শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:২৪ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

আমরা কি জাতি গঠনে ব্যর্থ

এম আর ইসলাম:

একটা দেশ উদার গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যায়, তার জাতিসত্তার পরিচয়ে। এই জাতিসত্তা এক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের মানুষরা নিজেদের এক ভাবে, ঐক্য তৈরি করে, আর হয়ে উঠে রাষ্ট্রের সমৃদ্ধির বাহক। তাই, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণ জাতি গঠন না হলে, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, কোনো মুক্তিই সম্ভব নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশ জাতি গঠনে ব্যর্থ হয়েছে। আজও বাংলাদেশ সংবিধানে বাঙালি আর বাংলাদেশি জাতীয়তার বিষয়টা স্পষ্ট নয়। অনুচ্ছেদ ৬ অনুযায়ী, নাগরিকদের ‘বাংলাদেশি’ বলা হচ্ছে। কিন্তু অনুচ্ছেদ ৯ অনুযায়ী, জাতীয়তার প্রশ্নে শুধু ‘বাঙালি’দের ঐক্য আর সংহতির ওপর জোর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে তাদের জাতিসত্তার অস্তিত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ, বাংলাদেশ কি শুধু বাঙালিদের? এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়কে, জাতীয় পরিচয়ে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ঠিক যেমনি রাষ্ট্র-ধর্ম ‘ইসলাম’ আর ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি করার মধ্য দিয়ে এক অদ্ভুত রাষ্ট্রীয় পরিচয় তৈরি করা হয়েছে। এবং এমনটা করা হয়েছে, যত না ধর্মীয় অনুভূতি থেকে, তার চেয়ে বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে। যদিও স্বাধীনতাসংগ্রামে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিবোধ ভূমিকা রেখেছিল, কিন্তু তাই বলে বাঙালি জাতীয়তাকে সাংবিধানিক কাঠামোয় প্রতিষ্ঠা করে, আর অবাঙালিদের পরিচয় অগ্রাহ্য করে, আমরা কি প্রমাণ করিনি এ দেশ সংখ্যাগরিষ্ঠের, এ দেশ সংখ্যালঘু বা দুর্বলের নয়?

সাংবিধানিক দিক ছাড়াও, বাঙালির রাজনীতির চর্চা, সামাজিক সম্প্রীতি, ধর্মীয় বোধ, সংস্কৃতি সবই আজ বিভাজিত। যে ব্রিটিশদের গালমন্দ করা হয় ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসির কারণে, স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরও সেই বিভাজনের রাজনীতি থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা বের হতে পারেনি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়েছে জাতি গঠনে ও নাগরিক ঐক্য তৈরিতে। ঐতিহাসিক ঘটনা আর তথ্যগুলোকে বিকৃত করে, রাজনৈতিক মেরুকরণ হয়েছে সামগ্রিকভাবে। সত্য, আধা সত্য, আর মিথ্যা, সব মিলেমিশে এখন রাজনীতির হাতিয়ার। বুদ্ধিজীবীরা রাজনৈতিক এজেন্ট হয়ে কাজ করে অনেক মিথ্যা বয়ানকে প্রতিষ্ঠিত করে রাজনৈতিক সত্য বানিয়েছে। এর পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ভুলভাল তথ্যের ছড়াছড়িতে বর্তমান প্রজন্ম হয়েছে দিগভ্রান্ত। অথচ, জাতির ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া ও সঠিকভাবে উপস্থাপন করাও জাতি গঠনের একটা প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হয়। জাতি গঠন বা জাতীয় ঐক্য হয়নি বলে, জাতীয় স্বার্থেও এ দেশের মানুষ বা রাজনৈতিক নেতৃত্বরা এক হতে পারে না। এক গ্রুপ আর এক গ্রুপকে পাকিস্তানপন্থি বা ভারতপন্থি বলে চিহ্নিত করে। বহুদলে, মতাদর্শে বিভক্ত এই জাতি, বৈশাখ উদযাপনের ধরন নিয়েও আজ দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। জাতির বিভক্তি রাষ্ট্র পরিচালনায়ও রাষ্ট্র-জীবনেও পরিলক্ষিত হয়। এমন ব্যবস্থায়, শাসক আর শাসিতরাও নিজেদের আলাদা করে রাখে; কেউ কারও আস্থায় থাকে না। এক অবিশ্বাসের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে চলে জাতীয় জীবন।

রাজনৈতিক অসংগতি আর দায় ছাড়াও এ দেশের মানুষের জীবনাচারণ ও ঐতিহাসিক ভৌগোলিক অবস্থানও জাতির খন্ডিত চরিত্রের জন্য দায়ী। নদীমাতৃক এ দেশের মানুষ নিজের এলাকা আর নদীর সীমানা ধরে নিজেদের দেশকে ভাবতে শিখেছে। তাই তো, আজও নিজের গ্রামের বা আঞ্চলিক বাড়িকে, তারা দেশের বাড়ি বলে। এদের কাছে প্রতিটি জেলা, উপজেলাও এক ধরনের দেশ। এমন ভাবনা গান্ধীর ‘ভিলেজ রিপাবলিকে’র সঙ্গে মিলে যায়। তাই তো, বেশির ভাগ মানুষ একটা দেশে বাস করলেও, তাদের ভাষার উচ্চারণ, খাবার, রান্নার ধরন, পেশা, এমনকি পারিবারিক কালচার ও খানিকটা আলাদা হয়ে গেছে। আঞ্চলিকতার ভিন্নতাকে এক সুতোয় গাঁথার দায়িত্ব ছিল মূলত রাষ্ট্রের। আর তা সম্ভব হতে পারত জাতির ঐক্য সৃষ্টিতে।

জাতি গঠন না হলে, জাতির ঐক্য হয় না। ঐক্য না হলে, মানুষ রাষ্ট্রের প্রতি বা দেশের রাজনৈতিক কাঠামোর প্রতি অনুগত থাকে না। এমনটা রাষ্ট্রের অর্থনীতিকেও সাংঘাতিকভাবে ব্যাহত করে। কারণ, বিভাজনের রাজনীতির সুযোগ নেওয়া যেকোনো সরকার জাতীয় প্রাধান্য ঠিক করতে প্রায়ই ভুল করে। জাতীয় ইস্যু, দলীয় ইস্যুতে ঢাকা পড়ে যায়। একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির অনুপস্থিতে, দেশপ্রেম তৈরি হয় না। তাই দেশীয় অর্থ আর সম্পদেরও প্রচুর অপচয় হয়ে যায়। দলীয় আর বিশেষ গোষ্ঠীর আখের গোছাতে গিয়ে, জাতীয় সম্পদের আর হিসাব থাকে না। সাধারণ মানুষ তখন অনেক ন্যায্য অধিকার থেকেই বঞ্চিত হয়।

আমাদের জাতি বিভক্তির নিদর্শন হিসেবে, সম্প্রতি কিছু ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। সীতাকু-ের আগুন-দুর্ঘটনায় যখন অর্ধশতাধিক মানুষ পুড়ে মারা গেছে, তখন সামাজিকমাধ্যমে কিছুটা শোক প্রকাশ করে, এ দেশেরই মানুষ আবার কোক-স্টুডিওর কনসার্টে যাচ্ছে। একটা জাতি কতটা হালকা মেজাজের হলে, এক দিনে সব ভুলে, অন্য কিছু নিয়ে মেতে উঠতে পারে। জাতির একতার শিকড় আর ভ্রাতৃত্ববোধ আসলে এদের অন্তরে প্রবেশ করতে পারেনি। মনস্তাত্ত্বিকভাবেও আজ এরা খানিকটা সংকর প্রজাতির। তবে, ব্যক্তিগত দায় যাই থাকুক না কেন, জাতি গঠনে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা সবার আগে চোখে পড়ে। তাই, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও, অতীত এবং বর্তমান জাতীয় নেতৃত্বের প্রতি দল, মত, ধর্ম, শ্রেণি নির্বিশেষে সবাই সমান শ্রদ্ধা দেখায় না। জাতীয় ইস্যুগুলোও বিভাজিত রাজনীতির চক্রে পড়ে অবহেলিত থাকে, দেশ-জাতিকে ভালোবেসে দুর্নীতি রোধেও কোনো প্রতিষেধক তৈরি হলো না। জাতি গঠন সম্পূর্ণ হয়নি বলে, জাতীয় স্বার্থও আমরা বুঝতে ব্যর্থ হই।

লেখক : শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION