রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:১৮ অপরাহ্ন
নাজমুল আহসান::
বাংলাদেশে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ কর্মবাজারে প্রবেশ করে। এই জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ শোভন কর্মবাজারে প্রবেশ করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। আর অনেকেই বিভিন্ন ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে যুবদের মধ্যে শুধু বেকারত্বের হার উচ্চ। শুধু তা-ই নয় এর বাইরেও শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত নেই, যাদের ‘নিট পপুলেশন’ বলা হয়, এই যুবদের হার সরকারি সর্বশেষ তথ্য মতে প্রায় ৩০ শতাংশ। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ কোনো ধরনের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত নেই। এর মধ্যে ৮৭ শতাংশই যুব নারী। আইএলওর তথ্য মতে ২০২০ সালে বাংলাদেশে কর্মশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ মাত্র ৩৪ শতাংশের মতো। যেটা করোনা মহামারীর আগে আরেকটু বেশি অর্থাৎ প্রায় ৩৬ শতাংশ ছিল।
সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এই ‘নিট’ জনগোষ্ঠীর দক্ষতা উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, পনেরো বছরের চেয়ে বেশি বয়সী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ৯৮ শতাংশ নারী ও ৯৯ শতাংশ পুরুষ প্রশিক্ষণ সুবিধার বাইরে। তা ছাড়া যারা প্রশিক্ষণ পায় তাদের মধ্যেও একটা বড় অংশ স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। যদিও সরকারের তথ্য মতে টেকনিক্যাল, ভোকেশনাল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের হার ২০০৯ সালের ১ শতাংশ থেকে ২০১৮ সালে ১৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং এর মধ্যে নারীদের অংশগ্রহণের হার ২৫ ভাগের মতো।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ২০৩১ সালের মধ্যে ‘নিট জনগোষ্ঠী’র হার ২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ‘নিট’-এর বাইরেও কর্মশক্তির প্রায় ৮৫ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত। তাই টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এই জনগোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
যুবদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ আছে। সরকার কারিগরি শিক্ষাকে সহজলভ্য করার জন্য অনেকগুলো কারিগরি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর বাইরের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নানা মেয়াদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে। সরকারের ২০২০ সালের খসড়া দক্ষতা নীতিতে বলা হয়েছে, দক্ষতা উন্নয়নের জন্য ২৩টি মন্ত্রণালয় ও ৩৫টি বিভাগ বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োজিত আছে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ কাছাকাছি বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে। কিন্তু এই প্রশিক্ষণগুলো সম্পর্কে বড় অভিযোগ যে, বেশির ভাগ প্রশিক্ষণই প্রয়োজনীয় গুণগতমান বজায় রাখতে পারে না। প্রশিক্ষণের অংশগ্রহণকারী নির্বাচনের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যায় না বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে এখনো আগ্রহ সৃষ্টি করা যায়নি।
আবার সরকারি উদ্যোগসমূহ অনেক ক্ষেত্রেই প্রান্তিক যুব জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে পারেনি। অভিযোগ আছে, অনেক সময় শুধু ভাতা গ্রহণ করার জন্য অনেকেই নামমাত্র প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে থাকেন। আরও বড় অভিযোগ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যে ধরনের প্রশিক্ষণ পরিচালনা করে থাকে বর্তমান বাজারে তার উপযোগিতা নেই বললেই চলে, যা শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে যারপরনাই নিরুৎসাহিত করে। অন্যদিকে প্রশিক্ষণ শেষে সম্ভাব্য কর্মবাজার ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকার কারণে কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না এবং যার ফলাফল নিরুপায় ঝরে পড়া।
বাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম জোরদার করতে সরকার ২০২০ সালে খসড়া জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা উন্মুক্ত করে। যদিও এখনো এই নীতি চূড়ান্ত করা যায়নি, তার পরও এই নীতিতে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের উন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের লক্ষ্যে দক্ষতা উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এই নীতিতে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা ও পরিচালনায় বিভিন্ন অংশীজনের ভূমিকার কথা বলা হয়েছে এবং এতে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, নারী, গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও প্রান্তিক যুবদের প্রবেশগম্যতার সৃষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি এতে বাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়ন কর্মকান্ডের গুণগত মান ও সমন্বয়ের জন্য বাংলাদেশ দক্ষতা উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষের (এনএসডিএ) ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
কিন্তু আমাদের বাস্তবতায় দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নীতিমালা থাকা বা না থাকাকে কোনো সমস্যা বলে মনে হয় না। এ খাতে সমস্যা কী তা এই খাত-সংশ্লিষ্টদের প্রায় সবারই জানা। এ সমস্যার জায়গা থেকেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (এনএসডিএ) গঠন হয়। কিন্তু দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের গুণগত মান বজায় রাখা, দক্ষতা উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় এবং প্রশিক্ষণের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান ও তাদের কার্যক্রমকে পরিবীক্ষণ কার্যক্রমের মধ্যে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে অগ্রগতি সামান্যই।
খসড়া দক্ষতা উন্নয়ননীতিতে বলা হচ্ছে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ গুণগত মানসম্পন্ন কোর্স ডিজাইন করবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাস্তবায়নকারী কর্র্তৃপক্ষ ও ‘রেগুলেটরি বডি’ কখনো একই হতে পারে না। বরং এনএসডিএর ভূমিকা হওয়া উচিত গুণগত দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সহায়ক উদ্যোগসমূহ নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনীয় সমন্বয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
অনেক সময় আমরা দেখে থাকি কারিগরি শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের মধ্যে বিভাজন রেখা টেনে বিভিন্ন কর্র্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে আরও বাড়িয়ে তোলা হয়। কারিগরি শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের উদ্দিষ্ট গোষ্ঠী ভিন্ন হতে পারে কিন্তু উভয়ের মধ্যে সমন্বয় ছাড়া গুণগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম নিশ্চিত করা যাবে না। যে প্রতিষ্ঠানই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করুক না কেন, তা একটি নির্দিষ্ট উপযুক্ত কর্র্তৃপক্ষের অনুমোদন ও তত্ত্বাবধান সাপেক্ষে হতে হবে। যা হতে হবে বাজার উপযোগী ও সমসাময়িক বিশ্বের দক্ষতা কাঠামোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
আমাদের দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রমের আরেকটি বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে কর্মক্ষেত্র যথা শিল্প ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগহীনতা। অন্যদিকে সার্বিক পরিস্থিতির আলোকে মনে হচ্ছে দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এক ধরনের অপ্রয়োজনীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে কিন্তু এনএসডিএ গঠনের পর বেশ কয়েক বছর অতিক্রান্ত হলেও এই জায়গাগুলোতে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ছে না।
লেখক : উন্নয়নকর্মী
psmiraz@yahoo.com