রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৩২ পূর্বাহ্ন
উম্মুল ওয়ারা সুইটি:
‘ছাত্র’র মতো এত আশা জাগানিয়া শব্দ আমার এই মুহূর্তে আর মনে পড়ছে না। বিশ্বজুড়ে এই ছাত্রদের লালনই করা হয়। একদিন কিছু বদল দিতে পারে এই ছাত্র সমাজই। এনে দিতে পারে স্বাধীন দেশ। ছাত্ররা মহামূল্যবান এক সম্পদ। রাজনীতির কঠিন অঙ্কের সমাধান দিতে পারে ছাত্ররা।
বিশ্বজুড়েই একসময় একটা অত্যন্ত সুসংগঠিত শক্তি ছিল ছাত্রসমাজ। দুনিয়ার তারুণ্যের এক শক্তিশালী সত্তা ছাত্ররা। বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস অনেক বেশি শক্তিশালী এবং বর্ণাঢ্য। উনিশ শতকের গোড়ার দিকেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল এই ছাত্ররা। আসলে আমাদের ছাত্র আন্দোলনের কথা বলতে গেলে কয়েক লাখ ফর্মায়ও তা শেষ করা যাবে না। ভাষা আন্দোলনের কৃতিত্বও ছাত্রদের হাতেই তুলে দিতে হবে। আর ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শক্তিও ছাত্ররা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই সময় এই ছাত্রদের নিয়েই পাকিস্তানের পতাকা সরিয়ে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু নিজেও উঠে এসেছিলেন ছাত্ররাজনীতি থেকেই। মুসলিম লীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং এরপর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘ছাত্রলীগ’। সেই ছাত্রলীগের এমন বর্ণাঢ্য ইতিহাস তা বলে শেষ করা যাবে না। চল্লিশের দশকের পরেই বাংলার ছাত্র সংগঠনগুলো একটি স্বাধীন দেশের জন্য নিজেদের আন্দোলন-সংগ্রামের তাগিদ অনুভব করেন। নীতিনির্ধারক বড় নেতাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল একেবারেই আত্মিক। সে-সময়ের নীতিনির্ধারক শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবুর রহমান তারাও জানতেন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে এই ছাত্রদের মধ্যেই দেশপ্রেম এবং স্বাধীনতার বীজ বপন করতে হবে। শেরেবাংলা বলতেন, ছাত্রদের মাথা পরিষ্কার। তাদের ধরিয়ে দিলে অনেক দূর পর্যন্ত তারা এর পরিধি দেখতে পায়। বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। কারণ তিনি মনে করেছেন, স্বপ্নের স্বাধীন দেশ পেতে হলে বুক চিতিয়ে দেওয়ার মতো শক্তি আছে ছাত্ররাই। দেশব্যাপী তিনি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করেছিলেন। সেই সময়ে মেধাবী এবং পড়ুয়া ছাত্ররা ছাত্ররাজনীতি করতেন। আর সেটার সুফল আমরা পাই বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পর থেকে ৭১ সাল পর্যন্ত সব কটি আন্দোলনে। অন্যান্য প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোও সে সময় স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের ভুল নির্দেশনার কারণে কিছু ছাত্র সংগঠন বা কিছু ছাত্রনেতা নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন বটে। আর যাই হোক সেই সময় বিরোধীপক্ষের ছাত্র সংগঠনের কাউকেই ইট হাতে নিয়ে মাথা থেঁতলে দেওয়ার মতো ঘটনায় অংশ নিতে দেখা যায়নি। বোনের মায়ের নারীর সম্ভ্রম ছাত্রদের কাছে এক মহান পবিত্রতায় আসীন ছিল। ছাত্ররা ধর্ষণ করবে এটা মনে হতো হয়তো জাহান্নাম হয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে হতে পারে।
বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্বের পর ছাত্রলীগের কান্ডারি সিরাজুল আলম খান, শেখ মণিসহ অনেকের বলিষ্ঠ ভূমিকা আমরা দেখতে পাই। এরপর কে না জানে ছাত্রলীগের চার খলিফার কথা। ঊনসত্তরে তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাকসহ ছাত্রনেতাদের বীরত্ব ইতিহাসে জ্বলজ¦ল করছে। আর একাত্তরে স্বাধীনতার জন্য এই রক্তনদী বইয়ে দেওয়ার অন্যতম শক্তিও ছিল ছাত্ররাই। সে সময় ছাত্ররা মুক্তির ডাকে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েছিল। কোথাও ছাত্রদের জটলা দেখলে মনে হতো, মুশকিল আহসান হবে। যুদ্ধের সময় ছাত্রলীগের কিশোররা পর্যন্ত যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ছাত্রলীগ কোনো আপস করেনি। অনেক বড় বড় টোপ এসেছিল, আদর্শচ্যুত হয়নি ছাত্রলীগ। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রক্ত দিয়ে দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করতে এগিয়ে ছিল ছাত্রলীগসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠন।
অনেক চড়াই-উতরাই আছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। ছাত্রদের গর্ব খর্ব করতে স্বৈরশাসক এবং অরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসা গোষ্ঠী চেষ্টা করেছে। আবার বঙ্গবন্ধুকন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও ছাত্রলীগের মর্যাদার সঙ্গে একাত্ম। ছাত্রলীগ তার কাছে একটি আশার আলো, বঙ্গবন্ধুর মতোই ছাত্রলীগের ওপর তিনিও ভরসা করেন।
আওয়ামী লীগের আজকের যে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তিনিও ছাত্রলীগের ইতিহাসে কম যান না। এখন আওয়ামী লীগ সরকার টানা তিনবার ক্ষমতায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন ছাত্রলীগের জয়জয়কার হওয়ার কথা। ছাত্রলীগ চাইলে গত ১১ বছরে শিক্ষাব্যবস্থায় এক অন্য রকম পরিবর্তন আনতে পারত। তারা যদি শুধু ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, শেখ হাসিনার আত্মত্যাগ এবং ছাত্রলীগের ৭০ বছরের নেতৃত্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করত তাহলে এই ছাত্রদের হাতে ইট-পাথর, টেঁটা-বল্লম থাকত না।
ছাত্রলীগের নেতারা এখন ঠিকাদারদের সবচেয়ে প্রিয়। তাদের দিয়ে টেন্ডার ছিনতাই করা হয়, তাদের দিয়ে মার্কেটের চাঁদা তোলা হয়, তাদের কেউ কেউ রিসোর্টের মালিক হয়, তারা কোটি টাকা দামের গাড়িতে চড়ে। ছাত্রলীগের নেতাদের ভয়ে কেউ কথা বলার সাহস পায় না। সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে তাদের প্রায় কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের জন্য হলে থাকতে পারে না সাধারণ ছাত্ররা। কথা বলছিলাম রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপকের সঙ্গে। তিনিও সম্প্রতি ঢাকা কলেজে ছাত্রদের চাঁদাবাজি, দেশব্যাপী ছাত্রলীগের নানা বিশৃঙ্খলা, র্যাগিংয়ে ছাত্রহত্যা এবং সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের অস্ত্রের মহড়া নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন। এই তো মিরসরাইয়ে র্যাবের ওপর হামলা ও মাদক ব্যবসার অভিযোগে ছাত্রলীগ সভাপতি বহিষ্কার হয়েছেন। গত কয়েক বছরে গর্বের ছাত্রলীগের মুখে চুনকালি ফেলেছেন কারা সেই হিসাব এখন করার সময় হয়েছে।
বলতে চাই, আওয়ামী লীগ এখন সরকারে তাই ছাত্রলীগের কথা বলছি। বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল, এরশাদের জাতীয় পার্টির ছাত্রসমাজ ত্রাসে কম যায়নি। তবে অর্থ লুটের বা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির স্রোত এনেছিল ছাত্রদল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রকে গাড়ি উপহার দিয়ে ছাত্রের ছাত্রত্বের সম্পদের মান নামিয়ে দিয়েছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। যাক এসব গল্প তো অল্পস্বল্প হয়ে যাবে, যদি ছাত্রলীগকে পথে ফিরিয়ে আনা না যায়। এত মানুষের সমর্থন, এত বড় দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের কাছে কী আশা করে জাতি? ছাত্ররা কেন টাকার পেছনে যায়? উত্তর আসে কিছু বড় ভাই মানে নেতারা এই সরবরাহ দেন। ঢাকা কলেজের ঘটনায় মনে হলো, ছাত্রলীগ কি দুষ্টচক্রের শিকার হয়ে যাচ্ছে? ফাস্টফুডের দোকানদার থেকে শুরু করে ইয়াবা কারবারিরাও তাদের ব্যবহার করবে?
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় যে ছাত্রের চারখানা শার্ট, একজোড়া জুতা, একজোড়া সেন্ডেল আর টুকটাক কিছু কাপড় ছিল, রাতারাতি ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে তার কীভাবে দুই হাজার বর্গফুটের বাসা ভাড়া নিয়ে থাকা আর দামি গাড়ির বন্দোবস্ত হয়? এতে ছাত্রলীগের বা ছাত্রের গর্ব বাড়ছে না খর্ব হচ্ছে? এই কুমির প্রজনন হলে আগামীর জাতীয় সংসদ আর রাজনীতি কীভাবে রক্ষা হবে? ছাত্ররা ফিরে আসুক তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পরিচয়ে। ছাত্রদের মতো বড় শক্তির রিজার্ভ ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেলে কিছু তো রক্ষা করা যাবে না। ছাত্রলীগকে শিক্ষাঙ্গনে দুর্বার, ক্ষুরধার দেখতেই চায় সবাই। এখন ছাত্রলীগ চাইলেই পারে শিক্ষাঙ্গনে আর ছাত্ররাজনীতিতে একটা বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে।
লেখক : সাংবাদিক
ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশরূপান্তর