শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:২৫ অপরাহ্ন
চিররঞ্জন সরকার:
জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে বিদ্যুৎ সংকটসহ নানাবিধ সংকটে যখন সাধারণ মানুষ হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন অত্যাবশ্যক, এমন ২০ জেনেরিকের ৫৩ ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। সরকারি সংস্থা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ওষুধগুলোর দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই তালিকায় জ্বর, উচ্চ রক্তচাপ, ত্বকের ওষুধ, রক্তাল্পতার ওষুধ যেমন রয়েছে, তেমনই প্যারাসিটামলের মতো সর্বাধিক ব্যবহৃত ওষুধও রয়েছে। এ ছাড়াও যন্ত্রণা উপশমের ওষুধ এবং অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধেরও দাম বেড়েছে। বেশিরভাগ ওষুধের দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। মহামারীর ধাক্কা মোটামুটি থিতিয়ে আসার পর থেকেই ওষুধের দাম বাড়ানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছিল ওষুধ তৈরির কোম্পানিগুলো। তাদের সেই প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। কিন্তু এটা সাধারণ মানুষের ওপর নতুন বোঝা হিসেবে দেখা দিয়েছে। গুটিকয় কোম্পানির সুপারিশের ভিত্তিতে এই দাম বৃদ্ধি কতটা নৈতিক ও যৌক্তিক, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, দেশের মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তালিকাভুক্ত ১১৭টি ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে সরকারের হাতে। তবে ওষুধের এ মূল্যবৃদ্ধির আগে অন্তত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে মানুষকে তা অবহিত করার নিয়ম। অথচ এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে যখন সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা, তখন কোনোরকম পূর্বঘোষণা ছাড়াই শুধু কোম্পানিগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে ৫৩টি ওষুধের দাম বৃদ্ধি খুবই বিস্ময়কর।
ওষুধের দাম কিন্তু গোপনে-নীরবে এর আগেও বাড়ানো চলেছে। শুধু করোনা-কালের পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে, জ্বর, সর্দি-কাশি, পেট খারাপ, বদহজম থেকে শুরু করে সুগার, প্রেশার, থাইরয়েডের মতো ক্রনিক রোগের ওষুধের একটা বড় অংশের বিপুল দাম বেড়েছে। কী করবে আমজনতা? কার্যত এর উত্তরই নেই সরকারের কাছে। ওষুধের দাম যতই বাড়ুক, এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ অসহায়। কারণ, ‘পেটে না-খেয়েও’ ওষুধ কেনা ছাড়া তো গতি নেই। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর দাম নির্ধারণ করে দেয় অল্প কিছু অত্যাবশ্যক ওষুধের। বাকি হাজার হাজার ওষুধের দামে নিয়ন্ত্রণ নেই। সংস্থাগুলো যখন-তখন দাম বাড়ায়। কখনো কমায় না।
আমাদের দেশে কোনো জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি অবশ্য নতুন কথা নয়। প্রায় সারা বছর মূল্যবৃদ্ধির আঁচে সাধারণ মানুষের হাত পুড়েই চলে। প্রান্তিক মানুষদের কথা বাদই দিলাম, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারেও আজ নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা। বর্তমানে পেট্রল-ডিজেলের দাম আকাশ ছুঁয়েছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব এসে পড়ছে বাজারে। হেঁশেলের গ্যাসের দাম গত ছয় মাসে দু দফায় বৃদ্ধির পর দুই চুলা ব্যবহারকারীদের জন্য এখন হাজার টাকা ছড়িয়েছে। সয়াবিন তেলের দাম সরকারিভাবে লিটারে ১৪ টাকা কমানোর পরেও তা এখনো অস্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে। এদিকে সর্ষের তেলের মূল্য প্রতি দিন চড়চড় করে বেড়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। সাধারণ বাড়িতে তেল দিয়ে মেখে আলুসিদ্ধ ভাত খাওয়াও যেন আজ বিলাসিতা মনে হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, চলতি বছরের মে মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি আমাদের দেশেও মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন ঘটেছে। বস্তুত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির প্রভাব নিম্ন আয়ের মানুষকে চরম দুরবস্থায় নিপতিত করেছে। এমনিতেই করোনার কশাঘাতে চাকরিহারা, বেকার ও আয়-রোজগার কমে যাওয়া জনগোষ্ঠী দৈনন্দিন খরচের টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন, এর মধ্যে মূল্যস্ফীতির চাপে বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়েছে অনেক পরিবার। এ অবস্থায় একসঙ্গে এতগুলো ওষুধের দাম বৃদ্ধি তাদের জীবনে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ দেখা দিয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ঢাকায় অনলাইন খাদ্য সরবরাহ প্রতিষ্ঠানে কাজ করা একটি ছেলে সেদিন কথায়-কথায় বলছিলেন যে, তিনি, এবং তার মতো অনেক কর্মী আগের চেয়ে অনেক কম দিন কাজ পাচ্ছেন, ওভারটাইমও পাচ্ছেন না। ফলে আয় অর্ধেকেরও কম হয়ে গিয়েছে। এই মানুষগুলোর কথা আমাদের গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা দরকার, কোনো অবস্থাতেই যেন অযৌক্তিকভাবে দাম না বাড়ে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার। কিন্তু সেটা আমাদের দেশে খুব কমই হয়। দাম নিয়ন্ত্রণে তদারকি করার যেহেতু কেউ নেই, ওষুধ কোম্পানিগুলো তাই নিজেদের ইচ্ছেমতো মূল্যবৃদ্ধির পাগলা ঘোড়া ছুটিয়ে চলছে। ঔষধ প্রশাসন নিধিরাম সর্দারের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তারা তেমন কিছুই করতে পারছে না। সেই আগ্রহও তাদের বড় বেশি আছে বলে মনে হয় না।