শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১১:২০ অপরাহ্ন
উম্মুল ওয়ারা সুইটি:
নাম না বলি। দুর্ঘটনা এবং নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করেন এমন সংগঠনের নেতা-গোছের এক বড় ভাই। দুদিন আগেও এসব সংগঠনের পক্ষ থেকে মোটরসাইকেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে কঠোর দাবি জানানো হচ্ছিল। ঠিক দুদিন পর ২৯ জুন সেই ভদ্রলোককে দেখলাম রাইড শেয়ারিংয়ের জন্য অপেক্ষমাণ মোটরবাইকের জটলায় কথা বলছেন পল্টনে। তারপর একপর্যায়ে উঠে পড়লেন এবং মাথায় নিম্নমানের হেলমেট।
আসলে বেচারার সে মুহূর্তে কিছু করারও ছিল না। আমি তখন রাস্তায় দেখছিলাম পল্টনের আটটা রাস্তার সবগুলোর মুখই ভরা মোটরবাইক, রিকশা, চার চাকার প্রাইভেট কার আর কয়েকটা বাস। মোড়ে মোড়ে অপেক্ষা করছে শত শত যাত্রী। বেশির ভাগই মনে হলো দূরযাত্রার। মোটরসাইকেল-বিরোধী বিপ্লবী ভাইকে দেখে সালাম দিলাম। তিনিও আমার সম্বোধনের উত্তর দিলেন বাইক থেকেই। তারও দুদিন পর ভাইয়ের কাছ থেকে প্রতিবাদের চিঠি পেলাম। বন্ধ করা হোক মোটরবাইক, দুর্ঘটনার মূল কারণ মোটরবাইক, বিশৃঙ্খলার মূল কারণ মোটরবাইক। তথ্য-উপাত্ত এবং গবেষণা যা বলছে, সত্যিই মোটরবাইকের বেপরোয়া গতি আর বিশৃঙ্খলতা ঢাকার সড়ককে অস্থির করে রাখে। নগরীতে নামলে রাস্তায় দেখা যায় অল্প কিছু বাস। বাকি সবটাই রিকশা, প্রাইভেট কার, সিএনজি অটো রিকশা, নতুন করে যুক্ত হয়েছে মোটরযুক্ত রিকশা। আর আছে সব দোষের দোষী মোটরবাইক।
পাঁচ বছর ধরে এ শহরে হু-হু করে মোটরবাইক বাড়তে দেখছি। রাইড শেয়ারিং আসার পর মোটরবাইকের পোয়াবারো। গত ২৩ তারিখে ধানমন্ডির শংকরে একটি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। সেটি প্রাইভেট কারের সঙ্গে। অ্যাক্সিডেন্টে মুমূর্ষু যে রোগীটি তাকেও মোটরবাইকে করেই মেডিকেলে নিয়ে আসা হলো। জিজ্ঞেস করলাম, এত ঝুঁকি নিয়ে কেন মোটরসাইকেলে নিয়ে এলেন, তার ওপর তিনজন। জবাবে দুর্ঘটনাকবলিতের বন্ধু বললেন, রাস্তায় এত জ্যাম অল্প সময়ে বাইক ছাড়া পৌঁছানো সম্ভব না। ট্রাফিক পুলিশও সেই পরামর্শই দিলেন। আমাদের এ ছাড়া আর উপায় ছিল না। আর বাইকাররা তো একেবারে গ্রীষ্মের জাম ফলের মতো। রাস্তায় রাস্তায় বিছিয়ে আছে। বেচারা বাইকারদের বিবেচনাও ভালো। বুঝতে পেরে ছুটে এলেন। ব্যস হয়ে গেল ফয়সালা। উঠে পড়লেন। সিএনজিচালক বাইকারদের মা-বাপ তুলে দিলেন গালি। কে শোনে কার কথা। বাইক তো ছুট। কয়েক বছরেই বাইক মানুষের অতি প্রিয় হয়ে উঠেছে। আর এখন সবার চক্ষুশূল। এটা সত্যি মোটরবাইক কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করে না। একটা আত্মঘাতী যান। নিজেরাই নিজেদের হত্যার কারণ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বেশি বেপরোয়া হচ্ছে গ্রাম থেকে শহরে আসা শেয়ার রাইডার সদস্যরা। তারা বেশি টাকা আয়ের জন্য মরিয়া। যানজট এড়াতে উল্টোপথের দিকে ছোটে, আবার কখনো ফুটপাতে।
অন্যদিকে, প্রতিদিন বাইক দুর্ঘটনার খবর সবার মুখে মুখে। বাসওয়ালাদের যত রাগ এই বাইকারদের ওপর। তারা যেভাবে যাত্রীদের দণ্ডমুণ্ডের অধিকারী হয়ে গেছে, সেখানে মোটরবাইকের এই আধিক্য কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে বটে। সিএনজি অটোরিকশার দাপট দেখেছি আমরা ১২ বছর। ইচ্ছামতো ভাড়া, যাত্রীদের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা কম করেনি। রিকশা তো আছেই।
সড়কে যদি দেখি উচ্চবিত্ত চার চাকার গাড়িতে বসে আছে, বিশাল জায়গাজুড়ে হয়তো দুই বা তিনজন। আর বাইকে ছোট্ট একটা জায়গা নিয়ে দুই-আড়াইজন। একেবারে কম গতির রিকশা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পুরো রাস্তায়। সিএনজিও আছে গায়ে গায়ে লেপ্টে। আর মাঝে মাঝে কয়টা বাস থেমে থেমে গোঁ গোঁ করে যায়। ইচ্ছামতো রাস্তার মাঝখানে থামে। তখনই বাইকের সঙ্গে ঝামেলা। হুট করে তীরের ফলার মতো বাইক এসে পড়ে গায়ের ওপর। আবার যেহেতু বাইকারদের পক্ষে সমর্থন নেই তাই এখন মোটরবাইকের নয়ছয় পেলেই চাপ দেয় বাস ও সিএনজি। তাদের ধাক্কায় যে বাইক দুর্ঘটনা ঘটছে এটা এখন আর কেউ বলে না। আমার কথায় মনে হতে পারে আমি হয়তো বাইকের গুণগান করছি। ব্যাপারটা তা নয়। বাস্তবতার কথা বলছি। দুর্ঘটনা দেখে বাইক বন্ধ করে আমরা কি কিছু কম গতির ইজিবাইকের আশ্রয় নেব? নাকি প্রাইভেট কার আর অটোরিকশায় সড়ক ভারাব?
