রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৪৬ পূর্বাহ্ন
চিররঞ্জন সরকার:
মানুষ শখ করে কিংবা কৌতূহলের বশে কখনো আত্মহত্যা করে না। জীবনে যখন চরম সংকট দেখা দেয়, বেঁচে থাকা যখন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, তখনই কেবল মানুষ আত্মহত্যা করে। গত ২৩ মার্চ রাজশাহীর গোদাগাড়ীর নিমঘুটু গ্রামের কৃষক অভিনাথ মারান্ডি ও তার চাচাতো ভাই রবি মারান্ডি বিষপান করে আত্মহত্যা করেছেন, সেটা তারা নিশ্চয়ই গভীর আনন্দ থেকে করেননি। অথচ তাদের এই আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে ব্যাপক কোনো তৎপরতা নেই। নেই বিশেষ কোনো উদ্যোগ।
দরিদ্র কৃষক অভিনাথ তার ধান কম দামে এক মহাজনের কাছে বিক্রি করেছেন। সেই ধানের জমিতে সময়মতো পানি দিতে পারছিলেন না। ধানের শিষ বের হচ্ছে, এমন সময় তার জমির মাটি ফেটে চৌচির হয়ে আছে। একই অবস্থা মৃত আরেক কৃষক রবি মারান্ডির জমিতেও। পরিবারের সদস্যদের সরাসরি অভিযোগ স্থানীয় গভীর নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে। এই অপারেটর তাদের পানি না দিয়ে ১২ দিন ধরে ঘোরাচ্ছিলেন। চোখের সামনে বোরো ধানের ক্ষেত ফেটে চৌচির হতে দেখে তারা আত্মহত্যা করেছেন।
ঘটনাটি নিঃসন্দেহে দেশের জন্য একটি অশনি সংকেত। দেশের সব কিছু ভালো চলছে, কৃষি, শিল্প, উৎপাদনে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, মানুষ সুখেশান্তিতে আছে ক্ষমতাসীনদের লাগাতার এই প্রচারণাকে গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এই ঘটনা। দেশের মানুষ আসলে সুখে নেই। সুখে থাকলে নিশ্চয়ই ওই দুই কৃষক আত্মহত্যা করত না। নানা ধরনের সমস্যা-সংকট অনেক প্রান্তিক মানুষের প্রাত্যহিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। দুই সাঁওতাল কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা তারই নমুনামাত্র। অথচ এসব দিকে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের খুব একটা নজর আছে বলে মনে হয় না।
এর আগে সেচের পানির অভাবে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনার কথা আমরা জেনেছি। আফ্রিকার কোনো কোনো এলাকায় সেচের পানির অভাবে কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনার কথাও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ‘সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা’ বাংলাদেশে সেচের পানির জন্য দুজন কৃষক আত্মাহুতি দিতে পারে এটা ছিল আমাদের কাছে কল্পনারও বাইরে। অথচ তেমন ঘটনাই ঘটেছে। সেচের পানির জন্য এভাবে বিষপানে আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের দেশে সম্ভবত এবারই প্রথম ঘটল। এই বিয়োগান্ত ঘটনাটি কেন ঘটল, তা যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে বের করা দরকার। যাদের অবহেলার কারণে ওই দুই কৃষক বিষপানে বাধ্য হয়েছেন, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেচ প্রকল্পে অব্যবস্থাপনায় কে বা কারা যুক্ত, ওই এলাকার ক্ষুদ্র
কৃষকদের সুরক্ষার জন্য কী করা যায়, সেসব বিষয়ও গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখা উচিত। কেবল যে বোরো খেতে পানি দিতে না পারার কারণেও ওই দুই কৃষক আত্মহত্যা করেছেন, তা নয়। সেখানে প্রান্তিক কৃষকরা নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। তারা এক নতুন ঋণ ও দারিদ্র্যচক্রে বাঁধা পড়েছেন। বছরের পর বছর ধরে সেই অমানবিক শোষণমূলক ব্যবস্থা চালু আছে। বিভিন্ন অনুসন্ধানে জানা যায়, নিমঘটু ও তার পাশের বর্ষাপাড়া গ্রামের সাঁওতাল কৃষকরা জমির ধান লাগানোর সময় মহাজনের কাছ থেকে টাকা নেন। ধান উঠলে ওই টাকার বদলে মহাজনকে ধান দিতে হয়। এ প্রথা দীর্ঘদিনের। সেটি এখনো চালু আছে। ওই গ্রামে ৫৪টি সাঁওতাল পরিবার আছে। তাদের মধ্যে কমবেশি ৪০টি পরিবারই ধানের ওপর মহাজনের কাছে টাকা নেয়। এ বছরও অনেক সাঁওতাল কৃষক ৮০০ টাকা মণ দরে ধান দিতে চেয়ে মহাজনের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নিয়েছেন। এটা তাদের জন্য নতুন বিষয় নয়। অনেক সময় ধান তুলে মহাজনকে দিতেই সব শেষ হয়ে যায়। ধান তুলে আবার মহাজনের কাছে টাকার জন্য হাত পাততে হয়। এ ব্যবস্থায় অভিনাথ ও রবি মারান্ডি স্থানীয় এক মহাজনের কাছ থেকে ধান রোপণের সময় ১০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন। বিনিময়ে ধান উঠলে মহাজনকে ৭০০ টাকা মণ হিসেবে ধান দেওয়ার চুক্তি করেছিলেন। কিন্তু যখন বোরোর জমিতে সেচ দিতে পারছিলেন না, তখন দিশেহারা হয়ে পড়েন। ধান ভালো না হলে তিনি মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন না। এই দুশ্চিন্তায় তারা বিষপান করে আত্মহত্যা করেন।
প্রশ্ন হলো, দেশে এত এত ব্যাংক। এত এত এনজিও। কিন্তু নিমঘটু ও বর্ষাপাড়া গ্রামের ৫৪ ঘর সাঁওতাল পরিবার এখনো কৃষিঋণের জন্য মহাজনি প্রথায় আটকে থাকেন। তাহলে কোথায় উন্নয়ন-অগ্রগতি? সরকারের কৃষিঋণ কারা পায়? কীভাবে পায়? গরিব মানুষের, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশে বহু এনজিও নিবেদিতপ্রাণ। কিন্তু কোথায় তারা? দুজন ঋণগ্রস্ত কৃষককে বাঁচানোর মতো, বেঁচে থাকার ভরসা জোগানোর মতো যদি কেউ না থাকে, তাহলে আর এত এত সংস্থার কাজ কী? আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য সরকারেরও নানা কর্মসূচি আছে। আছে বিশেষ বরাদ্দ। এই বরাদ্দের টাকাই বা কোথায় যায়? কারা পায়? উত্তরবঙ্গে সব মিলিয়ে আদিবাসী পরিবারই আছে কয়েকশ। এই পরিবারগুলোকে সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা দিয়ে ঋণনির্ভরতা থেকে সহজেই মুক্তি দেওয়া যায়। এ জন্য শত শত কোটি টাকারও দরকার নেই। যা দরকার, তা হলো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও আন্তরিক উদ্যোগ। এমনকি সরকার যদি কয়েকটি শীর্ষ এনজিওকে এসব আদিবাসী পরিবারের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করার দায়িত্ব প্রদান করে, তাহলেও এই পরিবারগুলো ঋণনির্ভরতা থেকে মুক্তি পেতে পারে। কিন্তু সরকারের কর্তাব্যক্তিদের তেমন কোনো ইচ্ছে আছে বলে মনে হয় না। তা না হলে দুই কৃষকের মৃত্যুর তিন সপ্তাহ পরেও সরকারের কোনো হেলদোল নেই কেন?
তবে নির্দিষ্টভাবে দুই কৃষকের এই আত্মহত্যার ঘটনার পেছনে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) অবহেলাও কম দায়ী নয়। বিএমডিএ বরেন্দ্র এলাকায় গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচের পানি সরবরাহ করে থাকে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই সেচ কর্মসূচি পরিচালিত হয়। অভিযোগ রয়েছে যে, বিএমডিএর গভীর নলকূপের অপারেটররা কৃষকদের জিম্মি করে বোরো ধান চাষের জন্য বিঘাপ্রতি দেড় থেকে তিন হাজার টাকা নিচ্ছেন। কৃষকদের টাকা দিতে বাধ্য করা হয়, অন্যথায় পানি দেওয়া হয় না। বিএমডিএর রয়েছে আরও নানা স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতি। বোরো ধান চাষিরা বিএমডিএ কর্র্তৃপক্ষের কথা অনুযায়ী কার্ড করতেও বাধ্য হচ্ছেন, কিন্তু এই কার্ডের মাধ্যমেও অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠছে। গভীর নলকূপ দিয়ে সেচের পানি দেওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে বৈষম্য।
কৃষকদের অভিযোগ, কেউ ঘরে বসেই পানি পায় কেউ দিনের পর দিন ঘুরেও পানি পায় না। বরেন্দ্র প্রকল্প ১৬টি জেলায় নতুন এক শোষক শ্রেণির জন্ম হয়েছে যেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে স্থানীয় প্রভাবশালীরা ভূমি ও পানি সামন্তে পরিণত হয়েছেন। পানি নিয়ে প্রতিটি স্তরে স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে। এমন অরাজকতা বছরের পর বছর ধরে চললেও তা দেখার কেউ নেই। এর অবসান কবে হবে? সরকারি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর ধরেই কি অনিয়ম আর দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থাকবে? দুই কৃষকের আত্মাহুতির ঘটনার পরও এর কোনো প্রতিকার হবে না? বরেন্দ্র এলাকার কৃষি নিয়েও নতুন করে ভাবনাচিন্তা করা দরকার। সেচনির্ভর ফসলের পরিবর্তে কম পানিতে উৎপাদন করা যায়, এমন ফসল ফলানোর ব্যাপারেও উদ্যোগী হওয়া উচিত। ওই অঞ্চলে আম, লিচু পেঁয়াজ, মুগডাল, ছোলাসহ অনেক স্থানীয় জাতের ফসল রয়েছে। সেসব ফসলে খুব বেশি সেচের দরকার হয় না। কৃষি অধিদপ্তরসহ সরকারের উচিত এ ধরনের সেচবিহীন বা কম সেচের ফসল উৎপাদনে কৃষকদের সহায়তা করা। তাদের উৎসাহিত করা। এটা শুধু রাজশাহী নয়, দেশের অন্যান্য এলাকার ক্ষেত্রেও তা জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নিতে হবে। সেচবিহীন স্থানীয় ফসল উৎপাদনের বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে হবে। কারণ আবহমানকালের নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলো বর্তমানে সংকটের মুখে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তা, করোতোয়াসহ সবগুলো নদী এখন চরম নাব্য সংকটে ভুগছে। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার মধ্য দিয়ে একসময়কার প্রবল প্রবহমান ছোট নদীগুলোর অধিকাংশই শুকিয়ে মরে গেছে আর না হয় মরে যেতে বসেছে। ভারত-বাংলাদেশ অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান ইহকালে আর হবে বলে মনে হয় না। এ অবস্থায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। ভূপৃষ্ঠের পানির সর্বোচ্চ ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক কলামনিস্ট ও লেখক
chiros234@gmail.com