রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:২০ পূর্বাহ্ন
ড. লিপন মুস্তাফিজ:
দেশের অর্থনীতি এখন একটা বড় চাপের মধ্যে আছে। দ্রব্যমূল্য যে হারে বাড়ছে সে হারে আয় বাড়ছে না সাধারণ মানুষের। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে কমবেশি সবাই। এমনই এক পরিস্থিতিতে ঘোষিত হলো ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেট। বাংলাদেশের বাজেট নিয়ে সব সময় একই ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় সরকার ও বিরোধী দলের কাছ থেকে। অর্থনীতিবিদ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের মতামত দিয়ে থাকে বরাবর। কিন্ত বাজেটে চমক থাকে না, থাকে না উল্লেখ করার মতো নতুন কিছু। সাধারণ মানুষ বাজেট যেভাবে দেখে তা হলো, কোন কোন দ্রব্য বা পণ্যের দাম বাড়ছে বা কমছে। বাংলাদেশের বাজারে যে পণ্যের দাম বাড়ে তা আর কমে না। নানা অসিলায় দ্রব্যের দাম বেড়ে যায় অনেক গুণ। ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের ফলে এই খবর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে অনেকটা সিন্ডিকেটের মতো বাজারের দখল থাকে একশ্রেণির ব্যবসায়ীদের কাছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ ও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এ খাতে নতুন অর্থবছরে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা বাজেটের ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ ও জিডিপির ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। সে হিসাবে এই খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ৫ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। এছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতে ১১ লাখ উপকারভোগী বাড়ানো হচ্ছে।
বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতায় ১২৩টি কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করছে সরকারের ২৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এগুলোর মধ্যে ৪টি কর্মসূচিতে দেওয়া হচ্ছে নগদ ভাতা এবং ১১টিতে দেওয়া হচ্ছে খাদ্য সহায়তা। নতুন বাজেটে খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক কল্যাণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, কর্মসৃজন, অবসর ও পারিবারিক ভাতা এবং অন্যান্য এই মোট ছয় খাতে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন অর্থবছরের বাজেটে খাদ্য নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ৫৭০ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকায়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সামাজিক সুরক্ষা খাতে মোট ছয়টি উপখাত রয়েছে। এর মধ্যে ‘খাদ্য নিরাপত্তা’ উপখাতের আওতায় রয়েছে ওএমএস, ভিজিডি, ভিজিএফ, কাবিখা, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি।
প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র, বেদে, হিজড়া, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করার জন্য নতুন বাজেটে সামাজিক কল্যাণ খাতে মোট ৩৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রয়েছে। এছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মানবসম্পদ উন্নয়নে ৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বাজেটে এ খাতে ছিল ৫ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা উপবৃত্তি, প্রাথমিক ছাত্রছাত্রী উপবৃত্তি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক উপবৃত্তিতে এ টাকা খরচ করা হবে। কর্মসৃজন খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ১৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
গত বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ১৮ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা। কাবিখা, উন্নয়ন প্রকল্প বা কর্মসূচিতে এই বরাদ্দের টাকা ব্যয় হয়। অবসর ও পারিবারিক ভাতায় নতুন বাজেটে ২৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে। গত বাজেটে ছিল ২৬ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। বয়স্ক, বিধবা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি দিতে এ টাকা ব্যয় করা হবে। এছাড়া নতুন বাজেটে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ৬ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বাজেটে এ খাতে ছিল ৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। এভাবে এসব খাতে তুলনামূলকভাবে গত বাজেটের চেয়ে বরাদ্দ বেড়েছে সত্যি। কিন্তু এই বরাদ্দ বৃদ্ধি সংকটকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথেষ্ট কি না সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আওতা বাড়ছে শুধু বয়স্ক ও বিধবাদের ক্ষেত্রে। এই কর্মসূচির আওতায় নতুন করে আরও ১০০ উপজেলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এতে যুক্ত হবে ১১ লাখ নতুন উপকারভোগী। সব মিলিয়ে নতুন বাজেটে এর সংখ্যা দাঁড়াবে ৬৮ লাখ। তবে ভাতার পরিমাণ বাড়বে না। এ কর্মসূচির আওতায় গত তিন অর্থবছর ধরে উপকারভোগীরা প্রতি মাসে ৫০০ টাকা হারে ভাতা পাচ্ছেন। প্রতিবন্ধীদের জন্য ৭৫০ টাকা করে ভাতা রয়েছে বর্তমানে। আগামী অর্থবছর থেকে এটা ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৮৫০ টাকা করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে ২০ লাখ ৮ হাজার প্রতিবন্ধীর জন্য ভাতা বরাদ্দ ছিল। উপকারভোগীর সংখ্যা আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ লাখ ৫৭ হাজার বাড়িয়ে ২৩ লাখ ৬৫ হাজারে উন্নীত করা হবে। নতুন অর্থবছরে প্রতিবন্ধী ভাতা বাবদ ২ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া শহর ও গ্রাম মিলিয়ে ৭ লাখ ৭০ হাজার দরিদ্র মায়ের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা এবং ২ লাখ ৭৫ হাজার কর্মজীবী মায়ের জন্য ভাতা দিয়ে আসছে সরকার। দুটি কর্মসূচিকে এক করে আগামী অর্থবছর থেকে নতুন নাম দেওয়া হচ্ছে ‘মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি’। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ কর্মসূচিতে মোট উপকারভোগীর সংখ্যা ১০ লাখ ৪৫ হাজার থেকে ২ লাখ ৯ হাজার বৃদ্ধি করে আগামী অর্থবছরে তা ১২ লাখ ৫৪ হাজারে উন্নীত করা হয়েছে। এ খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট বরাদ্দ ১ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ানো হয়নি। ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে সব শ্রেণির বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী ভাতা ন্যূনতম ২০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংবলিত ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) ও সমন্বিত তালিকা করা হয়েছে। এছাড়া, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচিতি নিশ্চিত করতে তাদের অনুকূলে স্মার্ট কার্ড ও ডিজিটাল সনদপত্র প্রদান কার্যক্রম চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশের সব জেলা-উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
বর্তমানে মূল্যস্ফীতির একটি অংশ আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবে ঘটছে। এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের কোনো হাত নেই। ফলে বাজেটে দেশীয় বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মোকাবিলায় সাধারণ মানুষের সুবিধার জন্য ভর্তুকি ও কর সম্পর্কিত উদ্যোগ নেওয়া দরকার। যার ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম ধরে রাখা যাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে সার ও জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। এই দুই ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত একটি সঠিক পদক্ষেপ। সারের দাম ভর্তুকি দিতে হবে, না দিলে দেশীয় বাজারে সারের দাম বেড়ে কৃষি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং তাতে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে। একই পদক্ষেপ নিলে জ্বালানি তেল, কৃষি সেচ দেওয়ার খরচ কমাবে। এমনকি গণপরিবহনের খরচ বাড়বে না। অর্থাৎ ডিজেল ও কেরোসিনের ভর্তুকি দেওয়া প্রয়োজন। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অর্থ বরাদ্দ মূলত গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্য বেশি থাকে কিন্তু শহরে নগর দরিদ্রদের জন্য বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দরকার। কর্মসৃজনমূলক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে। মানুষের যদি কাজ থাকে এবং তা থেকে আয় হয় তাহলে তার পক্ষে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থাকলেও জীবনযাত্রার মান ধরে রাখা সম্ভব হয়। দেশের মানুষ সাহায্য চায় না কাজ চায়। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পসহ নানা ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে হবে। এর পাশাপাশি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কেননা যে কোনো সময় যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। শুধু বড় বড় প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়িয়ে গেলেই সমাজে তার সুফল পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন শহরে কর মেলার আয়োজন করে, কর আদায় বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি কর দাতাদের বিশেষ কিছু সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। এমনকি তাকে একটা স্মার্ট কার্ড দেওয়া যেতে পারে যা প্রদর্শন করে সে যে কোনো সেবা পেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী কভিড সংক্রমণের দেড় বছর সময়ে অন্তত ১ কোটি টাকা ব্যাংকে আছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে ১৫ হাজার ৯৩৯ জন এবং ব্যাংকে থাকা তাদের অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ১,১২,৬৬৮ কোটি টাকা। (বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত ঝপযবফঁষবফ ইধহশ ঝঃধঃরংঃরপং এর বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত তথ্য)। এর অর্থ দাঁড়ায় বিপুল ধনী ব্যক্তির সংখ্যা ও সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। আমাদের গড় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিও সে ইঙ্গিতই দেয়।
সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত ও বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট ব্যাহত হওয়ার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে দেশব্যাপী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিতরণে সরকারিভাবে ‘ফ্যামিলি কার্ড’ কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় এক কোটি পরিবারের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর অধীনে করোনাকালে নগদ অর্থ সহায়তা বাবদ ২,৫০০ টাকা করে পেয়েছেন যেসব পরিবার তারাসহ মোট এক কোটি পরিবার টিসিবির ‘ফ্যামিলি কার্ড’ সহায়তা পাচ্ছেন। সরকারি এ উদ্যোগের ফলে দেশের প্রায় পাঁচ কোটি স্বল্পআয়ের মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে। বাজেটে সরকারের নানান প্রকল্পে বরাদ্দের পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা খাতে আরও বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে অর্থনীতিতে সাধারণ মানুষের শ্বাস নেওয়ার স্থান তৈরি হতো।
লেখক ব্যাংকার ও গবেষক/liplisa7@gmail.com
ভয়েস/আআ