দেশে তো প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটছে বাস, ট্রাক, লরি, রিকশা ও লঞ্চের। সবকিছু পুড়ছে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ আর ডিপোর আগুনে? কোনটা বন্ধ করব? আজকের বাস্তবতায় এ মুহূর্তে আমি বাইক রাখার পক্ষে। অন্যদিকে, বাইকবিরোধী মুভমেন্ট অন্য যানবাহনের চালকদের জন্য একটা পরিষ্কার সুযোগ করে দিচ্ছে। হুটহাট করে চার চাকার এবং তিন চাকার যান এসে ধাক্কা দিচ্ছে। আর অহরহই তাদের টিজিংয়ের শিকার হচ্ছে।
ক্ষমা করবেন, দুর্ঘটনা গবেষক এবং সড়ক আন্দোলনকারী শ্রদ্ধাভাজনরা। মোটরবাইক-বিষয়ক বিরোধিতা সেই দানবদের আরও ভয়ংকর করে তুলছে। সড়ক থেকে আগে তিন চাকার যান সরান, পাবলিক বাস বাড়ান। রিকশা রেখে বাস বাড়ানোর কথা ভাবলে একটু ভুল হবে। মোটরবাইক এখন যেন ‘গরিবের বউ সবার ভাবি’র মতো জায়গায় চলে গেছে। পৃথিবীর বড় বড় দেশ আর শহর যখন সড়ক থেকে বাইক সরিয়ে দিচ্ছে, আমাদের কেন এর ওপর এত নির্ভরশীল হতে হচ্ছে? আগে সড়কের মূল রোগগুলোর চিকিৎসা করাতে হবে। নইলে সমাধান আসবে না।
সবিশেষ বলতে চাই, এখন দেশের যানবাহন ব্যবস্থাপনার যে অবস্থা তাতে বরং ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমানোর বিষয়ে কঠোর হওয়া দরকার। আর শহরে এই ধীরগতির রিকশা গলিতে এবং জেলা শহর পর্যন্ত মানায়। কয়েক দিন ধরে বাইকবিরোধী ক্যাম্পেইনকে আমার পরিকল্পিত মনে হচ্ছে। এর আগে লিখেছিলাম সস্তায় জনপ্রিয়তা পাওয়ার প্রতিযোগিতা। এখানেও একটা সস্তা প্রতিযোগিতার গন্ধ আমি পাচ্ছি। ঈদে পদ্মা সেতুতে বাইক চলতে দিন। নিয়ন্ত্রণের চাবিটা একটু কঠোর করুন। জরিমানার পরিমাণ বাড়িয়ে দিন না। ঈদযাত্রা সহজ হবে। তরুণদের জন্য এইটুকু কি করা খুব কঠিন। তবে তারও আগে বলতে আগে চাই, বাইকবিরোধী এই ক্যাম্পেইন এখন ষড়যন্ত্রের রূপ নিচ্ছে। বাইক দেখলেই তড়ে তেড়ে চাপা দিচ্ছে, এ নিয়েও গবেষণা হোক। আর বাইকারদের জন্য নিয়ম মানার কোনো বিকল্প নেই। নিজেদের জীবন নিজেদেরই রক্ষা করতে হবে। বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩৬ লাখের বেশি। কিন্তু মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্স রয়েছে ২৩ লাখের মতো। অর্থাৎ ১৩ লাখের বেশি মোটরসাইকেল চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। এদিকে কেউ কেন নজর দিচ্ছেন না?
সবশেষে নিজের কর্মজীবনের দায় থেকে বলছি, আমরা গণমাধ্যমে এক বছর ধরেই মোটরবাইকের দুর্ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন করছি। তাদের বেপরোয়াপনা তুলে আনছি। দায়টা হলো, অন্য কারণগুলো আমাদের কাছে গৌণ হয়ে যাওয়া। আচ্ছা এটা কি বলা যায়, সব বাইক বন্ধ হলে আর দুর্ঘটনা হবে না। কেউ আর কোনো ভয়াবহতা দেখবে না? সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত করতে হলে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হলে আমাদের অবশ্যই ধীরে ধীরে বড় বড় দেশের মতো সড়ক ব্যবস্থাপনার দিকে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে বাইকের স্পিড লিমিট করে দিলে কাজটা সহজ হবে।
লেখক : সাংবাদিক
ummulwarasweety@gmail.com