রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:১৮ অপরাহ্ন
রুমিন ফারহানা:
শুরুতেই কতগুলো বহুল আলোচিত কিন্তু খুবই কম গুরুত্ব দেওয়া হয় এমন প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা যাক : ১. সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ কতটা বেড়েছে? ২. নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য দলগুলোর পরিকল্পনা বা পদক্ষেপ কী? ৩. নারীরা কেন রাজনীতিতে আগ্রহী হচ্ছেন না? ৪. নারীবান্ধব রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরিতে দলগুলো কতটা তৎপর? ৫. বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পদে নারী থাকার পরও দলের অন্যান্য পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ তেমন আশাব্যঞ্জক নয় কেন? ৬. নারীকে রাজনীতিতে আগ্রহী করে তুলতে দলগুলো নিজেরা কতটুকু আগ্রহী এবং প্রস্তুত? ৭. রাজনীতিতে নারীর প্রতিবন্ধকতাগুলো কী বী? ৮. এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে করণীয় কী? ৯. রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এবং উন্নতি কি কেবল পরিবারতন্ত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? সর্বশেষ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো ১০. রাজনৈতিক দলগুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে নারীর সংখ্যা এত কম কেন?
প্রতি বছর নানা উপলক্ষে এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি নিয়মিতই হতে হয় আমাদের, আমরা যারা রাজনীতি করি। সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও রাজনীতিতে এই সংখ্যা এখনো তেমন আশানুরূপ নয়। নারীর জন্য সব পেশাই চ্যালেঞ্জিং কিন্তু নিশ্চিতভাবেই রাজনীতির মতো চ্যালেঞ্জিং নয় কোনোটাই। রাজনীতি বর্তমানে এমন এক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে সৎ, শিক্ষিত, যোগ্য, মেধাবী কোনো পুরুষই রাজনীতিতে নিজেকে যুক্ত করতে চান না, সেখানে নারীবিদ্বেষী এক সমাজে দাঁড়িয়ে রাতারাতি নারীর অংশগ্রহণ আশানুরূপ অবস্থায় যাবে সেই চিন্তা একেবারেই বাস্তবতা বিবর্জিত। আইন অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বস্তরে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণের আলোচনায় সবাই যখন সংখ্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকে তখন একটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তা হলো সংখ্যাধিক্য জরুরি সন্দেহ নেই, কিন্তু মানের ব্যাপারে আমরা ভাবছি কতটুকু? আদৌ ভাবছি কি?
একটু আগেই বলছিলাম আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা এমন রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে পারিনি যেখানে একজন মেধাবী, যোগ্য, দেশপ্রেমিক এবং সৎ পুরুষ তার ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। সেখানে এত বৈরিতার মধ্যে একজন নারীর রাজনৈতিক দলে যুক্ত হওয়া পরিবার, সমাজ সবদিক থেকেই অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। রাজনীতির পথ যে কেবল অনিশ্চিত তাই নয়, বাংলাদেশের মতো দেশে এর চেয়ে অনিরাপদ, ঝুঁকিপূর্ণ, পিচ্ছিল, কর্দমাক্ত, ঈর্ষা-বিদ্বেষ-পরশ্রীকাতরতা-প্রতিশোধপরায়ণতাপূর্ণ কোনো ক্ষেত্র আছে বলে আমার জানা নেই। বাংলাদেশে প্রথমত নারীর নিজের জীবন নিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা অত্যন্ত সীমিত। তারপরও যদি কোনো শিক্ষিত, যোগ্য নারী রাজনীতিতে জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন সেক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার পরিবার। সেই সঙ্গে নারীবিদ্বেষী সমাজ আর রাষ্ট্রের বাধা তো আছেই। কিছুদিন আগে চলা তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানে ‘পাপিয়াকান্ড’ আমাদের জানা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রকাশ্য করেছে। পাপিয়াকে আপনাদের মনে আছে আশা করি। পাপিয়ার ঘটনাটি অন্যগুলোর চেয়ে অনেকটাই আলাদা কারণ এটি আমাদের সামনে ‘কাস্টিং কাউচ’-এর বিষয়টি নিয়ে এসেছে। এই শব্দটি গ্ল্যামার জগতে অতি পরিচিত হলেও রাজনীতিতে বা অন্য পেশায় তেমনভাবে শোনা যায়নি। কিন্তু এই শুদ্ধি অভিযানের সময় দেখা গেল রাজনীতিতেও কীভাবে জাঁকিয়ে বসেছে এই ভয়াবহ ব্যাধি। মাঝে মাঝে ফেইসবুকে রাজনীতি করা কিছু নারীর আক্ষেপ শোনা যায়, পদ দেওয়ার চুক্তিতে নেতারা যাদের সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হয়েছেন কিন্তু সেই পদ আর তাদের ভাগ্যে জোটেনি। অর্থাৎ এতে তাদের আপত্তি নেই যদি পদ পাওয়া যায়!
