রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:২৬ অপরাহ্ন
এহ্সান মাহমুদ:
ধান ভানতে শীবের গীত শোনাতে চাই শুরুতে। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর সদ্য চাকরিচ্যুত উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দীনের কথা ভাবতে গিয়ে বলিউডের এক সিনেমার কথা মনে পড়ল।
২০২০ এর মে মাসে আমি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। টানা ২১ দিন গৃহবন্দি। একদিকে করোনার আতঙ্ক অন্যদিকে মানুষের সঙ্গ পাচ্ছি না। দিন-রাত একই ঘরে বন্দি। এমন সময়ে সঙ্গী হলো বই আর সিনেমা। বই পড়ার অভ্যাস আগেই ছিল। সিনেমাটা নতুন যুক্ত হলো করোনা ও লকডাউন পরিস্থিতিতে। প্রায় প্রতিদিনই দুটি করে সিনেমা দেখা দৈনন্দিন রুটিন হয়ে দাঁড়াল। ভরদুপুরে একটি এবং রাতে খাওয়ার পর আরেকটি। ওই সময়েই দেখা একটি সিনেমার নাম ‘রেইড’। বলিউডের এই ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ২০১৮ সালে। ছবির প্রধান চরিত্র অমর পাটনায়েকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অজয় দেবগন। দুদকের শরীফ উদ্দীনের কথা বলতে গিয়ে কেন এই সিনেমার কথা বলছি একটু পরই তা পরিষ্কার হবে। প্রথমে সিনেমার গল্পটা মনে করতে চাই।
ভারতের আয়কর বিভাগের কর্মকর্তাদের সৎ সাহস ও দেশপ্রেমের সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমাটি। ভারতের আয়কর বিভাগের সর্বোচ্চ সময় ধরে চলতে থাকা দুটি রেইড-এর ঘটনা নিয়ে এ ছবির চিত্রনাট্য। ১৯৮১ সালে তৎকালীন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নেতা ও এমএলএ’র বাড়িতে ১৭ ঘণ্টাব্যাপী রেইড চলেছিল। তারপরে সার্চ ও সিজার শেষে সম্পদ গণনার জন্য প্রায় ২০০ জন পুলিশ ও ৪৫ জনকে অর্থ গণনার জন্য নিয়োজিত করা হয়েছিল। আবার ১৯৮৯ সালে প্রভাবশালী দুজন ব্যবসায়ী নেতার বাড়িতে রেইড দেওয়া হয়েছিল। এ কাজে ভারতের আয়কর বিভাগ বাছাই করে চৌকস একটা দল গঠন করেছিল। ঘটনার দিন সকাল ১০.৪৫ পর্যন্ত কেউ জানত না কার বাড়িতে রেইড দেওয়া হচ্ছে। গাড়ি বহর ছাড়ার পরে গন্তব্যের ১০ মিনিট পথ বাকি থাকতে তাদের হাতে দেওয়া সিলগালা চিঠিটি খোলার পরে নাম দেখে অনেকেই আঁতকে উঠেছিল। এরপর দিনভর তারা দুই স্পটে একসঙ্গে রেইড শুরু করে। দিন শেষে একে একে অপ্রদর্শিত অর্থ, গহনা, সম্পদ বের করতে সক্ষম হয়েছিল আয়কর বিভাগ। সেই ব্যবসায়ীরা অনেকভাবে চেষ্টা করেছিল রেইড বন্ধ করতে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে তদবিরও করানো হয়েছিল। আয়কর কর্মকর্তা ডেপুটি কমিশনার বিনয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে বললেনমাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি এখনই রেইড বন্ধ করছি। কিন্তু আপনি সত্যিই মহান ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি না তা টেলিফোনের কণ্ঠ শুনে আমি শিওর হতে পারছি না। আপনি দয়া করে আপনার স্বাক্ষরসহ রেইড বন্ধের একটা নির্দেশ আমার অফিসে ফ্যাক্স করে দিন, আমি সঙ্গে সঙ্গেই রেইড বন্ধ করব।
এরপরে যা হওয়ার তা-ই হলো। প্রধানমন্ত্রীর মুখ বন্ধ হয়ে যায়। কেননা, যত বড় কর্তাই হোকআইন অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় কাজে লিখিতভাবে অন্যায় কোনো নির্দেশ দেওয়ার সাহস কেউ করেন না। টেলিফোনের ওপার থেকে দেখে নেবেন, বদলি করবেন, চাকরিচ্যুত করবেন, হত্যা করবেন, এলাকাছাড়া করবেন, দেশছাড়া করবেন এইসব প্রায়ই হয়। রেইড সিনেমার অমর পাটনায়েককে ভারতের আয়কর বিভাগের চাকরির পুরো জীবনে ৪৫ বার এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে বদলি হতে হয়েছিল। এটা ছিল তার সততা আর সৎ সাহসের শাস্তি! তবে দেরিতে হলেও তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়েছিল ভারত। প্রাথমিকভাবে প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হলেও অন্তর থেকে এমন অফিসারকে অভিবাদন করেছিলেন। দেশবাসীও দাঁড়িয়ে সম্মান করেছেন। ভারতের আয়কর বিভাগের অডিট অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স উইং-এ কাজ করেন বাছাই করা, নিবেদিত, চৌকস কর্মকর্তারা। এই উইংটিকে এতটা শক্তিশালী ও ক্ষমতাসম্পন্ন রাখা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্ট হলেও কোনো অন্যায় আবদারের প্রশ্রয় নেই। ভারতের আয়কর বিভাগের সফলতা এই ডিপার্টমেন্টের কারণেই এত সুপরিচিত এবং অনন্য উচ্চতায়।
