রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৫৩ অপরাহ্ন
উবায়দুল হক খান:
আজ পবিত্র শবেবরাত। হাদিসে রাতটি লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত নামে এসেছে। এ রাতে মহান আল্লাহ প্রথম আসমানে এসে গোনাহের কাজে লিপ্ত, অভাব-অনটনে আচ্ছন্ন, রোগ-শোকে আক্রান্তদের মুক্তির আহ্বান করেন। তাই এ রাতকে শবেবরাত বা মুক্তির রজনী বলা হয়। আল্লাহতায়ালা এ রাতে বান্দাদের ডেকে বলেন, ‘যারা পাপ থেকে মুক্তি পেতে চাও, মুক্তি প্রার্থনা করো; আমি মুক্তি দেব। যারা রোগাক্রান্ত আছো, আমার কাছে সুস্থতা চাও; আমি সুস্থ করে দেব। যারা শোকগ্রস্ত আছো, মুক্তি চাও; আমি মুক্তি দেব।’ এভাবে দয়াময় আল্লাহ সারা রাত মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে ডাকতে থাকেন। আল্লাহর এ ডাকে যারা সাড়া দিয়ে তওবা করে ক্ষমা চায়, কিছু প্রার্থনা করে, তিনি তাদের ক্ষমা করেন এবং দান করেন।
হাদিসের ভাষ্যমতে, এ রাতে মহান আল্লাহ পরবর্তী এক বছরের জন্য মানুষের ভাগ্য তথা হায়াত-মউত, রিজিক-সম্পদ ইত্যাদির ফায়সালা করেন। তবে এ সম্পর্কে হাদিসে দুটি রাতের কথা পাওয়া যায়। শবেবরাত আর শবেকদর। কোনো কোনো হাদিস বিশারদের মতে, তকদির সংক্রান্ত বিষয়াদির প্রাথমিক ফায়সালা শবেবরাতে হয়। অতঃপর তার বিশদ বিবরণ শবেকদরে লিপিবদ্ধ হয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, দুনিয়ার শুরু থেকে নিয়ে অনন্তকাল পর্যন্ত যা হবে, আল্লাহ সবকিছুর ফায়সালা ‘লওহে মাহফুজে’ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। নতুন করে এক বছরের জন্য লেখার কিছু নেই। তবে শবেবরাতে শুধু এ কাজ করা হয়, পরবর্তী এক বছরের জন্য কী বাজেট রয়েছে, তা লওহে মাহফুজ থেকে ফেরেশতাদের দিয়ে আলাদাভাবে নোট করানো হয় এবং আগামী এক বছরের সবকিছুর দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
শবেবরাতে করণীয় হিসেবে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা শাবানের মধ্য তারিখের রাতে জাগ্রত থাকো এবং দিনে রোজা রাখো।’ অন্য বর্ণনায় আছে, হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একদিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার ঘরে এসে গায়ের কাপড় খুলে না শুয়ে পুনরায় কাপড় পরিধান করে বেরিয়ে যান। এতে আমার আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত লাগে। আমি ভাবলাম, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হয়তো অন্য কোনো স্ত্রীর ঘরে রাতযাপন করবেন। তাই আমি খুঁজতে বের হলাম। খুঁজে পেলাম মদিনার (জান্নাতুল বাকি) কবরস্থানে। গিয়ে দেখি তিনি আসমানের দিকে হাত উঠিয়ে মুমিন নর-নারী ও শহীদদের জন্য দোয়া করছেন। এটা ছিল বরাতের রাতের ঘটনা। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহতায়ালা এ রাতে প্রথম আসমানে এসে বান্দাদের ব্যাপকভাবে ক্ষমা করেন। যার পরিমাণ কালব নামক গোত্রের বকরির পশমের চেয়েও বেশি (ওই গোত্রের লোকেরা বেশি পরিমাণে বকরি পালন করত)। তিরমিজি শরিফ : ১৫৬
শবেবরাতে আমরা কী আমল করব, এ সম্পর্কে কোরআন-হাদিস ও ফিকহের কিতাবাদিতে যে কয়টি আমলের কথা বণির্ত হয়েছে তা হলো: এক. বেশি করে নফল ইবাদত করা। এক্ষেত্রে বিশেষ কোনো পদ্ধতি কিংবা নিয়মের কথা হাদিসে উল্লেখ নেই। তাই অন্যান্য নামাজের মতো এ রাতের নামাজ পড়তে হবে। দুই. পরের দিন নফল রোজা রাখা। তিন. এ রাতে বেশি বেশি দোয়া করা। সব ধরনের রোগ-শোক, অভাব-অনটন ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি চাওয়া। বিশেষ করে গোনাহ থেকে মুক্তি চাওয়া। চার. মৃতদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করা। পাঁচ. জিয়ারতের জন্য কবরস্থানে যাওয়া। যেহেতু এ রাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাতুল বাকিতে গিয়েছেন। এক্ষেত্রে দলে-দলে আড়ম্বরতার সঙ্গে যাওয়া নিষেধ।
শবেবরাত বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ রাত। এ রাতে যেকোনো নেক কাজ করলে যেমন অনেক সওয়াব পাওয়া যায়, তদ্রুপ এ রাতে গোনাহ করলেও তা বড় গোনাহ হয়ে দাঁড়াবে। তাই এ রাতে সবরকম গোনাহ থেকে মুক্ত থাকতে হবে এবং বেশি করে আল্লাহর কাছে গোনাহ মাফের দোয়া করতে হবে। কেননা সব চাওয়ার মাঝে গোনাহ থেকে মুক্তিই হলো বড় চাওয়া। আর তা থেকে মুক্তি পাওয়াই হলো বড় পাওয়া। অতএব, গোনাহ থেকে মুক্তি পেতে একনিষ্ঠভাবে তওবা করতে হবে। তওবা শুধু মুখে করলেই হবে না। এমন তওবা দ্বারা পাপ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তওবা করতে হবে একনিষ্ঠভাবে, দিলে দরদ নিয়ে, গোনাহের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হৃদয়ে।
মূলত যে তওবা গোনাহ থেকে মুক্তি দেয়, নাজাত দেয় জাহান্নাম থেকে এমন তওবার জন্য প্রধানত চারটি শর্ত রয়েছে। এক. অতীতের সব গোনাহ সম্পর্কে অনুতপ্ত হওয়া। দুই. যে গোনাহের তওবা করা হচ্ছে, ওই গোনাহ ত্যাগ করা। তিন. ভবিষ্যতে ওই গোনাহ না করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করা। চার. গোনাহ যদি বান্দার হক সংশ্লিষ্ট হয়, তাহলে তার হক আদায় করা কিংবা ক্ষমা চেয়ে নেওয়া।
দোয়া কবুলের জন্য এই চার শর্ত ছাড়া আরও কতগুলো আমল রয়েছে, যা জীবনের সব সময় করতে হয়। তা হলো এক. হালাল রিজিক খাওয়া। পোশাক ও জীবিকা সবকিছুই হালাল উপায়ে হওয়া। দুই. মাতা-পিতার অবাধ্যতা না করা। তিন. মানুষকে ভালো কথা বলা, ভালো কাজের প্রতি উৎসাহ দেওয়া, মন্দ কাজ থেকে বারণ করা। চার. আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, তাদের হক আদায় করা। পাঁচ. পরনিন্দা না করা। অর্থাৎ কোনো মানুষের পেছনে তার বদনাম কিংবা সমালোচনা না করা। ছয়. হিংসা না করা। সাত. কৃপণতা না করা। অর্থাৎ আল্লাহর দেওয়া সম্পদ যেখানে ব্যয় করা দরকার, প্রয়োজন অনুযায়ী সেখানে ব্যয় করা।
শবেবরাতের বিশেষ একটি আমল হচ্ছে, মৃতদের জন্য দোয়া করা। তারা উপকৃত হন, এমন আমল বেশি বেশি করা। এর কয়েকটি পদ্ধতি হলো: এক. তাদের জন্য বেশি করে দোয়া করা। দুই. যেকোনো ইবাদত করে তাদের উদ্দেশে সওয়াব পৌঁছে দেওয়া। তিন. কোরআন তেলাওয়াত করা। চার. জিকির-আজকার করা। পাঁচ. দান-সদকা করা।
এ ছাড়া আমরা যেকোনোভাবে নফল ইবাদত করে এর সওয়াব তাদের কাছে পৌঁছাতে পারি। এ রাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুমিন নর-নারী এবং শহীদদের জন্য দোয়া করেছেন, এটা ইসালে সওয়াবের অন্তর্ভুক্ত। তাই আমরাও এ রাতে মুর্দাদের জন্য যেকোনোভাবে শরয়ি পন্থায় ইসালে সওয়াব করতে পারি।
সমাজে শবেবরাত উপলক্ষে বিভিন্ন কুসংস্কার, রীতি-রেওয়াজের প্রচলন রয়েছে। এগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রত্যেক ক্ষমাপ্রত্যাশী মুমিন-মুসলমানের উচিত আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি কামনায় রাতটিকে গুরুত্ব দেওয়া।
লেখক : আলেম ও শিক্ষক