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে এখন সবাই ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। যেসব জিনিসের কাঁচামাল আমদানিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কোনো রকম প্রভাব বা সম্পর্ক নেই, তারাও এখন যুদ্ধ পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে দাম বাড়াচ্ছেন বা দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চালাচ্ছেন। সরকার শক্ত হাতে এসব মুনাফাখোর মতলববাজদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সেই ম্যাকানিজম ও সদিচ্ছা আছে বলেও মনে হচ্ছে না। ‘ওষুধের দাম আরও বাড়বে’ এমন বার্তা পেয়ে বাজারে সারা বছর চাহিদা থাকে এমন ক্যাটাগরির বেশকিছু ওষুধ অনেকে আগাম কিনে সংরক্ষণ করছেন। বলা যায়, অনেকটা সয়াবিন তেল মজুদ করে রাখার মতো ঘটনা। যদিও এসব নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই।
শুধু অত্যাবশ্যকীয় বা দেশে তৈরি ওষুধ নয়, বিদেশি ওষুধের দামও অনেক বেড়েছে। এসব ওষুধস্বল্পতা দেখিয়ে কাস্টমারকে এক প্রকার জিম্মি করে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি দাম রাখা হচ্ছে। আইসিইউতে থাকা রোগীদের চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে অ্যাকট্রেমা ইনজেকশন, যা পরিমাণের ভিত্তিতে ২১ থেকে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। আবার এটির কৃত্রিম সংকটও তৈরি করে বিক্রি করা হয় ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকায়। আমদানি করা ওষুধের গায়ে বাংলাদেশি টাকায় মূল্য লেখার নিয়ম রয়েছে, কিন্তু এই নিয়ম বড় বেশি মানা হয় না। বিদেশি ওষুধ এক প্রকার লুকিয়ে রাখা হয়। এরপর সংকট দেখিয়ে চড়া মূল্যে বিক্রি করা হয়। রোগীরা বাধ্য হয়ে এসব ওষুধ কেনেন। সরকারিভাবে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পর্যায়ে শক্তিশালী বিশেষজ্ঞ কমিটি থাকা প্রয়োজন, তেমনি দামি ওষুধের একটা ওষুধ ব্যাংক থাকা দরকার। জরুরি প্রয়োজনে গরিব মানুষকে সেবা দিতে এটা খুবই দরকার। কিন্তু এসব প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে কে? সরকারের কি সেই সদিচ্ছা আছে?
২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত দেশে একটা ওষুধ মূল্য নির্ধারণ কমিটি ছিল। কিন্তু ৬ বছর পার হয়ে গেলেও নতুন কোনো কমিটির দেখা মেলেনি। আগে কমিটি প্রতিমাসে দুবার মিটিংয়ে বসত, যা এখন অতীত। ঔষধ প্রশাসন দাম বাড়ানোর প্রস্তাব যাচাই করার কথা বললেও আসলে যা প্রস্তাব আসে তাই অনুমোদন করা হয়। কোম্পানির দেওয়া মূল্য নির্ধারণ নড়চড় করার ক্ষমতা তাদের নেই বললেই চলে। কাগজে-কলমে ১১৭টি ওষুধ সরকার মূল্য নির্ধারণ করে। বাকি প্রায় ১৫শ কোম্পানির ৩৭ থেকে ৪২ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ রয়েছে। ১৫শ কোম্পানির ওষুধের দাম কোম্পানির মালিকরাই নির্ধারণ করেন। বিশ্বের যে কোনো দেশে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা করা ছাড়াও ওষুধগুলোর দাম নির্ধারণ করে সরকার। এটাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম। আমাদের দেশের ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিতেও তা ছিল। কিন্তু, ১৯৯৪ সালে ওষুধ কোম্পানির দাবির মুখে বলা হলো, ১৭ শতাংশ ওষুধের দাম সরকার নির্ধারণ করবে, বাকিটা করবে কোম্পানি। এটাকে বলা হলো ইন্ডিকেটিভ প্রাইস। এ রকম আজগুবি নিয়ম দুনিয়ার কোথাও নেই। এই নিয়ম বদলানো দরকার।
দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশীয় কোম্পানিগুলো উৎপাদিত ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে; অথচ এক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ভূমিকা মোটেই সন্তোষজনক নয়। মূলত ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হলে রোগী ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান উভয়ের স্বার্থই রক্ষা হবে। এ ব্যাপারে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। চিকিৎসা এখন আর সেবাধর্মী কাজ নয়, এটি পরিণত হয়েছে বাণিজ্যের প্রধান উপকরণে, যার প্রকৃষ্ট উদারহরণ হলো ওষুধের দাম নিয়ে এমন অশুভ তৎপরতা। দেশের বিপুলসংখ্যক সাধারণ রোগীর স্বার্থে এ তৎপরতা বন্ধ হওয়া উচিত। দাম নির্ধারণের বিষয়টি যেহেতু ঔষধ প্রশাসনের আওতাধীন, তাই ওষুধপত্রের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের ব্যাপারে তাদের এমন ভূমিকা থাকা উচিত, যাতে দেশের মানুষ সুলভে ওষুধ পেতে পারে।
লেখক কলামিস্ট ও লেখক