন। কিন্তু বিরোধী দলগুলো উপনির্বাচনও বর্জনের ঘোষণা দেয়। আওয়ামী লীগের প্রবল অরাজকতা এবং সহিংসতার মুখে ১৯৯৫ সালের ২৪ নভেম্বর ৫ম জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করে তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।

যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আওয়ামী লীগের এত জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন, ১৭৬ দিন হরতাল, অফিসগামী যাত্রীকে দিগম্বর করা, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে ছিল না। সংবিধানে এই ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্তির জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দেয় আর যার জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন। ১৯৯১-৯৬ সালের সংসদে বিএনপির আসন ছিল ১৪০টি, যা সংবিধান সংশোধনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। সে কারণেই ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত বিল সংসদে পাস করতে হলে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য বিরোধী দলগুলোর সমর্থন প্রয়োজন ছিল সরকারের। কিন্তু তাদের সদস্যরা এরই মধ্যে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন, আর অন্যদিকে পঞ্চম জাতীয় সংসদের মেয়াদও শেষ হয়ে যাচ্ছিল। পঞ্চম সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে যদি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হয়, তাহলে কী অবস্থা সৃষ্টি হবে? সরকার চালাবে কে? মধ্যবর্তী এই শূন্যতা পূরণ হবে কাদের দিয়ে? সংগত কারণেই এসব প্রশ্ন সামনে চলে আসে আর এই প্রেক্ষাপটেই ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের নির্বাচন।

১৫ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল সংসদে উত্থাপন করা এবং সেটি পাস করানো। এই নির্বাচনের পর গঠিত বিএনপি সরকার অন্য কোনো কাজ করেনি, শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলটি পাস করেছিল। সেটা করে ৩০ মার্চ সংসদ ভেঙে দিয়ে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দেয় বিএনপি। দেশের তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত একটি সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে সেই শাসন চালিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে বিএনপির ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে যুক্ত করার যে প্রতিশ্রুতি বিএনপি দিয়েছিল, সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেই ক্ষমতা থেকে সরে যায় বিএনপি।

১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের আগে আরও একটি অভূতপূর্ব ঘটনার জন্ম হয়। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সমন্বয়ে অতি রাজনৈতিক ‘জনতার মঞ্চ’ তৈরি হয় একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে। জনতার মঞ্চের মূল কুশীলব মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ শুধু যে মন্ত্রীই বানায় তা-ই নয়, পদ্মা ব্যাংক নামক একটি ব্যাংক তার হাতে তুলে দেওয়া হয়।

দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একই ধরনের আরেকটি সংকট তৈরি হয় যখন আওয়ামী লীগ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করে। দেশের বৃহত্তম এবং জনপ্রিয়তম রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং তার জোট এই নির্বাচন বয়কট করে। ১৫ ফেব্রুয়ারিতে ৫০ জনের কাছাকাছি প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কথা বলে আওয়ামী লীগ, কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এই সংখ্যাটির অতি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে ব্যালটে একটি মাত্র সিল দেওয়ার আগেই সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যায় ক্ষমতাসীন জোট। বাংলাদেশ এর পরের ৫ বছর শাসিত হলো এমন একটি সরকার দ্বারা, যারা এমনকি একটি আইওয়াশ ভোটেও নির্বাচিত হয়নি।

আছে গুরুতর প্রতারণার ইতিহাসও। একটি সরকারের মেয়াদ শেষে আরেকটি সরকার না এলে অবশ্যই একটি ভয়ংকর শাসনতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি হয়। তাই সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য যেভাবেই হোক আরেকটি নির্বাচন হতেই হয়। যুক্তিটি অকাট্য, সন্দেহ নেই। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ঠিক এ কথাটি বলা হয়েছিল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। সঙ্গে বলা হয়েছিল এটা একটা ‘নিয়মরক্ষার নির্বাচন’, দ্রুতই সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে আরেকটি সংসদ নির্বাচন দেওয়া হবে। এরপর জাতি বুঝেছিল আওয়ামী লীগ কাকে বলে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর যা ঘটেছিল সেটা বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের চরিত্রগত পার্থক্য স্পষ্ট করে দেয়।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দুটি নির্বাচনের প্রেক্ষাপট এবং পরিস্থিতি হুবহু একই কিন্তু ফলাফল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক চরিত্র, জনগণের কাছে দেওয়া ওয়াদা রক্ষা, প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার মানসিকতা সম্পূর্ণ আলাদা। এজন্যই একটি দল ক্ষমতায় থেকে হয়ে পড়ে আমলানির্ভর আর অন্যটি জনগণের।

লেখক আইনজীবী ও সংসদ সদস্য বিএনপিদলীয় হুইপ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION