রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৪৪ পূর্বাহ্ন
মো. সাইফুল ইসলাম:
অপরাধী কারাগারে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেবে, কারামুক্ত হয়ে সরকারিভাবে সাহায্য-সহযোগিতা পাবে এ কথা কী বিশ্বাস করা যায়! কিছুদিন আগে আইনাঙ্গনের কয়েকজনের সঙ্গে যখন এ বিষয়ে কথা বলছিলাম তখন তারা রীতিমতো হাসাহাসি শুরু করে দিলেন। বললেন, এভাবে চললে বিচারব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। মানুষ অপরাধ করতে উৎসাহিত হবে। বিষয়টি অবাক করার মতো হলেও ৭/৮ বছর ধরে দেখছি অপরাধী কারাগারে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আবার কারামুক্ত হয়ে বা প্রবেশনে মুক্ত হয়ে কেউ পেয়েছেন গরু, কেউ পেয়েছেন সেলাই মেশিন, কেউবা সেলুন।
অপরাধীদের সংশোধন ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সরকারের এ ধরনের আফটার কেয়ার সার্ভিস কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতি। কারণ একজন অপরাধীর অপরাধের দায়ে যেমন শাস্তিপ্রাপ্য, ঠিক তেমনি শাস্তিব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে অপরাধমুক্ত স্বাভাবিক জীবন গড়ার সুযোগও প্রাপ্য। এই সমিতি একজন অপরাধীকে সেই সুযোগ দিয়ে বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা তৈরি করে। পরিবার ও সমাজের বিরূপ ধারণা দূর করে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তাদের সমাজের উপযোগী করে গড়ে তোলে। বাংলাদেশে অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসনমূলক কার্যক্রমের বীজ বপন হয় ১৯৬০ সালে। সে সময় দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অরডিন্যান্স পাস হলে ১৯৬২ সালে ওই আইন বাস্তবায়নের জন্য দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দুটি প্রকল্প চালু হয়। একটি হচ্ছে ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স’ এবং অপরটি হচ্ছে ‘আফটার কেয়ার সার্ভিস’। ওই সময় অর্থাৎ ১৯৬২ সালে সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে প্রত্যেক জেলায় অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রত্যেক জেলায় এই সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণমূলক সংস্থাসমূহ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ, ১৯৬১ অনুসারে এটি নিবন্ধিত। তবে ওই সমিতির অভিন্ন গঠনতন্ত্র না থাকায় বিভিন্ন জেলায় সমিতির কার্যক্রম পরিচালনায় অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। তাই ওই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ২০০২ সালে অভিন্ন নমুনা গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়। এই সমিতি শুধু কারাগারের বাইরের অপরাধী অর্থাৎ প্রবেশনে মুক্ত ও কারামুক্ত অপরাধীদের পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করে না, কারাভ্যন্তরের বন্দিদের সাধারণ শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষাসহ যুগোপযোগী বৃত্তিমূলক কর্মসূচিও বাস্তবায়ন করছে। এই সমিতিতে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে যে কেউ সদস্য হতে পারে। সমিতিতে দুধরনের সদস্য আছে। যথা১. সাধারণ সদস্য এবং ২. আজীবন সদস্য। উভয় প্রকার সদস্যের ভোটাধিকার আছে। সাধারণ ও আজীবন সদস্যের সমন্বয়ে সাধারণ পরিষদ গঠিত। যার মূল কাজ হচ্ছে সংস্থার নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব ও বাজেট অনুমোদন করা। সমিতির কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য ২ বছর অন্তর অন্তর কার্যকরী পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করে। এই পরিষদের মেয়াদ থাকে ২ বছর, যার সদস্য থাকে ৭ থেকে ২১ জন।
নমুনা গঠনতন্ত্রে ১৫ সদস্যের একটি কাঠামো দেওয়া হয়েছে। সেটিতে দেখা যায়, জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে সভাপতি, সহসভাপতি পদাধিকার বলে ৩ জন যথাক্রমে জেলার পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি), উপপরিচালক, জেলা সমাজসেবা এবং কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক। প্রবেশন অফিসার পদাধিকার বলে সাধারণ সম্পাদক। এ ছাড়া জেলা আইনজীবী সমিতির প্রতিনিধি হিসেবে একজন পদাধিকার বলে সদস্য আছেন। কোষাধ্যক্ষ, সহ-সম্পাদকসহ অন্য নির্বাহী সদস্যরা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত। এই কার্যনির্বাহী পরিষদ সমিতির দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। আজ থেকে ৬০ বছর আগে খুব চমৎকার কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এই সমিতি গঠিত হলেও সেগুলো আজও কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। ৪/৫টি জেলা ছাড়া অন্যান্য জেলার পুনর্বাসনমূলক কার্যক্রম সেভাবে দৃশ্যমান হয়নি। তাদের কার্যক্রম শুধু কারাভ্যন্তরে প্রশিক্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সেবাগ্রহীতাদের আবেদন পদ্ধতির অস্পষ্টতা এবং কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যের মধ্যে সু-সমন্বয়ের অভাব। এই পরিষদের প্রতি তিন মাস পরপর সভা হওয়ার বিধান আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই মিটিং নিয়মিত হয় না। অর্থবছর পেরিয়ে গেলেও কোনো মিটিং হয়নি এমন নজিরও আছে। চার বছরে মাত্র দুটি মিটিং হয়েছে এমনও নজির আছে। আবার, জরুরি পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করা হবে তার কোনো বিধানই রাখা হয়নি। বিস্ময়কর হচ্ছে সেবাগ্রহীতার আবেদন করার কোনো বিধানও নেই। আবেদন জমা না পড়লে স্বাভাবিকভাবে মিটিং করার তাড়া থাকে না। এরূপ পরিপ্রেক্ষিতে বাজেটের অধিকাংশ অর্থ অব্যয়িত থেকে যায়। এই সমিতির আয়ের উৎস হচ্ছে সরকারি অনুদান, স্থানীয় দানশীল ব্যক্তি বা সংস্থা কর্তৃক দান এবং সদস্যদের চাঁদা। সমিতিগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সমাজকল্যাণ পরিষদ এককালীন আর্থিক অনুদান প্রদান করে থাকে। বাস্তবতা হচ্ছে এই অনুদান ছাড়া অন্য কোনো উৎস থেকে তহবিলে অর্থযুক্ত হয় না। সমিতিতে চাঁদা দিয়ে মেম্বার হওয়ার নিয়ম থাকলেও অনেকেই তা দিতে চায় না বা মেম্বার হলেও বার্ষিক চাঁদা তোলা আরেক বিড়ম্বনা। ফলে সদস্যদের কাছে চাঁদা আদায় নিয়মিত হয় না। কারামুক্ত বা প্রবেশনে মুক্ত অপরাধীদের মধ্যে কারও হয়তো সুদমুক্ত ঋণের প্রয়োজন হতে পারে, কারও প্রয়োজন কর্মসংস্থান কিংবা কারও বিশেষ প্রশিক্ষণের। সে ক্ষেত্রে প্রকৃতই কোনো অপরাধীর এই সমিতি থেকে সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালত এবং প্রবেশন অফিসারের সবচেয়ে ভালো জানার কথা। অথচ এখানে কোনো বিচারক সদস্য নেই। এই কমিটির অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে আর্থিকভাবে অসচ্ছল অপরাধীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আইনগত সহায়তা দেওয়া। কিন্তু এ কমিটিতে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার সদস্য নেই।
এই সমিতির সুফল পেতে হলে কমিটিকে পুনর্গঠন করতে হবে। বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজকে সভাপতি করে শিশু আদালতের বিজ্ঞ বিচারক ও বিজ্ঞ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে এ কমিটির সদস্য করতে হবে। যেহেতু বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজরা প্রতি মাসে একবার করে কারা পরিদর্শন করেন, সেহেতু সেই পরিদর্শনের সময়ই কারাবন্দিদের মধ্যে কাদের আইনগত সহায়তা দরকার তা উঠে আসে। আর জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির মাসিক মিটিংয়ে সে বিষয়গুলো আরও পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। গত ১৩ বছরে এই কমিটিগুলো অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার সাম্প্রতিক তথ্যানুসারে, ২০১২ থেকে মার্চ ২০২২ সাল পর্যন্ত ৯৪,০৩৯ জন কারাবন্দিকে ৬৪টি জেলা কমিটির মাধ্যমে আইনি সহায়তা দিয়েছে। আর ২০০৯ থেকে মার্চ ২০২২ পর্যন্ত ৭ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৯ জনকে আইনি সেবা দিয়েছে। ফলে অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতির সঙ্গে এই সমিতির দারুণ সমন্বয় করে কাজ করা সম্ভব।
