রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০১:১৫ পূর্বাহ্ন
মামুনুর রশীদ:
কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার হামলা হলো শিক্ষকদের ওপর। মুন্সীগঞ্জের হৃদয় মন্ডলকে প্রাণে শেষ করতে পারেনি কিন্তু আশুলিয়ার উৎপল কুমার সরকারকে হত্যা করতেও শিক্ষার্থীর হাতটি কাঁপেনি। উৎপল কুমার শুধু ভালো শিক্ষক ছিলেন না, তিনি শিক্ষায় শৃঙ্খলা আনতে চেয়েছিলেন। নড়াইলের অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। তাকেও লাঞ্ছিত করা হয়েছে। শিক্ষকদের এই লাঞ্ছনা ও হত্যায় যে শুধু ছাত্ররাই জড়িত তা নয়। বোঝা যায় কিছু শিক্ষক, এলাকার ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং অভিভাবকদের একটি অংশও জড়িত থাকতে পারে।
কারণ অনেক, যার মধ্যে আক্রান্ত শিক্ষকদের প্রতি বাকিদের ঈর্ষা এবং কোচিং-বাণিজ্যের সংকটও ধরা পড়ে। ব্যবস্থাপনা কমিটি স্কুলে শৃঙ্খলা চায় না, শিক্ষক নিয়োগে তারা অনিয়ম করতে অভ্যস্ত। লাখ লাখ টাকা ছাড়া শিক্ষক তো দূরের কথা একটা দপ্তরির চাকরিও হয় না। দেশের সর্বব্যাপী দুর্নীতির মধ্যে শিক্ষায় দুর্নীতি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। এই সম্প্রসারণের দিগন্ত মন্ত্রণালয় পর্যন্ত বিস্তৃত। তার ওপর রয়েছে এলাকার প্রভাবশালী একটি অংশের অন্তর্দ্বন্দ্ব।
যে তিনজন শিক্ষক আক্রান্ত হয়েছেন তারা সবাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। গত পঞ্চাশ বছরে দেশের ঘাপটি মারা সাম্প্রদায়িক শক্তির পরোক্ষ ইন্ধন এখানে থাকতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। যে শিক্ষকদের হত্যা ও লাঞ্ছিত করা হয়েছে তারা প্রথমত ভালো শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত পাঠদান করেন এবং ছাত্রদের শিষ্টাচার সম্পর্কে সচেতন এটাই আজ দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। কোথাও যোগ্য লোকদের মূল্যায়ন নেই।
এই প্রবণতা শুরু হয়েছে দেশের চলমান রাজনীতি থেকে। অর্থ ও পেশিশক্তি দেশের যোগ্য লোকদের কর্মহীন করে তুলেছে। আশুলিয়ার দশম শ্রেণির ছাত্রটি তার দুর্ব্যবহার ও পেশিশক্তির ফলে খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই ছেলে একটি কিশোর গ্যাং পরিচালনা করত। তার অভিভাবকরা এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি। এলাকার বয়োবৃদ্ধরা ও স্কুলের ছাত্ররা তার ভয়ে কেউ কিছু বলত না। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে বাংলাদেশের প্রবীণ সমাজ দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু ওই কিশোরের ওস্তাদরা অর্থাৎ স্থানীয় সরকারের মেম্বার, চেয়ারম্যান এবং এলাকার সংসদ সদস্য তারা দীর্ঘদিন ধরে কেমন করে চুপ করে রইলেন? আজকাল উপজেলা থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আমলাদের খুব দৌরাত্ম্য দেখা যায়। এলাকার ক্ষমতাবান ইউএনও সাহেবই বা কী করলেন? উপজেলার ওসি সাহেবের কাছে তার সোর্সের মাধ্যমে এই গ্যাংপ্রধানের সংবাদ কি পৌঁছায়নি? আজকাল মাঠে এনএসআই সক্রিয় থাকে। তাদেরও এসব তদারক করা ও ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে। সবাই কি ঘুমিয়ে ছিলেন এবং এখনো ঘুমিয়ে আছেন?
অবশ্য স্বপন কুমার বিশ্বাসকে লাঞ্ছিত করার ঘটনা জেলা প্রশাসক, এসপি, অ্যাডিশনাল এসপির সামনেই ঘটেছে। সে সময় সেখানে প্রায় দুই থেকে আড়াইশ পুলিশ সদস্যও উপস্থিত ছিলেন। দেশে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের অনেক সংগঠন আছে। অতীতে তাদের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি, বর্তমানেও দেখা যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তো ব্রাহ্মণ। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষকরা তাদের কাছে নমশূদ্র। যদিও বিভিন্ন কর্মকা-ের মাধ্যমে তারা এমনসব আচরণ ও কাজ করে থাকেন, যা একেবারেই নমশূদ্রের চেয়েও ঘৃণ্য। ওই সংগঠনগুলোর নেতারা এসব ব্যাপারেও কি ভোটের হিসাব করেন? নাকি অনুমান করেন এসব দুর্বৃত্তের পেছনে সরকারের আশীর্বাদ আছে কি না?
আমাদের সন্তানসন্ততিরা এ দেশেরই স্কুল-কলেজে পড়ালেখা করে। যদিও একটু টাকাওয়ালা প্রভাবশালী আমলা আর মন্ত্রীদের সন্তানরা বিদেশে লেখাপড়া করছে, তাই দেশে কী হলো না হলো তা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা তাদের নেই। ভেসে যাক শিক্ষাব্যবস্থা। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের চাকরির জন্য ষোলো লাখ টাকা পাওয়া যাবে! সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগে লাখ লাখ টাকা পাওয়া যাবে! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও নিজের আত্মীয়স্বজনের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত আছে। এবং এ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে আবার দেশে ফিরে আসে কিংবা সুইস ব্যাংক তো আছেই। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা ভেস্তে যাক, ভেসে যাক শিষ্টাচার তাতে কার কি আসে যায়! দেখা গেল কোণঠাসা হওয়া কিছু আদর্শবাদী শিক্ষক, নাগরিক চেঁচামেচি, অনশন করল তাতে কী বা আসে যায়?
পাকিস্তান আমলে শিক্ষা সংকোচনের নীতি গ্রহণ করার প্রতিবাদে ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছিল। শিক্ষকরাও ব্যাপকভাবে ওই আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছিলেন। বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তনে শিক্ষকদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। সেই শিক্ষকরা কালক্রমে বিদ্যাসাগরের প্রভাবকে অগ্রাহ্য করে এক ধরনের গ্রামীণ টাউটের পথ বেছে নিয়েছেন। প্রাইমারি স্কুলে পড়ালেখা হয় না, কিন্তু পরীক্ষা হয়, কোচিং হয়, নম্বর মিলে যায়। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ও এগুলোকেই অনুসরণ করে।
অন্যদিকে, প্রকৃত শিক্ষার অভাবে কিশোর গ্যাং থেকে শুরু করে এরা পরবর্তীকালে বড় বড় গ্যাংস্টার হয়ে ওঠে, যার পরিণতিতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি আবাসিক হলগুলোতে তারা প্রাধান্য বিস্তার করেন। আর এই পেশিশক্তির ব্যবহারের ফলে প্রকৃত ছাত্রছাত্রীরা মার খায় এবং অসহায় বোধ করতে থাকে। তাদের কান্না শিক্ষকরা শুনতে পান বটে কিন্তু ওই গ্যাংয়ের কাছে নতজানু হয়ে শুধু নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করতেই তারা ব্যস্ত।
আশুলিয়ার এই কিশোর গ্যাং নেতা মাদ্রাসা থেকে এসেছে। মাদ্রাসা থেকে আসা এই ছাত্রের অন্তত কিছুটা ধর্মীয় শিষ্টাচার থাকা উচিত ছিল। সেখানেও দেখা যায় কোনো শিষ্টাচার নেই। খবরের কাগজে দেখা গেল একটি এমপিওভুক্ত মাদ্রাসায় ছাত্রসংখ্যা ছয়জন কিন্তু শিক্ষক ১৮ জন। এই ১৮ জন শিক্ষক নির্দ্বিধায় মাসের পর মাস বেতন পেয়ে যাচ্ছেন। তাদেরই ভাষায় জীবিকার নামে তারা হারাম খাচ্ছেন। এই হারামের কিছু অংশ শিক্ষার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এলাকার মধ্যে কোনো একটি বিবেকবান লোককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না যে, এ বিষয়টির প্রতিবাদ করবেন।
আর সাংবাদিকরা এমন তথ্য পরিবেশন করে ভীতসন্ত্রস্ত জীবনযাপন করছেন। কারণ তার সামনে হুমায়ুন কবির বালু অথবা মাণিক সাহার উদাহরণ আছে।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কোনো শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছেন কি না এ রকম সংবাদ আমার জানা নেই। রাজনৈতিকভাবে সে সময় অনেক শিক্ষকই ছয় দফার পক্ষে দাঁড়াননি। পাকিস্তানি আদর্শে তারা উদ্বুদ্ধ ছিলেন। কিন্তু তবুও ছাত্ররা তাদের ওপর হাত তোলেনি। যাই হোক অতীত বন্দনা করে লাভ নেই, বর্তমানের এই উচ্ছৃঙ্খলতা ক্রমাগত বড় একটি সমস্যা হয়ে সমাজকে যে গ্রাস করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিষয়টি বুঝতে পেরে সরকারি অফিসে শিষ্টাচার বলে একটি বিষয়কে স্থান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে এই কর্মচারী ও কর্মকর্তা এসেছেন এবং যে জীবনের সঙ্গে তারা যুক্ত হয়ে গেছেন, সেখান থেকে শিষ্টাচার তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। শিষ্টাচার একটি শিশু শেখে তার পরিবার থেকে, তারপর বাকি শিষ্টাচারের দায়িত্ব স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের।
মানুষ সবটা শুনে শেখে না, জীবনাচরণ থেকেও শেখে। অনেক শিক্ষক, নেতা, আমলা খুব ভালো বক্তৃতা দেন। কিন্তু জীবনাচরণটা একেবারেই বিপরীত। এই বৈপরীত্য একটা শিশুমনে প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করে। যেখান থেকে উদ্ভব হয়েছিল একটি বাক্য ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শেখাও’ সেই জায়গায় একটা বড় ধরনের ব্যাপার ঘটে গেছে। শিক্ষার্থীরা এই বৈপরীত্যকে বুঝতে পেরে তারা আর বইয়ের কথাও বিশ্বাস করে না! অনেক শিক্ষার্থীর কাছে শুনেছি, ওগুলো বইয়েই লেখা থাকে কিন্তু জীবনে সেগুলোর মানার কোনো দরকার নেই!
একবার বাসে টাঙ্গাইল যাচ্ছিলাম। পথে এক জায়গায় প্রায় তিন কিলোমিটার লম্বা যানজট দেখা দিল। পরে জানতে পারলাম ওখানে স্কুলের ছাত্ররা পথ আটকে দিয়েছে। কারণ বাস কনডাক্টর একটি ছেলেকে ভাড়া না দেওয়ার কারণে গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। আমি বাস থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম এবং স্কুলের সামনে এসে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের আচরণ দেখলাম। তাদের দাবি বাসমালিক ও বাস পরিবহন সমিতির লোকদের এসে ক্ষমা চাইতে হবে এবং জরিমানা দিতে হবে। আমি স্কুলের হেডমাস্টার ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। কারণ শত শত বাস রাস্তার ওপর আটকে আছে। তখন এলাকার ভুক্তভোগী একজন লোক এগিয়ে এসে বললেন ছাত্ররা কারও কথা শুনবে না। এক পাগলা শিক্ষক আছেন তার কথা ছাত্ররা শোনে। ওই পাগলা শিক্ষককে এরই মধ্যে সক্রিয় দেখতে পেলাম। আমি তাকে নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বললাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্যাটির সমাধান হয়ে গেল। পরে জানতে পারলাম ওই পাগলা শিক্ষকের সবচেয়ে বড় গুণ তিনি সত্য কথা বলেন, কাউকে পরোয়া করেন না, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রদের খবর নেন। তার গ্রহণযোগ্যতাকে খাটো করার জন্য কিছু শিক্ষক তার নাম দিয়েছে পাগলা শিক্ষক! কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি, তার জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে। এ রকম পাগলা শিক্ষকদের জায়গা কি আর বাংলাদেশে আছে?
লেখক নাট্যকার, অভিনেতা ও কলামিস্ট
mamunur530@gmail.com