শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:০২ অপরাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
ভালো-মন্দ বৈশিষ্ট্য নিয়েই মানবসত্তা। তাই কখনো সে নিজের প্রয়োজনে হিংসুক, ঝগড়াটে, অহংকারী, যুদ্ধকারী ও হত্যাকারী। আবার নিজের প্রয়োজনে সে ভালোবাসায়, স্নেহ-মায়া-মমতায়, সততায়, সাহসিতকতায়, উদারতায়, চপলতায়, জ্ঞানে-গুণে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। তবে কোনটা গ্রহণীয়, কোনটা বর্জনীয়, তা সমাজই ঠিক করে দেয়। সমাজের ঠিক করা এই মানবিক গুণাবলি যেমন সত্যবাদিতা, উদারতা, মায়া-মমতা এসবকে কল্যাণকর মনে হয়। অপরদিকে মারামারি, হিংসা-বিদ্বেষ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদিকে সমাজ চিরকালই ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে আসছে।
ব্যক্তি যখন নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করে, তখন তার মধ্যে এক ধরনের অহংবোধ জন্মায়। ফলে সে যেকোনো সময় ভুল করে ফেলতে পারে। এ জন্য সমাজের মধ্যে সংশোধনের একটি পথ খোলা, তা হলো সমালোচনা। অর্থাৎ তার দোষ-ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেওয়া, সংশোধন করা, যাকে বলা যায় সংশোধনের উদ্দেশ্যে সমালোচনা।
এই আলোচনা প্রথমে ব্যক্তিপর্যায়ে হবে, তারপর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল; এরপর পর্যায়ক্রমে ওপরের দিকে। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে অনেক সময় দায়িত্বশীলের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে। এটা যেমন দলের মধ্যে দেখা যায়, তেমন রাষ্ট্রীয়ভাবেও। মানব প্রকৃতিই এমন, সবাই চাই সমালোচনা মেনে সহনশীল মনোভাব গড়ে উঠুক। কিন্তু অনেক সময় তা হয়ে ওঠে না। সমালোচনা মেনে সহনশীল, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, ঐক্যবদ্ধ সাংগঠনিক জীবনের চর্চা যদি সবাই করি, তাহলে যে যেই দলের রাজনীতি কিংবা মতাদর্শ অনুসরণ করি না কেন, তা কখনো সীমালঙ্ঘন করবে না।
অন্যদিকে, দুঃখজনক হলেও সত্য, সমাজে সমালোচনার চর্চা যেভাবে চলছে, তাতে আমরা সহনশীলতার মাত্রা ক্রমেই হারাতে বসেছি। ব্যক্তিপর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় তথা সবক্ষেত্রে কমবেশি আমরা অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি। কাকে কী বলছি, সেই মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে আমিত্বকে বড় করে দেখছি। ফলে বাড়ছে হিংসা, রাগ, ক্ষোভ, অহংকার, গিবত, চোগলখুরি। অন্যদিকে তৈরি হচ্ছে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা। এ অবস্থা চলতে পারে না, এটা সমাজের জন্য কল্যাণকর নয়। জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে শুধু তার বাহ্যিক চাকচিক্য যথেষ্ট নয়, ভেতরের চাকচিক্য প্রয়োজন। অর্থাৎ দেশের রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত থেকে শুরু করে যাপিত জীবনে বস্তুগত অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আচার-আচরণ তথা নৈতিকবোধের জায়গায় কি আমরা উন্নত করতে পেরেছি? এই বোধের চর্চা যদি শুধু একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ রাখি, তাহলে জাতি হিসেবে কি উন্নত হতে পারব? এই বোধের চর্চা ব্যক্তিজীবনে যেমন জরুরি, তেমনি কর্মজীবনে, পারিবারিক জীবনে, সামাজিক পরিমণ্ডলে, প্রতিষ্ঠানসমূহে, সাংগঠনিক জীবনে; এমনকি রাজনৈতিক দলের মধ্যেও অধিক হারে হওয়া প্রয়োজন।
প্রশ্ন হলো, এই সমালোচনার মাত্রা ঠিক করবে কে? এর মাপকাঠিই বা কী হবে? মনোবিজ্ঞানী ও গবেষকদের মতে, দীর্ঘদিন চর্চার ফলে সমাজের মধ্যে থেকেই ঠিক হয়ে যায় মাত্রাজ্ঞান। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন একজন সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও শিক্ষক। আলোচ্য বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে হাদিসে তিনি ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত ইমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ তার ইচ্ছা, কামনা-বাসনা আমার আনীত বিধানের অনুবর্তী না হবে।’মিশকাত
বর্ণিত হাদিসের আলোকে বিশ্বনবীর আদর্শ হলো, সমালোচনার দিকটি সামনে রাখা। অপরের কল্যাণ কামনার উদ্দেশ্যে ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার পদ্ধতিকে ইসলামি পরিভাষায় ইহতেসাব বলা হয়। এর বাংলা গঠনমূলক সমালোচনা, সংশোধনের উদ্দেশ্যে সমালোচনা। আর সামষ্টিক গঠনমূলক সমালোচনাকে আরবিতে মুহাসাবা বলা হয়। এই সমালোচনার উদ্দেশ্য অপরের দোষত্রুটি সংশোধন, কল্যাণ কামনা, সম্পর্ক উন্নয়ন ও মজবুত করা, পরচর্চার পথ বন্ধ করা, সন্দেহের পথ দূর করা, ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনকে গতিশীল করা, যেখানে থাকবে সুস্থ-সবল রোগমুক্ত, শান্ত পরিবেশ। কেউ কাউকে গালি দেবে না, ঝগড়া করবে না, শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ করবে না ইত্যাদি। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। অতএব ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক কল্যাণকর ব্যবস্থা গ্রহণ করো।’সুরা হুজরাত : ১০
হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই অপর ভাইয়ের আয়নাস্বরূপ। অতএব কেউ যদি তার ভাইয়ের মধ্যে কোনো ক্ষতিকর দিক দেখে, তাহলে তা যেন দূর করে দেয়।’জামে তিরমিজি। অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘একজন মুমিন অপর মুমিনের দর্পণস্বরূপ এবং এক মুমিন হচ্ছে অপর মুমিনের ভাই। সে তার অধিকার তার অনুপস্থিতিতেও সংরক্ষিত রাখবে।’ -সুনানে আবু দাউদ
কোরআন-হাদিসের আলোকে সমালোচনার মাত্রা কতটুকু হওয়া উচিত, তা উপলব্ধিতে এনে নিজ দায়িত্বে হেফাজত ও প্রয়োগ করা। আলোচনা সৃষ্টি, অন্যকে ছোট করা, স্বার্থসিদ্ধি, শত্রুতা পোষণসহ অহেতুক অন্যের সমালোচনা না করা। কারও পেছনে না লাগা। নিজের জীবনকে উন্নত-নৈতিক চরিত্রে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করা, সর্বদা আল্লাহকে ভয় করা। আর নবী কারিম (সা.)-এর ভাষায় এই বলে দোয়া করা, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদের অন্তরগুলোয় পারস্পরিক ভালোবাসা সৃষ্টি করে দাও এবং আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক সংশোধন করে সুন্দর করে দাও।’
ইসলামের শিক্ষা হলো, ব্যক্তি সংশোধনের পথ ধরেই পরিবার, সমাজ এগিয়ে আসবে। শুধু ব্যক্তি হলে হবে না, যে যে দায়িত্বশীল পর্যায়ে আছে, সবার সমালোচনার মাত্রাজ্ঞান থাকতে হবে। সমাজের ভেতর পচন ধরতে যাওয়া মাথাগুলো যত তাড়াতাড়ি বিষয়টি উপলব্ধিতে আনবে, তত তাড়াতাড়ি সমাজ লাভবান হবে। সেই সুস্থ নীতিবোধ সমাজের প্রতীক্ষায়!
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক