শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:১৭ অপরাহ্ন
এহসান মাহমুদ:
পত্রিকার সম্পাদকীয় লিখতে এত সময় লাগে? তিন ঘণ্টা! ছয়শ শব্দ লিখতে তিন ঘণ্টা! নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি। নিজেই অবাক হই। লিখি আবার সামনে থাকা কি-বোর্ডের ব্যাকস্পেস চেপে ধরি। মুহূর্তেই সব মুছে যায়। কম্পিউটারের মনিটর সাদা হয়ে যায়। ওদিকে অফিসের গ্রাফিক্স রুম থেকে জোর তাড়া পেইজ মেকআপ করতে হবে। কিন্তু আমার যে লেখাই শেষ হয়নি! শূন্য মনিটরের দিকে তাকিয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে আবার লিখতে শুরু করি। আশপাশে চোখ রাখি। আমার ঠিক সামনেই সেন্ট্রাল ডেস্ক। অধিকাংশ চেয়ার খালি। বামপাশে রিপোর্টারদের বসার জায়গা। সেখানে কয়েকজন আছেন। কারও মুখে কোনো কথা নেই। সবাই যেন রোবট হয়ে আছেন! মুখবুজে কাজ করে যাচ্ছেন। অথবা আমারই মতো সবাই নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাইছেন। প্রুফ বিভাগ থেকে আবারও তাড়া আসে, সম্পাদকীয় দেওয়া হয়নি। চেয়ার থেকে উঠে একবার ওয়াশরুমে যাই। চোখে মুখে পানি দিয়ে নিজের ডেস্কে ফিরে আসি। তখনই মনে পড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘উনিশশো একাত্তর’ কবিতাটি“যে যায় সে চলে যায়, যারা আছে তারাই জেনেছে/বাঁ হাতের উল্টোপিঠে কান্না মুছে হাসি আনতে হয়।”
কান্না মুছে ‘পথিকৃৎ সাংবাদিক’ শিরোনামে সম্পাদকীয় লেখা শেষ করি। দেশ রূপান্তর সম্পাদক অমিত হাবিব, আমাদের অমিত দা আর নেই। তাকে নিয়ে যখন এই লেখা লিখছি, তখন তিনি রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে ঝিনাইদহের মহেশপুরের কাজিরবেড় গ্রামে ঘুমিয়ে আছেন। অমিত দা’র সঙ্গে প্রথম আলাপের কথা মনে পড়ে। এই লেখা যেখানে বসে লিখছি, সেই দেশ রূপান্তর অফিসেই তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। সেদিন তার কক্ষে আরও ছিলেন গাজী নাসিরুদ্দিন আহমেদ (খোকন) ও মাহবুব মোর্শেদ। একজন নবীন কর্মী হিসেবে তার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন মাহবুব ভাই। আলাপ শেষে অমিত দা বললেন, কাজ শুরু করে দেন। কাজটাই পরিচয় দেবে। বাকি পরিচয় একদিন তৈরি হবে। সেই থেকে শুরু দেশ রূপান্তরের সঙ্গে।
অমিত দা’র আরও কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ শুরু করার পর। অমিত দা সবাইকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেন। বয়সের ব্যবধানের পার্থক্য দেখিয়ে আমি একদিন বললাম, ‘দাদা, আমাকে তুমি করে বলেন না কেন!’ দাদা হাসলেন। বললেন, ‘অভ্যাস হয়ে গেছে এহ্্সান। সবাইকে ডাকতে ডাকতে এমন হয়েছে। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে আর ফিরে আসা কঠিন।’ প্রিয় অমিত দা, আমাদেরও তো অভ্যাস হয়ে গেছে দুপুরে অফিসে এসে শিঙ্গাড়া আর চায়ের।
আমি কাজ করি দেশ রূপান্তরের সম্পাদকীয় বিভাগে। অফিসে আসতে হয় বারোটার মধ্যেই। এরপর দাদার সঙ্গে আমরা মিটিংয়ে বসতাম। একটা অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল, দুপুরে সম্পাদকীয় বিভাগের সঙ্গে মিটিংয়ের সময় চায়ের সঙ্গে শিঙ্গাড়ার। ছোট ছোট শিঙ্গাড়া হাতে নিয়ে প্রথমে ভালো করে দেখতেন অমিত দা, তারপর মুখে পুরতেন। কোনো কোনো দিন লেখা এবং সম্পাদকীয় নিয়ে আলোচনা শেষ হলেও শিঙ্গাড়ার জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকতাম।
অমিত দা, আপনাকে বলা হয়নি, আপনি যেদিন অফিসে আপনার রুমেই স্ট্রোক করলেন, তারপর প্রথমে পান্থপথের স্কয়ার হসপিটাল ও পরে বিআরবি হসপিটালের আইসিইউ রুমের সামনে অপেক্ষা করতেও আমার মন্দ লাগেনি। প্রায়ই মনে হতো নাকে-মুখের নল খুলে একটু পরেই আপনি বের হয়ে আসবেন। আমার দিকে তাকিয়ে বলবেন, কী এহ্্সান নতুন কোন বই পড়লেন?
সম্পাদকীয় বিভাগে আমাদের কাজ শেষ হয়ে যায় সন্ধ্যার পরপরই। অফিস থেকে বের হওয়ার আগে অমিত দার রুমে যেতাম। বলতাম, দাদা বের হই আজকের মতো। অমিত দা বলতেন, কই যাবেন এখন? বাতিঘরে যাবেন নাকি শাহবাগে? বসেন। এককাপ চা খেয়ে যান। আমি জানতাম, এখানে বসলে আর কোথাও যাওয়া হবে না। তবুও বসতাম। ঘড়ির কাঁটায় ৯টা বাজলে তিনি যখন নিউজ রুমে বা গ্রাফিক্স রুমে যেতেন, তখন ওঠার সুযোগ পেতাম। ততক্ষণ বসে থাকতাম। মন্দ লাগত না। অনেক কথা হতো। সেখানে বসে বসেই নতুন কাজের প্ল্যান হতো। এমন এক সন্ধ্যায় আলাপের পর অফিস থেকেই রাতে রওনা দিয়েছিলাম রংপুরের পীরগঞ্জে। সাম্প্রদায়িক হামলায় জেলেপল্লীতে আগুনের ঘটনা ঘটেছিল। পীরগঞ্জ থেকে দাদার সঙ্গে ফোনে কথা বললাম। দাদা বললেন, ভালোভাবে সবার সঙ্গে কথা বলেন। আশপাশটা ঘুরে দেখেন। দুদিন পর রংপুর থেকে ঢাকায় ফিরলাম বিমানে। দুপুরে অফিসে ফিরতেই দাদা সব জানতে চাইলেন। বিস্তারিত খুলে বললাম। আমাকে বললেন, যেভাবে বললেন, সেভাবেই লিখে দেন। আমি লিখে দিলাম। দেশ রূপান্তরের প্রথম পাতায় তিন পর্বের ধারাবাহিক রিপোর্ট ছাপা হলো। দাদা বললেন, দেখলেন আপনাকে রিপোর্টার বানিয়ে দিলাম! বলেই হাসলেন। এমন রিপোর্টার দাদা আমাকে আরও বানিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশন গঠনে বিশিষ্টজনদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই তালিকার অসংগতি নিয়ে দাদার সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। দাদা বললেন, বিস্তারিত লিখে ফেলেন তো এহ্্সান! সন্ধ্যায় লেখা জমা দিয়ে বাসায় চলে গেলাম। পরদিন সকালে পত্রিকা হাতে নিয়ে দেখি ওইদিনের লিড নিউজ হয়ে আছে! এভাবে চমকে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল অমিত দার।
এ মাসের প্রথম দিকের কথা। আমাকে অন্য একটি পত্রিকা তাদের সঙ্গে কাজের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সেখান থেকে ফিরে অমিত দাকে বিস্তারিত জানালাম। অমিত দা সব শুনলেন। তারপর বললেন, আপনার যোগ্যতা আছে, আপনাকে তারা সে জন্য বাছাই করেছে। কিন্তু এমন স্বাধীনতা আপনি কই পাবেন? কে দেবে এমন স্বাধীনতা? ইচ্ছেমতো সবকিছু করতে পারছেন। যখন আপনাকে স্বাধীনতা দিতে পারব না, তখন আর থাকতে বলব না। অমিত দার লেখা আশির দশকে কোনো এক লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘একজন মানুষ আনো’ শিরোনামের একটি কবিতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে তার মৃত্যুর পর। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘শুধু স্বাধীনতা শব্দটি বিশুদ্ধ উচ্চারণ/করতে পারে উদাত্ত গলায়/তেমন একজন মানুষ আনো।’ অমিত দা, আপনাকে বলার সুযোগ হয়নি, আপনার মতো বিশুদ্ধ উচ্চারণে কেউ আমাকে কোনো আদেশ করেনি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
ভয়েস/আআ