এই সমিতির অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে কারাগারে অবস্থানরত অপরাধীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ও পরিবারের সঙ্গে অপরাধীর সুসম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এ ধরনের কাজ করা সমিতির পক্ষে খুব কঠিন। যেসব বন্দির পরিবার তাদের বন্দিদশার খবর জানে না সেই বন্দিদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে কিছু বেসরকারি সংস্থা কাজ করে। তারা প্যারালিগ্যালদের মাধ্যমে এই সেতুবন্ধের কাজটি করে মুক্তির ব্যবস্থা করে থাকে। এ সংস্থাগুলোকে এই সমিতির কার্যকরী পরিষদের সদস্য করতে হবে। বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার বিকল্প নেই। কেননা এই সমিতির নিজস্ব কোনো জনবল নেই। নমুনা গঠনতন্ত্রের ১৫ অনুচ্ছেদে কর্মচারীদের বেতন-ভাতার জন্য অর্থব্যয়ের সুযোগ থাকলেও কোনো কর্মচারী নিয়োগ হয় না। সীমিত বাজেটের মধ্যে শুধু খণ্ডকালীন কারা প্রশিক্ষকদের সম্মানী দেওয়া হয়। সমিতির যেকোনো কার্যক্রমের জন্য কার্যনির্বাহী পরিষদের সম্পাদক প্রবেশন অফিসারকেই উদ্যোগ নিতে হয়, বাস্তবায়ন করতে হয়। অথচ এই কার্যালয়ে কোনো সহায়ক কর্মচারী নেই। আইনি বাধ্যবাধকতায় অপরাধীর গৃহ পরিদর্শনের জন্য মোটরসাইকেলও নেই। তাই সমিতি বা প্রবেশন কার্যালয়ে পর্যাপ্ত জনবল এবং যানবাহন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া প্রবেশনে মুক্ত বা কারামুক্ত অপরাধী যেন পুনরায় অপরাধ না করে সেজন্য নিয়মিত ফলো-আপ দেওয়ার জন্য এই সমিতির কার্যক্রম তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে কমিটি সম্প্রসারণ করতে হবে। সমিতির আওতায় স্থানীয়ভাবে ভলান্টিয়ার নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। জাপান, ফিলিপাইন, দ. কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অপরাধীদের তদারকি করার জন্য এরূপ স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা রয়েছে। এ সমিতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে সভা, আলোচনা, সেমিনার ইত্যাদির মাধ্যমে অপরাধের কারণ নির্ণয় ও অপরাধীর প্রতি প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা। কিন্তু এ ধরনের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নজরে আসেনি। ফলে আইনাঙ্গনের অধিকাংশ মানুষ এই সমিতির কথা জানে না। জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনে রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্রের মাধ্যমে এর কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণকে জানাতে হবে। তাহলে সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বাড়বে।
আমাদের দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ বন্দিরা কারাভ্যন্তরে এবং কারামুক্তির পর যথোপযুক্ত পরিচর্যার অভাবে পুনরায় অপরাধ করে বসে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দিতে এই সমিতি দারুণ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। বর্তমানে কারামুক্ত ও প্রবেশনে মুক্ত অপরাধীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু সেই অনুপাতে সমিতির গৃহীত পদক্ষেপ বাড়ছে না। আজ সময় এসেছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সমিতিকে পুনর্গঠন করে যুগোপযোগী করার। সম্প্রতি সরকার এই সমিতির নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রস্তাবিত সমিতির নাম দিয়েছে ‘অপরাধী ব্যক্তি ও দোষী সাব্যস্ত শিশুর সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতি’। চমৎকার এই নামটি দেখে আশান্বিত হলাম। কিন্তু যখন প্রস্তাবিত প্রবেশন আইন, ২০২০-এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখলাম তখন প্রাচীনকালের সেই ‘যাহা লাউ তাহাই কদু’ গল্পটির কথাই মনে পড়ে গেল। কারণ ওই আইনানুসারে সমিতি নতুনভাবে পুনর্গঠিত হবে না। শুধু আইন কার্যকরের সঙ্গে নতুন নামে অভিহিত হবে।
লেখক বিচারক (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ), প্রাবন্ধিক ও আইনগ্রন্থ প্রণেতা