১৯৪২ সাল থেকে রাজনীতির সঙ্গে আমাদের পরিবারের বসবাস। যাদের গল্প শুনে, ছবি দেখে আমি বড় হয়েছি, যাদের আদর্শ হিসেবে সামনে রেখেছি তাদের সঙ্গে যখন আজকের নারীনেত্রীদের মেলাই তখন বহু ক্ষেত্রেই হিসাব মেলে না। এই ধরনের কোনো নারী যখন তেমন কোনো যোগ্যতার স্বাক্ষর না রেখেই ‘নেতা’দের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে দলের অতি ভালো একটা অবস্থানে চলে যায় তখন পুরো বিষয়টিই প্রশ্নের মুখে পড়ে।
পাপিয়া ঘটনায় অনেকগুলো বিষয়ের সঙ্গে যে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছিল তা হলো অর্থ, তেলবাজি, পেশিশক্তির সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে পদ-পদবি পেতে যে জিনিসটি ম্যাজিকের মতো কাজ করে তা হলো যৌনতা। হয়তো এই সবগুলোকে কাজে লাগিয়েই পাপিয়া জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদটি বাগিয়ে নিয়েছিলেন। এমপি হওয়ার জন্য ব্যাপক অর্থও বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি। পাপিয়া নামটি বারবার উচ্চারিত হচ্ছে তার মানে এই নয় যে একমাত্র তিনিই এই ধরনের কাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পাপিয়া আসলে একটি শ্রেণিকে প্রতিনিধিত্ব করেন যে শ্রেণির আকার রাজনীতিসহ অন্যান্য পেশাতেও বাড়ছে প্রতিদিন। রাজনীতি এখন বিনা পুঁজির ব্যবসা। খালি হাতে এখানে এসে হাজার কোটি টাকা বানানো যায়। কিছু মানুষ আছেন যাদের শিক্ষা, মেধা, যোগ্যতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, রাজনীতির জ্ঞান, প্রজ্ঞা না থাকলেও আছে লোভ, আকাশচুম্বী উচ্চাভিলাষ, আছে জিঘাংসা, আছে তীব্র ঈর্ষা আর পরশ্রীকাতরতা। যোগ্যতায় বহু নিচে পড়ে থাকা এসব নারী বুদ্ধি-জ্ঞান-মেধা-প্রজ্ঞা-যোগ্যতা নিয়ে যেসব নারী রাজনীতিতে এগোনোর চেষ্টা করছেন তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার কথা ভাবতেও পারে না, তাই সবসময় চেষ্টা করে নিজে অথবা অন্য কাউকে দিয়ে যোগ্য নারীদের ‘ফাউল করে’ দমিয়ে রাখতে। এদের বিস্তার কেবল জেলা পর্যায় বা তৃণমূলে নয় এদের ব্যাপ্তি বহুদূর পর্যন্ত।
‘নীতির রাজা’ হলো রাজনীতি। কিন্তু এটি এখন পরিণত হয়েছে ‘রাজার নীতি’-তে। তাই বলাই বাহুল্য রাজা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নীতিতেও পরিবর্তন আসে। গণতান্ত্রিক সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে তখন রাজনীতির যে চেহারা আমরা দেখি, কর্র্তৃত্ববাদী সরকারের সময় সে চেহারা আমূল পাল্টে যায়। রাজনীতি করলে মামলা হবে, জেলে যেতে হবে আমাদের মতো দেশে এগুলো স্বাভাবিক ঝুঁকি। কিন্তু ভয়ংকর হলো এখন এই মামলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, পুলিশ হেফাজতে ভয়াবহ নির্যাতনসহ আরও অনেক কিছু। একজন নারী যখন রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন এই দেশের রাজনীতির মাঠের যেসব বীভৎসতা আছে, তার সবকিছুই তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। নারী, একজন পুরুষের মতোই সেই বিপদগুলোতে পড়েন, মোকাবিলা করে, করতে হয়। আবার একটা চরম পুরুষতান্ত্রিক এবং নারীবিদ্বেষী সমাজ মুখিয়ে থাকে রাজনীতিতে নেমে পড়া এবং নামতে চাওয়া নারীদের চলার পথে নতুন নতুন বাধা তৈরি করতে। এই সব মানুষদের হাতেই এক ভয়ংকর অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন ‘পাপিয়া’রা। আমি রাজনৈতিক কর্মী বলে বারবারই রাজনীতির মাঠের উদাহরণ টেনে আনছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো ‘কাস্টিং কাউচে’র এই ভয়াবহতা অন্যান্য পেশাতেও ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে। এর সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি হলো কাজের ক্ষেত্র থেকে যোগ্য মানুষ সরে যায়, সেই জায়গা দখল করে নেয় কম মেধা, যোগ্যতার মানুষ যারা তাদের উচ্চাকাক্সক্ষা পূরণে যোগ্যতার ঘাটতি মেটাতে যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত।
রাজনীতিসহ অন্যান্য পেশাতেও এই মানুষগুলোর সংখ্যাধিক্য একদিকে যেমন যোগ্য মানুষদের যোগ্যতাকে দমিয়ে রাখে অন্যদিকে তেমনি নতুন যারা রাজনীতিতে বা অন্য পেশায় যুক্ত হতে চান তাদের জন্য নতুন বাধা তৈরি করে। নিজেদের মেধা, যোগ্যতা, শিক্ষাকে পুঁজি করে যারা এগোতে চান এবং একটা অবস্থান তৈরি করেন তাদের বিষয়েও মানুষের মধ্যে অনেক সময় এসব ক্ষেত্রের প্রচলিত ‘স্টেরিওটাইপিং’ কাজ করে। নিজ প্রতিভা, যোগ্যতা, শ্রমে সফল হওয়া নারীদের প্রতিও একই ইঙ্গিত করে সমাজের অনেকে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী খুব সহজেই তার চরিত্রহনন করতে পারে এই বলে যে তিনি ক্ষমতাবানদের মনোরঞ্জন করেই নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন। জেল, জুলুম, মামলা-হামলার কষ্ট, ঝুঁকি মোকাবিলা করা একজন নারীর জন্য খুবই কষ্টকর সন্দেহ নেই, কিন্তু চরিত্রের ওপর এই অপবাদ অগ্রাহ্য করে এই সমাজের কয় জন নারী পারবেন রাজনীতিতে আসতে?
ওদিকে পাপিয়া’দের মতো যেসব নারী টাকা খরচের পাশাপাশি পাঁচ তারকা হোটেলে, কিংবা বাসায় প্রমোদখানা খুলে দলের উঁচু পদধারী, বুদ্ধিজীবী এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রভাবশালীদের মনোরঞ্জন করে পদ-পদবি বাগানোর চেষ্টা করে সফল হন, তাদের সঙ্গে পেরে উঠবেন না যারা এই চেষ্টায় নামবেন না। দলের উঁচু পদধারী আর তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী কারও কাছে যদি ‘মনোরঞ্জন’ খুব গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা হয়ে থাকে, তাহলে যারা সেই চেষ্টায় যাবেন না তাদের ভবিষ্যৎ কেমন হবে সেটা না বোঝার কোনো কারণ নেই। রাজনীতিতে ‘পাপিয়া’দের উত্থান আরেকটা বড় বিপদ তৈরি করছে। এদের অনেকের সাফল্য সমাজের আরও অনেক সম্ভাবনাময় ‘পাপিয়া’ক পথ দেখাবে। জ্ঞান-বুদ্ধি, যোগ্যতা, পরিশ্রম ছাড়া ‘বিশেষ ব্যবস্থায়’ রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এই নারীরা নারী রাজনীতিবিদের সংখ্যাই বাড়াবে শুধু। শুরুতে এ কারণেই বলেছিলাম সবার সংখ্যা বৃদ্ধির আলোচনার মধ্যে আমার মনে সব সময় প্রশ্ন আসে মান নিয়ে। গত কয়েক বছর ক্ষমতাসীনদের দেখে এই প্রজন্মের যে কারও ধারণা হতে পারে কোনো রকমে রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে অন্যায়ভাবে টাকা বানানো মানেই রাজনীতি। জনগণ দেখছে এই পথে লক্ষ্য অর্জনের জন্য করা হচ্ছে যা ইচ্ছে তা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে দুটি পথ খোলা আছে। এক যোগ্যতাহীন কিন্তু উচ্চাকাক্সক্ষী পাপিয়ার মতো নারীদের জন্য রাজনীতি সহজ করে দেওয়া কিংবা রাজনীতিতে ‘মেরিটোক্রেসি’ চালু করা এবং শিক্ষিত, মেধাবী, যোগ্য নারীদের রাজনীতিতে নিয়ে আসা। আমরা পছন্দ করি বা না করি রাজনীতিবিদরাই দেশ পরিচালনা করেন। রাজনীতিবিদদের দেশ পরিচালনার প্রভাব পড়ে প্রতিটি নাগরিকের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। তাই সত্যিকারের যোগ্য মানুষদের রাজনীতিতে আসার পথ তৈরি করা, সেখানে তাদের টিকে থাকার মতো পরিবেশ নিশ্চিত করার লড়াই শুধু রাজনীতি করতে যাওয়া সৎ-যোগ্য মানুষদের নয়, প্রতিটি নাগরিকেরও।
লেখক আইনজীবী ও সংসদ সদস্য বিএনপিদলীয় হুইপ