এবার আসি, দুদকের সদ্য চাকরিচ্যুত উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দীনের প্রসঙ্গে। দুদক কর্মচারী চাকরি বিধিমালা ২০০৮-এর ৫৪(২) বিধি অনুযায়ী দুদক চেয়ারম্যান মো. মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দীনকে সম্প্রতি চাকরি থেকে অপসারণ করেছেন। শরীফ উদ্দীন সর্বশেষ পটুয়াখালী দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। শরীফ উদ্দীনকে চাকরিচ্যুতির প্রতিবাদে সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছেন তার সহকর্মীরা। সংস্থাটির সারা দেশের প্রায় ৩০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপিও দিয়েছেন তারা। চাকরিচ্যুত শরীফ উদ্দীন গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, তিনি অন্যায়ের শিকার। তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। রাষ্ট্রের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। শরীফ বলেছেন, ‘আমি অন্যায়ের শিকার, জুলুমের শিকার। আমি সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছি।’
যদি কেউ ‘সঠিক লাইন’ জানে এই দেশে চাকরি পাওয়া খুবই সহজ। তেমনি ‘সঠিক লাইন’ মেনে না চললে চাকরি যাওয়াও খুবই সোজা। অনেকেই সেই লাইনের কেরামতিতে রাতারাতি নিজের ভাগ্য বদলে ফেলেন। আর যারা চাকরি পাচ্ছেন না, তাদের লাইনের সন্ধান পেতে বিলম্ব হয় বলেই চাকরি মেলে না। আবার লাইনচ্যুত হয়ে গেলেই চাকরিচ্যুত হতে হয়। ঠিক কোন কোন কারণে কেউ লাইনচ্যুত হয়ে যেতে পারে এর সঠিক কোনো মানদ- নেই। হতে পারে দায়িত্বপালন করতে গিয়ে ক্ষমতাধর কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরাগভাজন হওয়া, ঊর্ধ্বতন কর্তার নিয়মবহির্ভূত আবদার না মানা এমনকি ঘুষ গ্রহণে অনিচ্ছুক হলেও লাইনচ্যুত হয়ে চাকরিচ্যুত হতে হয়। চাকরি যাওয়া-পাওয়ার লাইন খুঁজে দেওয়ার আলাপ এখন বাদ দিচ্ছি।
শরীফ উদ্দীন চাকরিচ্যুত হওয়ার আগে নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেছিলেন। নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি এমনসব মানুষের শত্রু হয়েছিলেন যাতে করে নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে তাকে ভাবতে হয়েছে। আবার চাকরিচ্যুত হওয়ার পর নিজের পরিবার ও নিজের জন্য রাষ্ট্রের কাছে আশ্রয় চেয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায় শরীফ উদ্দীন এমন ক্ষমতাধর কারও বিরাগভাজন হয়েছেন, যার কারণে চাকরি গেছে। এখন জীবনও অনিরাপদ। শরীফ উদ্দীন ঠিক কী করেছেন বা তার বিরুদ্ধে কী গুরুতর অভিযোগ, যার ফলে তাকে অপসারণ করা ছাড়া দুদকের উপায় ছিল নাএসব বিষয়ে দুদকের চেয়ারম্যান ও সচিবের কোনো বক্তব্য জানা যায়নি।
বলিউডের সিনেমা ‘রেইড’ দিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম। সেখানে ফিরে যাই। সিনেমার নায়ক অজয় দেবগন শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছিলেন। সিনেমার শেষ দৃশ্যে নায়কের মুখে হাসি ও গৌরবের চিহ্ন ফুটলেও বাস্তবে তা দেখার সুযোগ আমাদের হয় না। হয় না বলেই দুদকের শরীফ উদ্দীনদের চাকরিচ্যুত হতে হয়। চাকরিবিধি অনুযায়ী যে কোনো কর্মীকে অপসারণের এখতিয়ার যে কোনো প্রতিষ্ঠানেরই আছে। দুদকের হাতেও এই ক্ষমতা আছে। কিন্তু দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মতো জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন দক্ষ ও সাহসী কর্মকর্তা হিসেবে যিনি পরিচিত তাকে এভাবে চাকরিচ্যুত করার ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। শরীফ উদ্দীনকে সুরক্ষা দেওয়ার পরিবর্তে কেন এভাবে অপসারণ করা হলো, তা দুদকের কাছ থেকে জানার অধিকার দেশের জনগণের রয়েছে। দুদক এটা করবে বলে আশা করি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক