রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০১:২১ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বিয়ে বিচ্ছেদ কাক্সিক্ষত নয়

মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
মানুষের জীবনে সংসার একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় বিষয় হলেও সাম্প্রতিক সময়ে সংসার জীবনের বিচ্ছিন্নতা এবং বিচ্ছেদের যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা রীতিমতো ভয়ংকর এবং দুঃখজনক। কোনো সংসারে ভাঙন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক ও বিচ্ছেদ কোনোভাবেই কাম্য নয়। সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে বিয়ে বিচ্ছেদ বিষয়ে ভয়াবহ উদ্বেগজনক খবর বেরিয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে তালাকের প্রবণতা বেড়েছে প্রায় ৩৪%।

নারী-পুরুষ যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন নতুন একটি সংসার গঠনের পাশাপাশি, দুই পরিবার এবং তাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক এবং বন্ধন গড়ে ওঠে। সংসার জীবন স্থায়ী হলে এসব সম্পর্ক স্থায়ী হয়, যা মানুষের জীবনকে সুন্দর এবং আনন্দময় করে। অপরদিকে সংসার জীবনে তালাক হলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদের পাশাপাশি দুই পক্ষের পরিবার এবং তাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে তৈরি হওয়া সম্পর্ক ভেঙে যায়। এটা মানুষের জীবনকে অসুন্দর এবং দুঃখময় করে তোলে।

সংসার ভাঙার মাঝে কোনো ধরনের অর্জন নেই। সব দিকেই এটি ধ্বংসাত্মক। একটি সংসার যখন ভেঙে যায়, তখন সংসারের পুরুষ মানুষটি যেমন একা হয়ে যায়, তেমনি নারীও একা হন। আর একাকী জীবন কখনো সুখের হয় না। তাদের মধ্যে হতাশা, বিষণœতা ও দুশ্চিন্তা চলে আসে। মানসিকভাবে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় পুরুষকে যেমন নতুন করে বিয়ের জন্য ভাবতে হয়, তেমনি নারীকেও নতুন করে বিয়ের জন্য ভাবতে হয়। পুরুষ মানুষটিকে যেমন নতুন করে সংসার গড়ার উদ্যোগ নিতে হয়, ঠিক তেমনি নারীকেও নতুন করে সংসার গড়ার উদ্যোগ নিতে হয়। সংসার ভাঙলে সব দিক দিয়েই ক্ষতি এবং সবার জন্য ক্ষতি।

সংসার ভাঙলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই সংসারে জন্ম নেওয়া শিশুরা। স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ হয়ে গেলে, সেই সংসারে জন্ম নেওয়া শিশুরা হয় মায়ের কাছে থাকে, না হয় বাবার কাছে থাকে। এসব শিশু তখন বাবা-মায়ের যৌথ সংসার থেকে বঞ্চিত হয়, একই সঙ্গে বাবা-মায়ের যৌথ ভালোবাসা এবং স্নেহ-মমতা থেকে বঞ্চিত হয়। তারা যখন মায়ের সঙ্গে থাকে, তখন বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়, আবার যখন বাবার কাছে থাকে তখন মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ কোমলপ্রাণ শিশুদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারা হতাশা এবং হীনম্মন্যতায় ভোগে। তাদের মনে একটি ক্ষত এবং একটি দুঃখ স্থায়ীভাবে আসন গড়ে। তারা সবসময় একটি পরিচয় সংকটে ভোগে। ফলে এই শিশুর মন এবং দেহের স্বাভাবিক বিকাশ হয় না।

সুতরাং সবার উচিত সংসার টিকিয়ে রাখা, টেকসই ও মজবুত করা। তার জন্য প্রয়োজন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস, ভালোবাসা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সমঝোতা। বিয়ের মাধ্যমে একটি নতুন সংসারের যাত্রা শুরু হয়। সেই সংসারে তখন ভালোবাসা, বিশ্বাস, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা থাকে। এসব সংসারের বন্ধন এবং সংসার টিকে থাকার ভিত্তি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি সংসার থেকে যখন পারস্পরিক ভালোবাসা, বিশ্বাস, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা কমে যায়, তখন সেই সংসারের বন্ধন হালকা হয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে তা ভেঙে যায়।

স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের প্রধান কারণ, পরস্পরে বনিবনা না হওয়া। সংসারে বনিবনা না হওয়ার জন্য স্বামী যে অভিযোগসমূহ স্ত্রীর বিরুদ্ধে করে তা হচ্ছেস্বামীর অবাধ্যতা, অশালীন জীবনযাপন, বদমেজাজ, শ্বশুরপক্ষের লোকজনকে কম ভালোবাসা, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, পরকীয়া ইত্যাদি। অপরদিকে সংসারে বনিবনা না হওয়ার জন্য স্ত্রী যে অভিযোগসমূহ স্বামীর বিরুদ্ধে করে থাকে, তা হচ্ছেসন্দেহজনক মনোভাব, পরকীয়া, যৌতুক, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন ইত্যাদি।

আমরা মনে করি, স্বামী ও স্ত্রীর অভিযোগ থেকে সংসার ভাঙার কারণসমূহ উদঘাটিত হয়েছে। এসব কাজ পরিহার করলেই কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা হবে এবং সংসার টিকে থাকবে। সংসার টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই সবার উচিত এসব কাজকে পরিহার করা। মনে রাখতে হবে, পারস্পরিক ভালোবাসা, বিশ্বাস, সহমর্মিতা, ত্যাগ ও সমঝোতার মাধ্যমেই সংসার টিকে থাকে এবং মজবুত হয়। আর এতেই জীবন সুখের হয় এবং জীবন অর্থবহ হয়ে ওঠে। সংসারের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থকে পরিহার করুন। সংসারের বন্ধনকে আরও মজবুত এবং স্থায়ী করার জন্য পরস্পরের ছোটখাটো দোষত্রুটিকে ক্ষমা করুন। অহমিকা, জেদ ও রেষারেষি পরিহার করুন।

ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো, স্বামীসহ ছেলে পক্ষের সবার উচিত স্ত্রীর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া, তার প্রতি কোমল আচরণ করা এবং তাকে সম্মান করা। কারণ মেয়েটি কিন্তু তার বাবার বাড়ি, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, পরিচিত পরিবেশ, যেখানে সে জন্মগ্রহণ করেছে এবং যেখানে সে বড় হয়েছে, তার সবই ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে এসেছে। সে মেহমান, সুতরাং আপনার বাড়িতে আসা মেহমানকে সম্মান করুন। সবার ঊর্ধ্বে সংসারের স্বার্থকে স্থান দিন। তাহলে ভাঙার পরিবর্তে সংসার জোড়া লাগবে এবং টিকে থাকবে। আর সংসার টিকে থাকলে সবাই লাভবান। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ দাম্পত্য জীবনকে আজীবন অটুট রেখেছে। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় মূল্যবোধই এ বন্ধনের নিয়ন্ত্রকশক্তি। তারাই সত্যিকারের সুখী। সুতরাং সবার উচিত নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা।

টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী সংসার মানুষের জীবনকে সুখী, সমৃদ্ধ ও গতিশীল করে। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন মানুষকে করে কর্মমুখর ও প্রাণচঞ্চল। সুতরাং আপনারাও পারবেন এবং দাম্পত্য জীবনকে টেকসই করুন, আমৃত্যু স্থায়ী করুন। তার জন্য পরস্পরের সহযোগী হোন। পরস্পরকে ভালোবাসুন, শ্রদ্ধা ও সম্মান করুন। একে অন্যের কাজকে মূল্যায়ন করুন। অপরের দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করুন। কথায় কথায় ঝগড়া এবং মনোমালিন্য পরিহার করুন। একজনের বিপদে আরেকজন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। অর্থ-সম্পদ, সফলতা-ব্যর্থতা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সবই সংসার জীবনেরই অংশ এবং এসবকে ধারণ করেই প্রবাহিত হয় সময়। ঠুনকো অজুহাতে সংসার না ভেঙে, বরং সংসার নামক গাছটিকে দীর্ঘস্থায়ী ও মজবুত করে গড়ে তোলার জন্য সংসারের সেবা করুন।

মনে রাখবেন স্বামী-স্ত্রী যদি সংসার টিকানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সেই সংসার কেউ ভাঙতে পারবে না। আর স্বামী-স্ত্রী যদি সংসার ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সেই সংসার কেউ টেকাতে পারবে না। সুতরাং সংসার টেকান এবং একে আমৃত্যু স্থায়ী করুন। জীবনকে সুখী ও উপভোগ করুন। এতেই জীবন সার্থক ও সফল।

হ্যাঁ, ইসলামি শরিয়তে অতীব প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তালাকের অবকাশ রয়েছে, কিন্তু বিষয়টি পছন্দনীয় নয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় হালাল হচ্ছেতালাক।’ সুনানে ইবনে মাজাহ : ২০১৮

লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION